মাহির তাজওয়ার
জন্ম চুয়াডাঙ্গায়। ছোটগল্প লেখক এবং ছড়াকার।
মাহির তাজওয়ার

ওয়ারিশ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

আমজাদ আলী তার বাম হাতে প্রতিদিন রাতে একটা করে ইনজেকশান ফোটায়। ইদানিং অবশ্য পায়ে ফোটায়। প্রতিদিন নেশার ঔষধ কেনা লাগে। সিরিঞ্জ কেনা লাগে না। এক সিরিঞ্জে প্রায় অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দেয় আমজাদ। অবশ্য এর জন্য তার একটা উপকার হয়েছে। বাম হাতে তার ঘাঁ। পচন ধরেছে। হাত দিয়ে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ ছড়ায়। তার উপরে এই পচনটা ছড়িয়ে পড়েছে পায়ে। হাত ও পায়ের গন্ধে মানুষ অস্থির। যার সামনে এসে দাঁড়ায়  তারই গন্ধে গা গুলিয়ে আসে। আর এই গন্ধের কারনে সে আজ অনেক টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারছে। যদিও তার বাড়িতে বউ নেই। আমজাদের মনে পড়ে তার বউ জরিনার কথা। তাকে ছেড়ে চলে গেল, যাওয়ার সময় তার কয়েক বছরের বন্ধনকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভালোবাসাকে অপমান করল। তার হৃদয়ের যে অংশে জরিনার প্রতি ভালোবাসার স্থান ছিল সেটুকু কেটে নিয়ে, দিয়ে গেল শুধু ঘৃণা। আর রেখে গেল তার কয়েক বছরের ভালোবাসার ফসল আনুকে। আমজাদ কত না বিপদে। দুধের শিশু। কি করবে শিশুটিকে নিয়ে?

আমজাদ জরিনাকে ভালো যে বাসতো না তা নয়। ভালোবাসতো। খুব ভালোবাসতো। শুধু ভালোবাসলে তো হবে না। তাকে ভাত কাপড়ও দিতে হবে। তার জন্য দরকার টাকার। কিন্তু আমজাদ কোন কাজ করতে চাইতো না। কাজ করতে খুব কষ্ট। যদিও বা এক দু দিন কাজ করত তা তার নেশা করতে ফুরিয়ে যেত। কি করবে? চুরি করা ধরল। চুরির টাকা দিয়ে নেশা করতো সে। একদিন অনেক রাতে মাতাল হয়ে আসে। বউকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। তার জন্য জেগে না থাকার কারণে আচ্ছা করে পিটাতে থাকে। জরিনা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদে। আনুর তখনো জন্ম হয়নি। জরিনার কেবল দুমাস। আমজাদ জরিনাকে সেই রাত্রেই সাঁজতে বলে। জরিনা তবু চুপ করে বসে থাকে। প্রবল রাগে কাঁপতে থাকে, মিনসে, মাইঝ রাইতে মাতলামি করার জায়গা পায় না। মরেও না। গাড়ির তলে পড়ি মরলিই আমার শান্তি। আর কোন কথা নয়। আমজাদ সজোরে একটা লাথি মারে জরিনার পেটে। জরিনা ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে। হাউমাউ করে কাঁদে। দুর হ বাড়িত তি, কর্কশ কন্ঠে আমজাদ বলে। সেই মাঝ রাতেই জরিনার কান্নায় আশপাশ ভারি হয়ে ওঠে। হঠাৎ মায়া হয় আমজাদের। মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। সে বউকে আদর করার চেষ্টা করে। জড়িয়ে ধরে।

যেদিন আনুর জন্ম হল সেদিন আমজাদ দড়ি দিয়ে বাঁধা। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তাকে ঘিরে লোকজনের ভীড়। চড়, থাপ্পড় আর ঘুষি। তারপর জেল। আমজাদের মনটা বিষিয়ে ওঠে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ছেলেকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ছুটে চলে আসে বাড়িতে। ছেলেকে দেখে মন ভরে যায়। একদম দেখতে তার মতো। ভাবে আর চুরি করবে না আমজাদ। প্রয়োজনে ভিক্ষা করবে। কিন্তু কোথায় তার বউ? আমজাদ যেদিন বাড়িতে এল সেদিন জরিনাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পাশের বাড়ির  ফতেহ আলীকেও পাওয়া গেল না। একদম নিখোঁজ। কোনো রকম সন্ধান মিলল না। ঘৃণায় মনটা রি রি করে উঠে আমজাদের। তারপর কত না কষ্ট। মনে করতেই আমজাদের মনটা খারাপ হয়ে যায়।

আমজাদ ভিক্ষা করে। ভাইজান আমার বউ ক্যান্সারে আক্রান্ত। মরি যাবে। পুলাডা নি আমি কোনে গি উঠপো। সংসার আমার বানের জলে ভেসে যাবি। দুধের শিশু। বউয়ের চিকিৎসা দরকার। তার জন্য মেলা ট্যাকা লাগবি। দেন না ভাই। আমি বড্ড অসহায়। বুকে তার শিশু সন্তানকে আগলে রেখে কাঁদতে থাকে। বেশ টাকা পয়সা ওঠে সেদিন। কি করবে? তার সন্তানের জন্য সামান্য খাবার কিনে বাকি টাকার ড্রাগ নেয় আমজাদ। তারপর বাপ ব্যাটা পড়ে থাকে বিছানায়।

আনু কথা বলতে শিখেছে। আনুর মুখে বাপ ডাক শুনতে ভালো লাগে আমজাদের। আমজাদ ভাবে ছেলে বড় হলে নিশ্চয় বাপের নাম রক্ষা করবে। তার বাপ যেমন ভিক্ষা করায় পারদর্শী ছেলেও হয়তো সেরকম হবে। আমজাদ তার ছেলেকে শেখাতে থাকে কিভাবে অভিনয় করে মানুষের কাছে টাকা চাইতে হয়। কিন্তু ছেলে তার কিছুই বোঝেনা।

আমজাদের বয়স বেড়েছে। বেড়েছে কথা বলার স্পৃহা। কথায় তার উপার্জনের একমাত্র মূলধন। এখন আর আমজাদ আগের মতো বলে না যে তার বউয়ের ক্যান্সার। আসলেই তার বউ টউ কিচ্ছু নাই তো ক্যান্সার আসবে কোত্থেকে। যাকগে, তার হাত পায়ের পচন ধরার কারণে তাকে মিথ্যা বলতে হয় না। এখন সে সত্য বলে। ভাইজান ভীষণ যন্ত্রণা। হাতে পায়ে পচন ধরিছে। চিকিৎসার জন্য ট্যাকার দরকার, দ্যান না ভাই। আমজাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে কেউই তাকে ফেরাতে পারে না। আমজাদ টাকা নেয় ঠিকই অথচ চিকিৎসা করায় না।

আজকাল আনুও দারুণ ভিক্ষা করে। ছেলেটা বাবার চাইতেও বড় অভিনেতা। সিনেমা করলে দারুণ করতো। আজকাল অভিনয়ের উপর পৃথিবী চলছে। অভিনয়ে যে যত দক্ষ ক্ষমতা তার তত বেশি। আনু মায়ের ক্যান্সারের কথা বলে  ভিক্ষা করে। কাঁদে। ভাইজান আমারে একটু ভিক্ষা দিয়েন। মায়ের ক্যান্সার হয়িছে। মেলা ট্যাকা লাগবি। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। দ্যান না ভাই। ছেলেটার দারুণ প্রতিভা। আসলেই কি আনু অভিনয় করে কাঁদে। না কি তার মায়ের অনুপস্থিতির ব্যথা অনুভব করে সত্যি সত্যিই কাঁদে। থাক সে কথা, সে যেভাবেই কাঁদুক না কেন টাকা পয়সা তার ভালোই ওঠে। সেই টাকা পয়সা নিয়ে বাপ ব্যাটা উল্লাস করে। আমজাদ ড্রাগ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সে জরিনাকে দেখতে পায়। জরিনা আর আমজাদ দুজনে ট্রেনের একই বগিতে ভিক্ষা করছে। জরিনার কোলে একটা শিশু। সে কি আনু না কি অন্য কেউ ঠিক চিনতে পারে না আমজাদ। অবাক ব্যাপার জরিনা কোল থেকে তার সন্তানকে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। ঘুমের মধ্যেও চমকে ওঠে আমজাদ। হঠাৎ একটা কন্ঠস্বর শুনতে পায়। বাবা, ও বাবা, ঘুমায়ে পড়িছ না কি। আমজাদের চোখ তখন লাল। সেটা ভয়ে না আতঙ্কে ঠিক বুঝতে পারে না। বাপ শুয়ি পড় রাত হয়িছে। আনু কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে, গন্ধে ঘুম যে আসে না। চিকিৎসা করাও না ক্যানে?  ভীষণ রাগ হয়ে যায় আমজাদের। ছেলেকে বকবে না কী করবে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ইডাই আমার পেশা রে বাপ। চিকিৎসা করালি কি আয় আসবি?

আনুর শরীরে কালো কালো ফুসকুড়ি বেরিয়েছে। আস্তে আস্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটি রক্তের মতো লাল। এতে আনু খুশি। ভিক্ষা করার সুবিধা হল। লোকজনের কাছ থেকে ভালো ভিক্ষা পাওয়া যাবে। এতে আমজাদও বেশ খুশি। এসব ওদের কাছে রোগ নয় যেন আশির্বাদ। এধরনের রোগ যতই হয় ততই সুবিধা। শরীর দেখিয়ে প্রচুর ভিক্ষা পাওয়া যায়। আল্লাহ ওদের পানে চোখ তুলে তাকিয়েছে। ওরা এখন অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবে। আমজাদ মনে মনে চিন্তা করে আর মিসকি মিসকি হাসে। আনু চিন্তা করে, মায়ের ক্যান্সারের কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। এখন নিজের শরীর দেখিয়ে বাবার মতো ভিক্ষা করা যাবে। মানুষে বিশ্বাস করবে। টাকা দেবে।

আমজাদও ভালো আয় করে। কিন্তু ইদানিং তার আয় কমেছে। শরীরের দুর্গন্ধ বেড়েছে। আশে পাশে থাকা যায় না। লোকজন থাকতেও চায় না। আনুর উপার্জন বেড়েছে। কালো কালো ফুসকা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গন্ধ নেই। এটা প্লাস পয়েন্ট। যন্ত্রণা আছে। এ যন্ত্রণাকে কিছুতেই যন্ত্রণা মনে করে না আনু। এর স্বাদ অমৃত। এই যন্ত্রণাটুকু সহ্য না করলে আয় উপার্জন করবে কিভাবে? নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। ট্রেনে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয় আনুর। তিনি একজন ডাক্তার। বিনা পয়সায় আনুকে চিকিৎসা দিতে চেয়েছেন। বিকেলে চেম্বারে দেখা করতে বলেছেন। সে দেখা করার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছে। আনু ভাবে এভাবে তার রোজগার বেড়েছে। তাছাড়া বাবার আয় উপার্জন এখন কম। রোগ সেরে গেলে তার আয় রোজগার কমে যাবে। আনু সিদ্ধান্ত নেয় কোত্থাও যাবে না সে। এমন কি ফ্রি চিকিৎসার কথা বাবাকেও বলবে না।

আমজাদ কিছুটা উদ্বিগ্ন। এ প্রথম সে কারো জন্য এতটা উদ্বিগ্ন হল। তার স্ত্রী চলে যাবার সময়ও এতটা উদ্বিগ্ন হয়নি। কারণ তার ছেলে এখন যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদছে। সারা শরীরে ব্যথা। যন্ত্রণা। আনু শুধু বলে, বাবা গা হাত পা টাঁটায়। উঠতে বসতে পারি না। আমজাদ ছেলের শরীরে হাত রাখে। ব্যথা। যন্ত্রণায় বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না। আমজাদের কাছে টাকা নেই। তার শরীরও অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। এক হাত, এক পা প্রায় অবশের পথে। টাকার অভাবে ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারছে না। আমজাদ সারাজীবন মিথ্যা বলে মানুষের কাছে ভিক্ষা করেছে। আজ দিন এসেছে তার পুরোপুরি সত্য বলার। সত্য বলে ভিক্ষা করার। সে আনুকে স্টেশনের এক পাশে বিছানা পেতে ফেলে রাখে। চিৎকার করে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে ভিক্ষা করে। কেউ ভিক্ষা দেয় কেউ দেয় না। অন্য ভিক্ষুকেরা ভাবে আমজাদ এবার নতুন ধান্দা শুরু করেছে। আমজাদের সত্যিকারের কান্নাকে তাদের কাছে অভিনয় বলে মনে হয়। একজন তো বলেই ফেলে, কি মিয়া এম্নি কইরে তো আজ ম্যালা টাকা আয় করলে। কী করবা এত ট্যাকা দি? এই কথা আমজাদের মনে কাটা দেয়। অসহ্য লাগে। আজ সত্যিই সে অসহায়। আনু শুয়ে শুয়ে এখনো চিৎকার করছে। হঠাৎ সেই ডাক্তারের কথা মনে পড়ে। ডাক্তার তাকে পূর্ণ চিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছিল। কী যেন ডাক্তারের নাম? ভূলে গেছে। ঠিকানাটা? কিছুতেই মনে করতে পারে না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

আনু এখন হাসপাতালে। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সে পরিষ্কার যমদুতের ডাক শুনতে পায়। যমদুত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। হঠাৎ করেই তার মায়ের জন্য বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। ইচ্ছে করে মাকে দেখতে। আচ্ছা তার মা কেমন ছিল দেখতে? প্রশ্নটি তার মনকে আরও বিষিয়ে তোলে। ইশ! একবার যদি তাকে দেখতে আসতো। আচ্ছা মা কি জানে অসুখের কথা? অজানা অভিমানে তার হৃদয়ে আজ ঝড় উঠেছে। সে ঝড়ে লন্ড ভন্ড হয়ে যেতে চাইছে সবকিছু। হার্টবিটটা ধুপ ধাপ করে বাঁজতে থাকে। নাকের পাজর দুপাশ ঘন ঘন ফুলে ওঠে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। হঠাৎ চোখের পাতা দুটি বুজে আসে।

আমজাদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভিক্ষা করে। অবশ পা তার চলতে চায় না। তবু তাকে ভিক্ষা করতেই হবে। জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে হলেও করতে হবে। ছেলেকে তার বাঁচাতে হবে। ডাক্তার বলেছে দুটো কিডনিই নষ্ট। শরীরের মধ্যে ঘা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক টাকা প্রয়োজন। বাঁচার আশংকা কম। আমজাদ তার গন্ধ শরীর নিয়ে ছুটতে থাকে এদিক ওদিক। তাকে দেখলেই সকলে দূরে সরে যায়। ভিক্ষা সে খুব একটা পায় না। তার এতদিনের অভিজ্ঞতা আজ কোথাই গেল? আমজাদ তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ফিরে আসে হাসপাতালে।

হাসপাতালের করিডোরে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আনু। মৃত্যু যন্ত্রণা। চোখ বুজে পড়ে আছে। আমজাদ তার সন্তানের মাথাটা তার পঁচা গন্ধ পায়ের উপর তুলে নেয়। আনু তখন ঘোরের মধ্যে। ক্রমেই চোখে তার অন্ধকার নেমে আসে। আর বেশি সময় নেই। আনু বিড় বিড় করে বলতে থাকে। ভাইজান আমারে একটু ভিক্ষা দিয়েন। মায়ের ক্যান্সার হয়িছে। মেলা ট্যাকা লাগবি। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। দ্যান না ভাই। আনুর গোঙানো অস্পষ্ট কন্ঠস্বরও যেন আমজাদ পরিষ্কার শুনতে পায়। তার চোখে আজ যেখানে আক্ষেপের ছাপ, আনুর চোখে সেখানে ঘোর সন্ধ্যা। ক্রমেই আবছা থেকে আরও আবছা হয়ে আসে সবকিছু।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu