দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

কবি ও পাণ্ডুলিপি – রাবাত রেজা খান

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রাত ২ টা বেজে ১৭ মিনিট। আকাশে মেঘের আনাগোনা। মেঘদল উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে। ডাকসুর উল্টোপাশে বাইরের যে দুইটা সিঁড়ি আছে সেখানের একতলার সিঁড়িতে কবি বসে আছেন। হাতে আধপোড়া সিগারেট।

জায়গাটা কবির খুব প্রিয়। সময় পেলেই ক্লাস শেষে এসে বসেন। সিঁড়িতে বসে সবার চলাচল দেখেন। রাতে এখানে বসে চারদিকের অপার্থিব সৌন্দর্য দেখা নেশার মতো হয়ে গেছে।

অবশ্য প্রতি শুক্রবার সব কাজ শেষে দীর্ঘ রাত বসে থাকেন। মেঘেদের আনাগোনা দেখেন। তারাদের ঝিলিমিলি দেখেন। মেঘ ঢেকে ঢেকে দেয় চাঁদের শরীর। মেঘদল উড়ে যায় দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে।

আজও কবি বসে আছেন। সেই সাড়ে বারোটা থেকে। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি। খেতে ইচ্ছা করছিলো না। পকেটের অবস্থাও খুব ভালো না। কিছু রাত এভাবেই কেটে গেলে মন্দ কি? তাছাড়া রাত তো চলেই যায়।

সন্ধ্যায় মা ফোন করেছিলো। বাবা, খেয়েছিস?

মা ফোন করলেই এই কথা জিজ্ঞেস করেন।

না, মা, একটু পরেই খেয়ে নিবো। চিন্তা করো না।
কবি উত্তর দিয়েছিলো।

বাড়ি আসবি কবে, তোর বাবা আবার পাগলামি শুরু করছে, আরো অনেক কথা মা বললেন।

বাবার পাগলামি মানে হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত কাজকারবার করা, কখনো পালা গানের আসর বসানো, কখনো কবুতর পালন করেন, কখনো মাছ চাষ প্রজেক্ট করেন, কখনো বা কোনো কারণ ছাড়া এলাকাবাসীকে দাওয়াত দিয়ে দাওয়াত খাওয়ান, খাওয়া শেষে বলেন, ভাইসব, আমার মরনের পরের দাওয়াত আগেই খাওয়ায় দিলাম।

এইসব হাবিজাবি আর কি!

মা ভালো আছে, তাই শান্তির পরশ কবির হৃদয়ে ঘুরে বেড়ায়। কবি বসে আছেন। মাথায় কবিতার লাইন কিলবিল করে। রাত বাড়ে। আরো গভীর হয়। ভাবা বেশে চোখ তুলে তাকানোই দায়।

খাতার পাতা ভরে ওঠে কলমের আঁকিবুকিতে।
পান্ডুলিপি তৈরি হচ্ছে। প্রথম পান্ডুলিপি। শীঘ্রই কবিতার বই বেরুবে কবির। কবি তাই ব্যস্ত পান্ডুলিপি নিয়ে।

এ যুগে সবাই ডিজিটাল, পান্ডুলিপি হয় ল্যাপটপে-পিসিতে। সেই হিসেবে কবি এখনো অ্যানালগ, কবির পান্ডুলিপি তৈরি হচ্ছে পাতায়।

সাদা ধবধবে খাতার পাতা ভরে উঠছে কলমের আঁকিবুকিতে। তৈরি হচ্ছে একটার পর একটা কবিতা। গড়ে ওঠছে কবিতার পান্ডুলিপি।

প্রথম কবিতার নাম দেওয়া হয়েছে “অ”। শুধুই অ– বাংলা ভাষার বর্ণমালার প্রথম অক্ষর। বড়ই দুঃখিনী অক্ষর। রাত বাড়ছে। গভীর রাত। মেঘদল উড়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। হঠাৎ ঝড়ের পূর্বাভাস। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি আসবে।

কবি তার পান্ডুলিপি নিয়ে উঠলেন। শ্যাডোর সামনে দিয়ে, মল চত্বরের ভেতর দিয়ে কবি যখন দৌড়ে ভিসি চত্বরে পৌঁছালেন ততক্ষণে কাকভেজা।

ভিজে একাকার। পকেটে কবিতার পান্ডুলিপি। পান্ডুলিপি সামলে নিয়ে কবি থামলেন রেইন্ট্রি গাছের নিচে। বৃষ্টিপতনের আলাদা একটা ছন্দ আছে। প্রতি ফোঁটায় কেমন উন্মাদনা জাগে। বৃষ্টি দেখার নেশায় পেয়েছে কবিকে। মাঝে মাঝে এমন সব নেশা হয়। ঘোর লাগে। তাছাড়া এতো রাতের বৃষ্টি। চারিদিক কেমন যেনো হয়ে গেছে।

কবি ফুলার রোড ধরে হাঁটছেন। হলে ফিরতে হবে। ভেজা জামা কাপড় শরীরে লেপ্টে আছে। পকেটে কবিতার পান্ডুলিপি। একটু সামনে আসতেই অন্ধ ল্যাম্পপোস্টটার সাথে দেখা।

আগে সোডিয়াম আলো জ্বলতো। চারিদিক আলোকিত করতো। তখন থেকেই কবির সাথে সখ্যতা। ইদানিং সোডিয়াম আলো জ্বলে না।

আশেপাশে কোথা থেকে যেন বেলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কবির খুব প্রিয়। তবে গাছটি কোথায় এখনো জানা যায়নি। ফুলের গন্ধে কবির মাথায় আবার কবিতার লাইন কিলবিল করছে। পকেটে কবিতার পান্ডুলিপি। কবি ভেজা কাপড় আর পান্ডুলিপি নিয়ে হলে ফিরলেন।।

(দুই)

কবি পান্ডুলিপির কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে পান্ডুলিপির যা অবস্থা হয়েছে বলার মতো নয়।

বিকেল বেলা। চারুকলার বকুল তলা। কবির প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। বকুল তলায় বসে কবি আনমনে ভাবছিলেন বাড়ির পাশের বকুল গাছটার কথা। বকুলের ফুল, বকুলের মালা, কষমিষ্ট বকুলের ফল। যে দিন গেছে সেদিন আর ফিরে আসবে না।

কবি চারুকলা থেকে বের হয়ে শাহবাগের দিকে পা বাড়ালেন। পকেটে কবিতার পান্ডুলিপি।
জাদুঘরের সামনে প্রতিদিন কিছু না কিছু ভীড় থাকে। লোকজন আসে। টিকেট কাটে। জাদুঘর ঘুরে দেখে।

কী মজা পায় কে জানে? এতো দিন হয়ে গেলো কবির কোনো দিন যাওয়া হয়নি। শাহবাগ ছেড়ে কবি কাওরান বাজারের দিকে হাঁটতে থাকলেন। উদ্দেশ্য চাচার বাসা।

ছোট চাচা ফোন দিয়ে বলেছে, বাড়ি যাস না বহুদিন, এখানে এসে ঘুরে যা। চাচা বাউল বাগে ছোটখাটো মুদি দোকান করেন। দিন কোনোরকম চলেই যায়।

যেতে হবে নাখাল পাড়া ছেড়ে আরো সামনে।
কাওরান বাজারকে ঢাকা শহরের শাক সবজির গোডাউন বলা চলে। সব ধরনের শাক সবজি পাওয়া যায়।

কবি যখন সাভারে থাকতেন, তখন নিজেই রান্না করে খেতে হতো। তাই শাক সবজি দেখলে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে কবির।

চাচার বাসায় চাচা ছাড়া আর কাউকে পাওয়া গেল না। চাচি গেছেন দোকানে। চাচা কেবল মাত্র বাসায় ফিরছেন। এই সময় কবি হাজির। রান্না করা ডিম আর মাছের ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া হলো দুজনের। চাচা কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলেন। বললেন, আসবি মাঝে মাঝে, ঘুরে যাবি।

নিজ বংশের কাউকে দেখলে নাকি তার পরান জুড়িয়ে যায়, তাই এই কথা তিনি বারবার বললেন।

কবি বললেন, পরান জুড়ানোর জন্য হলেও মাঝে মাঝে আসবো, এখন আমি যাই।

পকেটে পান্ডুলিপি নিয়ে কবি হাঁটতে শুরু করলেন।

তেজকুনি পাড়ার ভেতর দিয়ে ক্রুশওয়ালা চার্চটাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কবি ফার্মগেট ওভার ব্রীজের পাশে এসে দাঁড়ালেন।
ঢাকা শহরের ব্যস্ত জায়গাগুলোর একটি হলো ফার্মগেট ওভার ব্রীজ। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে আসে। ব্রীজের উপরে বসে রঙ বেরঙের দোকান। একদামের মোজার দোকান। ব্রাশের দোকান। টুকিটাকি জিনিসের দোকান।

ওভার ব্রীজের উপর চড়ে পিলপিল করে চলা মানুষদের দেখতে কবির ভালোই লাগে। কবিতার লাইন মাথায় ঘুরপাক খায়। পকেটের পান্ডুলিপি বের করে ঘসঘস করে কবি লিখতে থাকেন কবিতার লাইন।

কবিতা হলো ঈশ্বরের বানীর মত, চাইলে যে কেউ কবিতা লিখতে পারে না। কবি ভাবেন এই সব কথা।

ওভার ব্রীজের নিচে কিছুক্ষণ বিচিত্র মানুষের চলাচল দেখে কবির মন আনন্দে ভরে যায়।
নিজেকে একজন সুখী মানুষ মনে হয় কবির।
অজানা এক ভালো লাগায় ভরে ওঠে মন।

প্রতিটা কবিতা লেখার পর এমন এক অনুভূতি ও শিহরণ জুড়ে থাকে কিছুটা সময়। পান্ডুলিপি পকেটে পুরে কবি হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিছু পুরাতন বই কিনতে হবে, একজন বই বিক্রেতার সাথে পরিচয় আছে কবির, কম দামে বই দিয়ে দেয়। কবি হাঁটছেন।

পান্থপথ সিগনালে আসতেই কবি আবার কবিতার খাতা বের করলেন। আবার ঘোর লেগেছে। কিছু লিখতে হবে। ঘোর লাগার সময়টাতে যা কিছু লিখা হয়, সব কিছু মনে হয় আপনা আপনি আসছে। ভাবতে হয় না। চিন্তা করতে হয় না। বাধুনি লাগে না। কেমন করে জানি হয়ে যায় সবকিছু।

গোধুলি সন্ধ্যায় চারিদিক কেমন যেনো লাগে। যদিও শহর এলাকা, সোডিয়াম বাতি জ্বলে। এই সন্ধ্যায় কবির নিজ গ্রামের গেঁয়ো সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। জোনাক পোকা জ্বলা সন্ধ্যার কথা।
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকাডাকিতে পাগল করা সন্ধ্যার কথা। ভর সন্ধ্যায় পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা শঙ্খের ধ্বনি আর সন্ধ্যা সংগীতময় সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে কবির। কবি কবিতার পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে হাঁটছেন।

অজানা এক ভালো লাগা কাজ করছে দেহ-মন জুড়ে। হঠাৎ, ঠিক হঠাৎ করে শুয়োরমুখো কী যেন একটা কবিকে প্রচন্ড ধাক্কা দিলো। কবি ছিটকে পড়লেন কয়েক হাত দূরে। হাতে ধরা তখনো কবিতার পান্ডুলিপি।

অস্পষ্ট কিছু চিৎকার চেঁচামেচি কবির কানে আসছে।

কবি ভাবছেন, এখন কি সকাল? নাকি মধ্যরাত? একি কোনো ঘোর লাগা নাকি অন্যকিছু, আগে তো এমন কোনোদিন হয়নি। কোথায় আছি? কেউ কিছু বলছে না কেন? কবি কিছু বুঝতে পারছেন না।

কেউ একজন বললো, মানুষটাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কে জানি পাশ থেকে বললো,
আহা, মানুষটা কিছু লিখছিলো।

[divider style=”solid” top=”20″ bottom=”20″]

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu