ইকবাল আজাদ

একটা সিটের জন্য

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে। কালো মেঘগুলো যেন পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। দক্ষিনা বাতাস ঝাপটে পড়ছে অবয়বে। এত কাছে থেকেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার সময় নেই আজ। বাসা থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়েছে রুদ্র। কোচিং-য়ে যেতে হবে। শরৎকালে কখনো কখনো বর্ষার মতো বৃষ্টি হয়। একটু পথ এগুতেই বর্ষাময় শরতের বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।

বাসে ওঠার আগে আরেকবার গোসল হয়ে গেল। বাসে উঠেই হাফ ছেড়ে বাচঁলো ছেলেটি। একটা সিট পাওয়া গেছে। সর্বসাধারণের মতে, ভার্সিটি এডমিশন কোচিংয়ের জন্য ফার্মগেট ব্রাঞ্চগুলো একটু বেশি ভালো। তাইতো মফস্বল থেকে শহরে পাড়ি জমায় রুদ্র। গ্রামে বেড়ে ওঠা রুদ্রের বাসের সাথে তেমন পরিচয় নেই। ঢাকায় আসার আগে চড়া হয়েছে বার দুয়েক। কেমন যেন বমি বমি ভাব হয়। দাঁড়িয়ে থাকলে খুব মাথা ঘুরায়। একবার তো বাসে মাথা ঘুরে পড়েই যায়। জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করে এক আন্টির কোলে। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই রুদ্র আজও দূর থেকে অপরিচিতা আন্টিকে কৃতজ্ঞতার প্রণাম জানায়।

বৃষ্টি ক্রমশ বেড়ে চলছে। আবছা হয়ে গেছে বাইরের দৃশ্যগুলো। বজ্রপাতের শব্দে কম্পিত হয় সমগ্র ভূতল। রুদ্র অনেক ভয় পায় বজ্রপাতকে। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে অনেকটা মন্থর গতিতে চলছে বাস। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে পানি থৈ থৈ করছে রাস্তায়। হাত দিয়ে জানালা ঘষে স্পষ্ট দেখতে পায় ছেলেটি। রাস্তা দিয়ে যেন নৌকাভ্রমণ করা যাবে।

স্মৃতিপটে ভেসে আসে গ্রামে নৌকায় চড়ার দৃশ্য। মাছ ধরা, শাপলা-শালুক কুড়ানো, দুপুরের ঘুম চুরি করে অন্যের গ্রামে নৌকায় করে ঘুরতে যাওয়া, কত দুরন্তপনা মিশে আছে এই নৌকাকে ঘিরে তার কী আর হিসেব আছে! ঝুম বৃষ্টির ফাঁকে ফার্মগেট পৌঁছায় বাস। কাকভেজা হয়ে কোনোমতে ক্লাসে প্রবেশ করে রুদ্র। ‘যত কষ্টই হোক ক্লাস মিস করা যাবে না’ বাবার এই কথায় সে সর্বদা মেনে চলে। তার আজ খুব ইচ্ছে করছে দুই হাত প্রসারিত করে আবার বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।

ভেজা কাপড় পরে ক্লাস করে ছেলেটি। ক্লাস টেস্টের সর্বোচ্চ আজ তার দখলে। ক্লাসে বরাবরই মনোযোগী সে। কিন্তু, বৃষ্টি আজ তার মনযোগে ফাটল সৃষ্টি করেছে। হৃদয় হরণ করেছে আজকের ঝুম বৃষ্টি।

টানা দুই ঘণ্টা পর ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত বেরিয়ে পরে শিক্ষার্থীরা। রাস্তায় বেশ পানি জমেছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি থেমেছে। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে রুদ্র। খুব দ্রুত বাসায় যেতে হবে। অনেক পড়তে হবে আজ।

অপেক্ষার প্রহর বড্ড কষ্টকর। কষ্টকে সঙ্গী  করেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। কিন্তু বাস আসে না। একটা আসছে তবে খুব ভর্তি হয়ে।  ঢোকার সাধ্য নেই তাতে। দাঁড়িয়ে যেতে পারবে না সে।

একটা সিট দরকার।

অগত্যা কোন উপায় না পেয়ে সামনে আগায় রুদ্র।  বেশি দূর যেতে পারে না। রাস্তায় অনেক পানি। শুধু পানি নয়, বুড়িগঙ্গার পানির ন্যায় ময়লা মিশ্রিত অনেক নোংরা পানি। বাসের সিট পেতে সামনের স্টপেজে যেতে হবে। এই নোংরা পানি পায়ে গলাতে হবে। ভাবতেই শিহরিত হয় ছেলেটি। ছোটবেলায় কাদা পানিতে কত ফুটবল খেলেছে সে। একবার রাকিবের চোখে কাদা পানি ঢুকিয়ে খুব মার খেয়েছে মায়ের হাতে। কিন্তু সেই কাদা পানির সাথে এই পানির বিশাল ব্যবধান।

সাত-পাঁচ ভেবে ট্রাউজারটা কিছুটা উপরে তুলে পানিতে নেমে পড়ে রুদ্র। জুতা হাতে নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। জুতা ভিজলে যে জুতার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যাবে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের কত চিন্তা মাথায় করে চলতে হয় তা খুব ভাল করেই জানে ছেলেটি। রাস্তার পানিতেও নদীর মত স্রোত বহমান। ময়লা পানি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে।

হাঁটার মাঝে আজ অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। আচ্ছা, নরওয়ে দেশটা কেমন? সেই দেশে এমন ময়লা পানি নেই তাই না?

মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র কেমন? বৃষ্টি আসলে কি ওই দেশেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়?

আচ্ছা, বাংলাদেশ কি নরওয়ের মতো হতে পারে না? নরওয়ের মতো হলে কেমন হবে পরিস্থিতি? এসব ভাবতে ভাবতেই নিজেকে নরওয়ের মাঝে কল্পনা করে রুদ্র। সেখানে বাসের ১ টি সীট পেতে এত কষ্ট করতে হয় না।

ভাবতে ভাবতেই কাওরান বাজার পৌঁছে যায় রুদ্র। ময়লা পানিতেই পা ধুয়ে জুতা পরে নেয়। বিপরীত পাশ থেকে তার বাস খুঁজে পায়। দক্ষিণ পশ্চিম সিগনালে দাঁড়ানো। তাতে একটা সিট খালি আছে। উত্তেজিত হয়ে উঠে ছেলেটি। একটা সিট তার পেতেই হবে। মন চাচ্ছে পাখি হয়ে উড়ে গিয়ে সিটটাতে বসতে। কিংবা উসাইন বোল্ট হয়ে দৌড়ে গাড়িতে উঠতে।  কিন্তু ট্রাফিকের নিয়মের মাঝে ফেঁসে গেছে সে।

ফুট ওভার ব্রীজও নেই যে দ্রুত রাস্তা পার হবে। অসম্ভব অস্থিরতায় ভুগছে। কারন এই বাসে বাসায় যেতে না পারলে তার পড়ার অনেক সময় নষ্ট হবে। রাগে মাথার চুল টানতে থাকে। মুহূর্তেই কঠোর হয়ে ওঠে তার বাচ্চাসুলভ চেহারা। নির্বোধের মতো ট্রাফিক অমান্য করে একটা সিটের জন্য দৌড়ায় রুদ্র। একটা ব্যস্ত প্রাইভেটকার ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয় ছেলেটাকে। পেছন থেকে দূরপাল্লার একটা বাস মাড়াইয়ের কাজটা করে। রক্ত ছিটিয়ে পড়ে চতুর্দিকে। চোখের পলকে ঘটে যায় ঘটনাগুলো। ট্রাফিক উচ্চস্বরে বাশিঁ বাজায়। যন্ত্রদানবগুলো থেমে যায়। লোকজন সমবেত হয়। সবাই মিলে তাকে একটা সিট ঠিক করে দেয়। অসম্ভব সুন্দর একটা সিট। শুয়ে যাওয়ার মতো দীর্ঘ একটা সিট। একটা অ্যাম্বুল্যান্সের সিট।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu