জাহাঙ্গীর ডালিম

এই সময়

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রোদটা বেশ হেলে পড়েছে। কাঁধের গামছাটা দিয়ে ভালো করে কপালের ঘামটা মুছে নিল। জ্যৈষ্ঠ মাস অথচ আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। এই রিক্সা যাবেন? রিন রিনে কন্ঠে শুনে ফিরে তাকাল ফেলু মিয়া। দুটি মেয়ে একজন সাদা সালোয়ার কামিজ পরা, অন্যজন নীল।

কই যাইবেন?

নতুন বাজার। দূর-দূরান্ত রেস্তোরায়।

উঠেন।

কত দিব?

দিয়েন, সব সময় যা দেন।

পনেরো টাকা দিব।

কম হইয়া যায় গো মা। জ্যাম ঠেইলা যাওন লাগব। পঁচিশটা টাকা দিয়েন।

কিসের পঁচিশ টাকা। পনেরো টাকা দিয়ে রেগুলার যাই।

না, যামু না।

মেয়ে দুটো এগিয়ে গেল। ফেলু মিয়া শরীরটা ভালো না। গা-টাও কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। বাড়িতে ছোট মেয়েটার জ্বর। ওষুধ নিতে হবে, না হলে আজ আর বের হতো না সে। মেয়েগুলো মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সা নেই। নীল জামা ব্যস্তভাবে ঘড়ি দেখছে।

ফেলু মিয়া এগিয়ে গেল, উঠেন বিশ টাকা দিয়েন।

মেয়ে দুটো চোখাচোখি করল। তারপরে উঠে বসল। শুক্কুর মিয়া প্যাডেল মারতে শুরু করল। শরীর আর আগের মতো জোর নেই। বয়স এখন পঞ্চাশ। রোগ-শোক শরীরে ঘর বাঁধবে এটাই স্বাভাবিক।

এই দীপা… আমার না কেমন যেন লাগছে।

রিক্সায় ডানপাশে বসা মেয়েটা বলল, ধুরো! শোন, এত এক্সাইটেড হয়ে পড়িস না। আগে দ্যাখ ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। ভালো কথা, তুই তাকে চিনবি কী করে?

রাশেদ তো বলেছে নীল শার্ট পরে আসবে।

আচ্ছা! এই জন্য তুইও নীল জামা পরেছিস।

শোন, ফাজলামে করবি না।

কী জানি করে ছেলেটা?

কতবার বলব তোকে, ব্যাংকে চাকরি করে।

থাকে তো গাজিপুরে, তাই না?

হু।

গ্রামের বাড়ি কই রে?

আশ্চর্য। গ্রামের বাড়ি কোথায়, আমি কী করে বলব?

বাব্বা! ছয় মাস মোবাইল ফোনে প্রেম করলি! কথা বলতে বলতে রাতের পর রাত পার করে দিলি, অথচ তার সম্পর্কে কিছুই জানিস না।

কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ।

ফেলু মিয়ার খুব ক্লান্ত লাগছিল। ছোট মেয়েটার জ্বর। দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল।

তুই কি ছেলেটার সঙ্গে পাকাপাকি রিলেশন করবি?

যদি সেরকম ছেলে হয়।

আর আকাশের কী হবে?

ধেঁৎ ! ওটা তো ছিল টাইম পাস।

রিক্সা মাঝে মধ্যে জ্যামে পড়ছে, আবার চলছে। এই ছোট্ট শহরেও জ্যাম লাগে।

চাচা, বায়ে একটু রাকেন।

ফেলু মিয়া থামল। সাদা জামা নেমে পড়ল।

যাইরে।

এই দীপা… শোন। তুই প্লিজ আমার সঙ্গে আয় না?

মাথা খারাপ। আমার টিউশনি আছে না। তুই যা। কী সমস্যা?

কিন্তু…।

আরে বাবা, যা না।

আচ্ছা… বাই।

বাই।

ফেলু মিয়া আবার চলতে শুরু করল। পেছনে খুব সুন্দর একটা রিংটোন বেজে উঠল। মেয়েটা ফের সময় নিয়ে ফোন ধরল।

হ্যালো… আমি। আমি তো রাস্তায়… ঝর্নাদের বাসায় যাচ্ছি… একটা নোট আনতে হবে। আজ কী করে দেখা করব… আজ পারব না… খুব বিজি… না… না… তো… কালকে মাস্ট দেখা করব… হ্যা ঠিক আছে… আচ্ছা… রাখি… বাই।

রেস্তোরা এসে গেছে। বেশ সাইড করে রিক্সাটা দাড় করালো ফেলু মিয়া। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে নীল জামা ঢুকে গেল ভেতরে। ফেলু মিয়ার বেশ খিদে পেয়েছে। ফুটপাতের ছোট চায়ের দোকানটায় ঢুকল সে। কী খাবে ভাবছে। চায়ের সঙ্গে কী খাওয়া যায়? বিস্কুট নাকি পাউরুটি! দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ফেলু মিয়া সেই রেস্তোরার সামনেই আছে। জ্বর-জ্বর লাগছে, মন মতো প্যাসেঞ্জারও পায়নি। রেস্তোরার কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে সেই নীল জামার সঙ্গে নীল শার্ট পরা একটা ছেলে, ছেলেটা মেয়েটাকে একটা রিক্সা করে দিল। মেয়েটা চলেও গেল। নীল শার্ট এদিক-ওদিক তাকাল। একটা সিগারেট ধরাল। কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। তারপর এগিয়ে এল ফেলু মিয়ার দিকে।

এই বাসস্ট্যান্ড কত?

তিরিশ টাকা।

ছেলেটা দ্বিরুক্তি না করে উঠে বসল। ফেলু মিয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে প্যাডেল মারতে থাকল।

ছেলেটার ফোন এসেছে।

হ্যালো… আমিও… কই তুই?

ছেলেটা কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে।

হু… দেখা হয়েছে… আরে না… মোটামুটি… নীরার সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। না… না… আর ধেঁৎ প্রশ্নই আসে না…. আমি আজই আসছি… এই অমিত… তুই যেমন লোক, মিতু ফোন দিচ্ছে… আচ্ছা… হ্যাঁ… রাখি।

হ্যাঁ… মিতু… কেমন আছ তুমি?

আমি তো অফিস থেকে বের হলাম, বাসায় যাচ্ছি। তোমার জন্য…

ফেলু মিয়া কেমন হাঁপিয়ে গেছে। জ্বরটা বোধ হয় বেড়েছে। ধীর পায়ে সে প্যাডেল মারতে থাকে। রাস্তার দৈর্ঘ্য কি বেড়ে যাচ্ছে…?

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu