দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

একটি বিয়ের গল্প – সাজ্জাদ মোহাম্মদ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রিংকীর বিয়েটা ভেঙে গেল।

আকরাম চাচার একমাত্র মেয়ে রিংকী। সবে মাত্র ইন্টার পাশ করে অনার্স ভর্তির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল সে। এরই মধ্যে মেয়ের জন্য বিয়ের পাত্র দেখতে শুরু করে দিলেন আকরাম চাচা। যেনতেন পাত্র নয়, একমাত্র মেয়ের জন্য ইঞ্জিনিয়ার না হলে মেজর টাইপের পাত্র খোঁজা শুরু করলেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ার, মেজর ছাড়া অন্য কাউকে মেয়ে জামাই ভাবা আকরাম চাচার কল্পনারও বাইরে।

হালি খানেক ঘটকের আসা যাওয়া শুরু হলো। ঘটক মোতালেব ওরফে মতু মিয়া একবার সুদর্শন লম্বা ফর্সা এক ছেলে নিয়ে হাজির হলো আকরাম চাচার বাড়িতে। ছেলে এসেছে মেয়ে দেখতে । বসার ঘরে বসানো হলো ছেলেকে। ঘটক মতু মিয়া খুশিতে গদগদ। পান খায় আর মনে মনে ভাবে, ‘পাত্র হিসেবে নায়ক টাইপের যে ছেলে নিয়ে আসছি– এবার পছন্দ না করে যাবে কই?’

আকরাম চাচা ছেলের ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন।

‘তো বাবাজির নামটা জানি কি?’

‘জ্বি, মোসলেম। মোসলেম উদ্দিন।’

মতু মিয়া তর্জনীর মাথায় লেগে থাকা চুন বিশেষ ভঙ্গিতে মুখে ঢুকিয়ে আকরাম চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নামটা অতি সুন্দর। কি বলেন ভাইজান?’

‘মতু মিয়া, তুমি চুপ থাকো। মেয়ের জন্য তুমি ছেলে নিয়ে আসছো। ছেলের সাথে কথা বলব আমি, এর মধ্যে তুমি আসবা ক্যান? পুরা এক বিরা পান আনছি, তুমি মজা করে পান খাও।’

আকরাম চাচা ছেলের দিকে তাকায়, বলে, ‘তো বাবাজি, তুমি কিছু মনে করো নাই তো?’

‘জ্বি না।’

‘খুব ভালো। তো তোমার আব্বা-মা আছেন তো?’

‘জ্বি, আল্লায় রাখছেন।’

‘যাক। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তো, চাকরি-বাকরি কি করো?’

‘জ্বি, আমি ব্যাংকে চাকরি করি।’

আকরাম চাচা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে গিলে ফেলেন। তারপর মতু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মতু, তুমি মিয়া, খালি প্যাচপ্যাচ করে পান খাওয়া শিখছো, ঘটকালি শিখ নাই!’

মতু মিয়া মুখে পান গুজতে গুজতে বলে, ‘সুন্দরের কথা কইছেন। সুন্দর নিয়া আইছিতো। ছেলে মাশাআল্লাহ্ রাজপুত্তরের মতো!’

‘আরে মিয়া, তোমারে কই ইটপাথর, তুমি আনো কলম খাতা! তুমি মিয়া ঘটকালি ছাইরা কলম খাতার দোকান দাও!’

আকরাম চাচা এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তো বাবাজি, তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না। তোমার চেহারা আমার পছন্দ হইছে। তবে, নামটা একটু বেমানান। ব্যাংকের চাকরি খুব ভালো চাকরি। কিন্তু, বাবাজি ব্যাংকের চাকরি করা ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। যেহেতু এইখানে বিয়ের ব্যাপার নাই, সেহেতু মেয়ে দেখার পর্ব এইখানেই শেষ।’

ঘটক আসে ঘটক যায়। ঘটকের সাথে ছেলেও আসে। নাস্তা পানি খায়। চলেও যায়। আসা যাওয়া, নাম্তা পানি খাওয়া চলতেই থাকে। মেয়েকে দেখানো হয়না। ছেলে পছন্দ হয়, পরিবার পছন্দ হয়, বাড়িঘর পছন্দ হয় কিন্তু ছেলের কর্ম পছন্দ হয়না আকরাম চাচার।

আকরাম চাচার বড় ভাই মোকারেম চাচা ঠান্ডা টাইপের মানুষ। যে কোনো অবস্থা তিনি ঠান্ডা দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন। রিংকীর বিয়ের ব্যাপাটাও তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন ঠান্ডা দৃষ্টিতে। এই ঠান্ডা মানুষটা আর ঠান্ডা থাকলেন না। গরম হয়ে গেলেন। আগুন গরম।

এক সকালে গটগট করে তিনি ঢুকলেন আকরাম চাচার বাড়িতে। মোটা গলায় ডাকলেন, ‘আকরাম আলী বাড়ি আছো? থাকলে একটু কষ্ট করে বাইরে আসো।’

ডাক শুনে মাথায় ঘোমটা টেনে বেরিয়ে আসেন রিংকীর মা সামসুন চাচী। পুরো নাম সামসুন্নাহার। চাচী তার চিকন গলায় বলে, ‘ভাইজান ঘরে আসেন।’

‘ঘরে বসব না। চেয়ার দেও বাইরেই বসি।’

বাইরে চেয়ার নিয়ে আসা হয়। এরই মধ্যে আকরাম চাচাও ঘুম ঘুম চোখে বাইরে আসেন। বলেন, ‘ভাইজান, তুমি এত সকালে?  তো বাইরে ক্যান? ঘরে আসো।’ এরপর সামসুন চাচীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তো, তোমার কোন কান্ডজ্ঞান নাই? ভাইজানরে বসতে দিছ বাইরে?’

মোকারেম চাচা মোটা গলায় বলেন, ‘ঘরে বসার দরকার নাই। কথা যা বলার এইখানে বসেই বলি। বসো। আমার মুখোমুখি হয়ে বসবা।’

আকরাম চাচা কিছু বোঝে না। ভাবেন, হঠাৎ করে ভাইজানের কি হইলো? তারপর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেন, ‘মুখোমুখি বসছি। তো, ভাইজান কি কথা?’

‘রিংকী মামনির বিয়ে ঠিক করছো?’ মোকারেম চাচা রিংকীকে প্রচন্ড ভালবাসেন। ভালবেসে বলেন রিংকী মামনি।

‘না। ঠিক করি ক্যামনে, মেজর সমস্যা! ঘর মেলে, কিন্তু বরই মেলে না! ছেলে পাই না।’

‘মিলবে ক্যামনে আর পাবাই বা ক্যামনে? কয়টা টাকার মালিক হইছো। বাড়িটা তাজমহল বানাইছো। এখন ভাবছো, তোমার মেয়ের জন্য ইঞ্জিনিয়ার, মেজর দাঁত মাজতেছে।  ইঞ্জিনিয়ার খোঁজ? মেজর খোঁজ? তা ইঞ্জিনিয়ার, মেজর কি ব্যাংকের বুথে থাকে? কার্ড ডুকাবা আর বের করবা?’

আকরাম চাচা মাথা নিচু করেন। আস্তে করে বলেন, ‘একমাত্র মেয়ে আমার!’

‘আকরাম আলী, মেয়ে খালি তোমার একার না-আমারও। পানি অনেক গড়াইছে, আর না। মেয়েটার দুর্নাম হইছে। এইবার বাড়িতে চুপ করে বসে থাকো। সাতদিনের মধ্যে রিংকী মামনির বিয়ে দিয়া তারপর তোমার সাথে কথা।’

মোকারেম চাচা চেয়ার থেকে উঠে পরে। ডান হাতে লুঙ্গির গোছা ধরে গটগট করে বেরিয়ে যান আকরাম চাচার বাড়ি থেকে।

রিংকীর ছেলে ভাগ্য খুবই ভালো বলা যায়। সাতদিনের আগেই মোকারেম চাচা তার মামনির জন্য যে ছেলে ঠিক করলেন-তাতে রীতিমত টাসকি খেয়ে গেল সবাই। লম্বা ফর্সা নায়কের মত চেহারা। কলেজ প্রফেসর। সবাই বলল, ‘বাহ্! ছেলে কী সুন্দর, রাজপুত্র। এতদিন খালি খালি নাটক হইছে। কাম হয় নাই।’

মোটামুটি অনানুষ্ঠানিক ভাবেই এনগেজমেন্ট হলো। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। রঙিন আলোয় সাজানো হলো আকরাম চাচার বাড়ি। আনন্দমুখর পরিবেশ। আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজনে ভরতে শুরু করল বাড়ি। আকরাম চাচাও এই অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ার মেজরের কথা ভুলে গেলেন। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায়। সে কি অবস্হা!

বিয়ের দুদিন আগে ভেস্তে গেল সব। রঙিন আলোয় সাজানো বাড়িটায় আর আলো থাকলো না। আনন্দমুখর পরিবেশ ভারি হয়ে গেল। আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা কমে গেল। খবর এলো, ছেলে এই বিয়েতে রাজি না। মেয়ে তার ঠিকঠাক পছন্দ হয়নি। সুতরাং, রিংকীর বিয়েটা ভেঙে গেল।

শুধু রিংকীর বিয়েটা ভাঙলো না সাথে ভেঙে পড়লো দুটি পাহাড়ও। একটা পাহাড়ের নাম আকরাম আলী আর একটার নাম মোকারেম আলী। দুজনের এমন অবস্থা হলো যে, বাড়ি থেকে বেরানোই বন্ধ করে দিলেন।

সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়ল রিংকী। পড়ারই কথা। ঠিক হয়ে যাবার পর একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা আমাদের সমাজ যে ভাল চোখে দেখেনা-এটা বোঝার মত যথেষ্ট বয়স রিংকীর হয়েছে।

রিংকীর কারণে আকরাম চাচার বাড়িতে মাঝে মাঝে ডাক পড়ে আমার। সেটা হয় রিংকীর না হয় চাচীর, মানে-রিংকীর মা’র পক্ষ থেকে। প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, এই ডাকের ব্যাপার নিয়ে বলতে হলে একটু পিছনে যেতে হবে। চলুন, যাওয়া যাক।

ক্লাস সেভেন থেকে আমি আর রিংকী এক স্কুলে পড়তাম। প্রাইভেট টিচার, তাও এক। রিংকীর সুবিধার কারণে ওদের বাড়িতে গিয়েই প্রইভেট পড়তে হতো আমাকে। এভাবেই এইট নাইন টেন। আর আমি হয়ে গেলাম রিংকীর বন্ধু। আর একটা ব্যাপার, সেটা হলো-মাঝে মাঝে ও কিছু জিদ ধরে বসতো। বাড়ির কারো কথাতেই যেটা বুঝত না। কি কারণে জানি আমার এক কথাতেই চুপ হয়ে যেত। আমি ওকে কোনদিনই বান্ধবী না ডাকলেও আমাকে বন্ধু ডেকে ডেকে আমার নামটাই প্রায় ভুলে গেল সে। এই ব্যাপারটা বুঝলাম তখন, একদিন যখন দেখলাম-কলম কামড়িয়ে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘কিরে, ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’

আমাকে অবাক করে দিয়ে রিংকী বলল, ‘বন্ধু, তোর নামটা জানি কী!’

ক্লাস নাইনের কথা। দ্বিতীয় সাময়িকীর খাতা দিল। রিংকী ইংরেজীতে আমার থেকে দুই নম্বর কম পেল। ডাক পড়ে গেল আমার । রিংকীর ছোট ভাই আবু সায়েম হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের বাড়িতে গিয়ে বলল, ‘রনি ভাই, আপা তোকে ডাকে।’ বেশির ভাগ সময় সায়েমকে দিয়েই ডেকে পাঠাতো বলে আমি ওর নাম দিয়েছিলাম -‘ডাকপিয়ন ‘।

গেলাম। রিংকীকে বললাম, ‘ডেকেছিস।’

‘ডেকেছি।’

‘তো, কেন?’

‘খবরদার বন্ধু ! আব্বার কথা নকল করবি না। ফাজিল। ইংরেজীতে কত পেয়েছিস?’

‘সত্তুর।’

‘বন্ধু, আমার আটষট্টি কেন? দুই নাম্বার কই গেল? সবই এক, নাম্বার দুই রকম ! আটষট্টি-সত্তুর!’

‘খাতা চেক করছিস?’

‘করিনি।’

‘ভাত খেয়েছিস?’

‘হু বন্ধু।’

‘খেতে পারিস।’

রিংকী চুপ করে থাকলো। বলল, ‘বন্ধু তুই চেক কর দে।’

চেক করলাম। দুই জায়গায় লাল কালি দিয়ে দুইটা গোল্লা! বানান ভুল! ‘জার্নি বাই বোট’ না লিখে লিখেছে- ‘জানি বাই বোড’!

আবার একদিন ডাক পড়ল। চাচী বকাবকি করেছে এজন্যে রাত থেকে ভাত খায়নি। আমি বললাম, ‘চাচী, ভাত নিয়ে আসেন। দুজনের জন্যেই আনেন। আমিও খাবো, ক্ষুধা পাইছে।’

‘বন্ধু, আমি খাব না।’

‘খাবিনা?’

‘না।’

‘আচ্ছা, থাক। আমি গেলাম।’

আমি বসা থেকে উঠে হাটতে শুরু করি। রিংকী বলে, ‘দাড়া। আমি ভাত খাবো।’

আবার একদিন ডাক পড়ল। গেলাম। ‘কেন ডেকেছিস?’

‘বন্ধু, একটা ফুল এঁকে দে। ওয়ালমেট বানাবো।’

আমি ফুল এঁকে দেই। রিংকী ওয়লমেট বানায়। সেই ওয়ালমেটের প্রদর্শনী হতো সারা পাড়ায়। সবাইকে দেখিয়ে বলত, ‘আমি বানাইছি। ছবিটা আঁকছে আমার বন্ধু। সুন্দর না?’

যাহোক, বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর রিংকীদের বাড়ি থেকে ডাক এলো। সায়েম এসে বলল,’ভাই, মা তোকে ডাকে।’ গেলাম। রিংকী যে কি রকম ভেঙে পড়েছে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। চোখ মুখের সেকি অবস্থা। চাচীর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘ঘটনা কি?’

‘কিচ্ছু খায় না বাবা। সারা রাইত ঘুমায় না।’

রিংকী বলে, ‘রনি, সবাইকে বাইরে যেতে বল। তোর সাথে আমার কথা আছে।’

আমি অবাক হই। কত বছর পর রিংকী আমাকে নাম ধরে ডাকলো?

আমি বলি, ‘চাচী, বাইরে যান। সায়েম তুইও যা।’ দুজনেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি বলি, ‘বল, কি কথা?’

রিংকী কেঁদে ফেলে। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। বলে, ‘কিছু না। আমাকে ঘুমের ওষুধ এনে দিবি? না ঘুমালে আমি মরে যাবো। আমি মরে গেলে আমার আব্বাকে বলিস-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মেজর দিয়ে কবরটা একবার জিয়ারত করে নিতে। রনি, তুই চাকরি করবি কবে?’

আমি কিছু বলি না। উঠে পড়ি। এত বছরে এই প্রথম রিংকীর জন্য আমার মায়া হলো। কেন, কে জানে!

বিকেলে ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে রিংকীদের বাড়িতে গেলাম চাচীকে বললাম দুধ বেশি করে কড়া লিকারের দুকাপ চা বানাতে। রিংকীকে বললাম, ‘এই নে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেল।’

চাচী চা বানি আনে। আমি চা’তে চুমুক দিয়ে রিংকীকে বলি, ‘পুরো চা’টা খেয়ে ফেল।’

চোখ ছোট হতে থাকে রিংকীর। শুয়ে পড়তে পড়তে বলে, ‘রনি, একটা গান শোনাবি?’

‘কি গান।’

‘ওই যে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়…’

আমি গাইতে শুরু করি–

‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়

               বন্ধুয়ারে, করো তোমার মনে…’

রিংকী বলে, এটা বাদ দে- ‘সুয়াচান পাখি– গানটা গা।’

আমি আবার গাই–

                        ‘সুয়াচান পাখি আমার

                             সুয়াচান পাখি

                       আমি ডাকি তাচে তুমি

                            ঘুমাইছো নাকি…’

গান শেষ করতে পারি না। রিংকী ঘুমিয়ে পড়ে।

দুদিন পরের কথা।

সকালে যে সংবাদটা শুনতে পেলাম, তাতে রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। শুধু আমি না-অবাক হলো পাড়াশুদ্ধ মানুষ।

সংবাদটা হলো-গত রাতে কোনো রকম আয়োজন, সাড়া শব্দ ছাড়াই রিংকীর বিয়ে হয়ে গেছে। আকরাম চাচা আর মোকারেম চাচার মান সম্মান নাকি তিস্তার পানিতে ডুবে যাচ্ছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে এই বিয়ের ব্যবস্থা।

তথ্য যা পেলাম, তা হলো-পাত্রের নাম আবদুল খলিল মিয়া। দাখিল পাশ। পৈত্রিকসূত্রে প্রচুর জমিজামার মালিক। টাকা পয়সাও আছে অনেক। লম্বায় রিংকীর থেকে তিন ইঞ্চি খাটো। গায়ের রং শ্যামা কালো’র মাঝামাঝি। আর যাই হোক, এমন ছেলেকে সুন্দর বলা যায় না। পাড়ার লোকেরা আড়ালে আড়ালে বলতে লাগলো, ‘হায় হায়! এত সুন্দরী মেয়েটার কপালে শেষ পর্যন্ত এই জুটলো?’

আমি মনে মনে ভাবলাম-যাই হোক-রিংকীর বিয়েটাতো হলো। সবই খেলা। এই খেলার পরিকল্পনা হয় উপর থেকে। আমাদের করার কিছু নেই।

রিংকীর বিয়ে হয়ে গেছে বারো বছর হলো। বারো বছর অনেক সময়। অনেক কিছুই বদলে গেছে এই দীর্ঘ সময়ে।

আমিও বিয়ে করে ফেলেছি। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পেশাগত কারণে ঢাকায় থাকি। এবার ঈদে বাড়ি গেলাম। সৌভাগ্যক্রমে রিংকীর সাথে দেখা হলো। ওর মেয়েকে দেখলাম। মায়ের ফটোকপি। রিংকী বদলে গেছে। পুরোদস্তুর একটা মহিলা। আমি বললাম, ‘ভালই আছিস, না?’

রিংকী ওর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ খুলতে খুলতে বলল, ‘আর ভালো! ভাল থাকার জন্য জীবনে একজন মানুষ দরকার, ছোট্ট হলেও যার একটা আঁচড়ের দাগ হৃদয়ে থাকে।’ বলতে বলতে রিংকী একটা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বলে, ‘এই নে-এটা তোর জিনিস। বিয়ের রাতে তোকে দেয়ার জন্য লিখেছিলাম। দেয়া হয়নি।’

আশ্চর্য! বিয়ের রাতে বাথরুমে গিয়ে হারপিক খেয়ে মরতে চেয়েছিল মেয়েটা? সাহস পায়নি জীবনটা তাতে ছোট হয়ে যাবে বলে। বিয়ের রাতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল ভাল লাগার মানুষের সাথে? সেটা করেনি আকরাম আলী আর মোকারেম আলী তাতে আরো ছোট যাবেন তাই। হারপিক খেয়ে মরার পরিকল্পনা, ভাললাগার মানুষের সাথে পালানোর পরিকল্পনার কথা রিংকী আমাকে জানালো বারো বছর পর? আজব!

আমি ভাবি, মেয়েরা কী জিনিস! তাদের কত রূপ!

 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu