দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত
আবু হেনা মোস্তফা এনাম
আমাদের বয়সের ভেতর গ্রামে একটা পুকুরের জন্ম হলে আকাশের বিবিধ রং ছড়িয়ে পড়ে– কমলা, গোলাপি, নীল, লাল, সাদা, ছাইছাই; এবং তাদের ধ্বনিময় মেঘ। মেঘেরা বেড়ায় চাঁদে, পুকুরে। মেঘেরা হাঁটে বৃক্ষে, মাছের বুদবুদে। মেঘেরা পুকুরে চাঁদ নিয়ে এলে পুকুরের আয়নায় চাঁদের ছবি দেখতে দেখতে, জলে ভাসমান মেঘের প্রতিচ্ছায়ার ভেতর আমাদের জীবন দ্বৈত আত্মার ইন্দ্রজাল বিস্তার করে। আমাদের দ্বিতীয় আত্মা একটা চাঁদকপালি গজার মাছের ভেতর পুকুরের সবুজ শীতল জলের ছায়ায় সে ঘুমিয়ে থাকে, কচি শ্যাওলার ভেতর উড়িয়ে দেয় মেঘের বুদবুদ; তখন, মনে হয়, আমাদের গৃহ একটা পুকুর। আমরা গৃহের জলে সাঁতার কাটি, বেড়ে উঠি; মাছের সাথে আমাদের সাঁতার, বেড়ে ওঠা। মনে হয়, আমাদের বয়স একটা পুকুর, এইসব পুকুরের নিরন্তর চেতনা মাথার ভেতর উড়ে গেলে গ্রামের কিশোরীটিকে বিদ্যালয়ে যেতে দেখি; যে হয় পারভিন সুলতানা, অথবা সে হয়ত সুমনা আখতার; তখন, প্রতিদিন আমরা একটা উজ্জ্বল মৌরালা মাছের মতো লুব্ধ বিকেলের করোটির কাছে কিশোরীর ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকি; আর মাছের আঁশটে গন্ধ আমাদের গ্রামে বিকেলের ছায়াপ্রস্থানে মিশে যাচ্ছে ধীরে, গোপনে;
আমরা পুকুরের মৃদু জলতরঙ্গের ভেতর মেঘের নিরুদ্দেশ দেখতে দেখতে, মেঘের ভেতর পাখির লুকোচুরি দেখতে দেখতে, পাখির ডানায় গোধূলির গান দেখতে দেখতে আমাদের মুখ আর পুকুরের মৃন্ময় জলের ছায়ায় প্রবাহিত বয়সের টুকরো টুকরো ছবির ভেতর, একদিন, পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে হয়ত হেসে উঠতে দেখি; গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা নারীরা বলে, কিশোরী হয়ত হাসে, এবং তার বান্ধবীদের চোখের কটাক্ষে কী বলে; অথবা সে হাসে না, অথবা সে কিছু বলে না; তথাপি কিশোরীর হাসির ভেতর অনেক সৌন্দর্যকল্পনা সোনালি মাছ চঞ্চল হয়ে আছে; তখন, আমাদের বয়সের ভেতর পুকুরের জন্ম নৈসর্গিক হয়ে এলে জলতরঙ্গে ছায়াগুঞ্জরিত শ্যাওলা, রান্নাঘরের হলুদ, শুকনো লঙ্কা, দারুচিনি, এলাচের ঘ্রাণ আর গ্রীবা বাঁকা করে উড়ালে যাওয়া পাখিদের সাদা শরীর ছুঁয়ে মেঘ ছড়িয়ে যাচ্ছে। এইসব নিরুদ্দেশ মেঘ পুকুরের জলে টুপটাপ ঝরে পড়লে আমাদের দ্বিতীয় আত্মা গজারমাছ শ্যাওলার শিকড় বেয়ে পাতালপথের ভ্রমণে যায়– সেখানে জমা আছে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ। যার মাটির নিচের গোপন গৃহে– জমা আছে পৌরাণিক বাক্যের সমাহৃতি, হরপ্পা, প্রেম, মাছচাষ পদ্ধতি। যায় জলজ সংগীতের ধ্রুপদ আর চন্দ্রকলা নাচে। গজারের এইসব ভ্রমণে আমরা মাছচাষ শিখি; গজারের এইসব ভ্রমণ, নাচ আর বুদবুদের ভেতর একদিন গোপনে কেউ শত্রু হত্যার মন্ত্র পড়ে গজারের কানকোর তলায় বেঁধে দেয় লোহার তার; গজার বড় হতে হতে লোহার তার কানকোর নিচে এঁটে বসে, ধীরে ধীরে বিভ্রম আর গভীর যন্ত্রণার ভেতর রক্তের লোহিত আয়ুর ভেতর আছাড়িপিছাড়ি গজার হয়ত মরে যায়, অতঃপর পুকুরের জ্যোৎস্নায় সবুজ জলের বুদবুদে গজার ভেসে উঠলে আতঙ্কবিস্ফারিত চক্ষুকোটর ছিঁড়ে শত্রুর হৃৎপিণ্ড ঝড়াম করে আছড়ে পড়ে উঠোনে,
অথবা, হয়ত গজার মরে না, আমাদের দ্বিতীয় আত্মার গভীর বিস্ময় নিয়ে লুকিয়ে থাকে পাতালের মৃত্যুঅন্ধকারে; গজারকে আমরা দীর্ঘদিন আর খুঁজে পাই না, হারিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় আত্মার মৃত্যু ভেবে চোখে পিচুটি আর ঘুম ঘুম আলস্য নিয়ে আমাদের প্রথম আত্মা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে; অনেক অনেকদিন পর আমরা বিষণ্ণতার বাইরে এলে, হয়ত, বিদ্যালয়গামী কিশোরী পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে লক্ষ করি, তার পাখির ঠোঁটের মতো নাকে একটা ছোট্ট লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুলের চিকমিক কল্পনা করি। হয়ত পাথর বসানো নাকফুলের নিঃশব্দ লালের চিকমিকে গজারের মৃত্যুশোক ফিকে হয়ে আসে এবং তখন আমরা গৃহপুকুরে রক্তজবা ফুল উৎসর্গ করি; কাঁসার বাটি ভরে পেঁয়াজ, সবুজ লঙ্কা, চোখ জ্বালা করা সরষে তেলে চালভাজা খেতে খেতে গৃহের যাবতীয় আয়োজনের ভেতর আমাদের বয়স চলে যেতে থাকে, আমাদের বয়সের ভেতর গৃহপুকুরের সকল ছায়ায় মাছের বুদবুদ ফেটে পড়ে কমলা আকাশ, গোলাপি আকাশ, লাল আকাশ, সাদা আকাশ-ফুল ফোটে। আমরা এইসব বুদবুদের রংবেরঙের ফুল, ধ্বনি ও ছায়ার ঐন্দ্রজালিক ঘ্রাণের ভেতর ভ্রমরগুঞ্জনে ভরা পথের সংকেত ধরে শস্যক্ষেতে যাই, সেখানে লুব্ধ মেঘমালা উড়ে যেতে দেখে আমাদের মনে তখন চঞ্চল নদীর উল্লাস। নদীর সংগীত মেঘের নাচের ছন্দে বিস্তৃত হলে মনে হয়, জলের সীমানা কতদূর গেছে আমাদের জীবনে? যতদূর আমাদের হৃদয়ে মাছের আঁশটে গন্ধ; যতদূর আমাদের মেঘ প্রতিধ্বনির বিস্ময় নিয়ে, আমাদের প্রতীক্ষার ভেতর বিদ্যালয়কিশোরী পাখির ঠোঁটের মতো নাক নিয়ে, আমাদের গোপন প্রণয় নিয়ে সে হারিয়ে আছে; আমাদের বিস্ময় হয়ত এই কী যে, জলের ঝিলমিল রেখার সীমানা অসীম হয়ে উঠলে আমাদের গৃহপুকুরগুলো আর গৃহ থাকে না, গৃহের ভেতর মেঘ ঢুকে পড়ে; মেঘের বিবিধ রঙের ভেতর পাখিরা উড়ে আসে, পাখিরা উড়ে যায়। পাখিদের উড়ালে গৃহে আকাশের বিস্ময় আমাদের মুঠোর ভেতর আসে, বনের বিস্ময় আমাদের শরীরে খেলা করে; তখন, পাখি এবং মেঘের ধ্বনিপ্রতিধ্বনির ভেতর পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে না পেলে মনে হয়, কিশোরীদের জীবনের মধ্যে হয়ত অনেক রহস্যকল্পনা আছে; পাখির মতো, মেঘের মতো,
আমরা এইসব রহস্যের খোঁজে পুকুরপাড়ে অথবা মাছের আড়তের সামনের রাস্তায় মেঘের দিকে ফিরে বসে থাকি; আর গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা নারীরা বলে, কী রে ঢ্যামনাদের কাজকাম নেই, ম্যাগের পানে চেইয়ি বইসি বইসি কী দেখে! বলে আর তারা মৃদু হেসে গৃহের আড়ালে গেলে আমরা হাসি, অথবা দেখি মেঘের দিকে বনের পাখিরা গাছের আড়াল ছেড়ে লতাপাতার গৃহ ছেড়ে সন্ধ্যার মেঘ হয়ে যাচ্ছে। তখন, মেঘের বিস্ময়ের ভেতর বনের পাখিদের ধ্বনিময় উড়ালে কিশোরীর হাসির অস্ফুট শব্দ ভেসে গেলে মনে হয়, মেঘের ভেতর পুকুরপাড়ে আমাদের প্রতীক্ষার বিকেলগোধূলি মিশে আছে; তখন, আমরা পুকুরপাড়ে মেঘের ভেতর পাখিদের উড়ালের দিকে তাকাই; দেখি গাছের ছায়ায় পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতার হয়ত থামে, অথবা থামে না; হয়ত সে থামে গাছের পাতার ছায়ার ভেতর, অথবা থামে না; সে হয়ত থামে গাছের ফুলের ছায়ার ভেতর, অথবা থামে না; সে হয়ত থামে পুকুরের জলের ভেতর, অথবা থামে না; জলের উপর তার মুখের ছবি চাঁদ হয়ে ফোটে, চাঁদমুখ হাসে; অথবা সে হাসে না। আমরা, তখন, গাছের ফুলপাতার ছায়ার চারপাশে ঘুরি, আর মনে হয়, কিশোরী গাছের পাতা থেকে পাতার ছায়ার ভেতর, ফুল থেকে ফুলের ছায়ার ভেতর, জল থেকে জলের উপর ধীর মন্থর ছায়া হয়ে যাচ্ছে; তখন, তার গতি ধীর মন্থর হয়ে এলে আমাদের কৌতূহলের ভেতর পাখিরা ওড়ে, অথবা উড়ালই বা কেন,
পাখিরা ঠোঁটে পুকুরের জল নিয়ে উড়ে যায়, মাছ নিয়ে পালিয়ে যায়; বিদ্যালয়কিশোরীকে পাখি মনে হয়– পাখির ঠোঁটের মতো নাক নিয়ে সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়; পালিয়ে পালিয়ে পাখিরা বিন্দু বিন্দু জলকণা আকাশে ছড়িয়ে দিলে গ্রামের বিকেলে লুব্ধ মেঘ ভেসে বেড়ায়, মেঘ আমাদের শরীরে খেলা করে; আমাদের বিস্ময় লুপ্ত হয়, পাখিদের চমৎকার চালাকি ধরা পড়ে গেলে আমাদের মনে হয় কী যে, আকাশের মেঘ তহলে কি পাখির উড়াল নয়? তাদের ঠোঁটে লেগে থাকা সহস্র জলবিন্দু আর উজ্জ্বল মাছের সমাহার! মনে হয়, এইসব চতুর পাখি পুকুরচোর। পাখিরা হয়ত গৃহচোর। হয়ত মাছ চোর, হয়ত পাখিরা চুরি করে কিশোরীর বিদ্যালয়ে যাওয়া,
তখন, আমরা উড়ে যাওয়া মেঘের দিকে বিদ্যালয়কিশোরীর আসা-যাওয়ার পথের পানে তাকিয়ে থাকি– উড়ন্ত মেঘে উজ্জ্বল নক্ষত্র অথবা নৈশজোনাকিদের চঞ্চল ঝিকমিক আলোকম্পন ছাড়া কিছুই আমাদের চোখে পড়ে না। আমাদের চিন্তা হয়। ভয় হয়। পুকুরচুরির ভয়ের ভেতর আমাদের গ্রামের আলোবাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ ভেসে বেড়ালে আমরা পুকুরপাড়ে সারি সারি মাছের আড়তে উঁকি দিই; তখন হয়ত বিকেল, তখন হয়ত শরৎ, তখন হয়ত গ্রীষ্ম; আড়তদারেরা বরফগলা পানির ভেতর থেকে পচে গলে যাওয়া একটা-দুটো মাছ সন্ধ্যার পুকুরে ছড়িয়ে দিলে ছোট ছোট মাগুর পচাগলা মাছ খেয়ে ফেলে; আড়ৎদারেরা আমাদের ভয় শুনে হাসে, অথবা তারা বলে, ম্যাগের দিকে চেইয়ি বইসি বইসি সারাদিনমান কী দেখিস তুরা, কিন্তু আমরা ভয় জয় করতে পারি না। পুকুরচুরির ভয়ে, পুকুরের মৃত্যু ভয়ে লাইলন সুতার জালে পুকুর ঢেকে দিই, যেন জাল ছিঁড়ে চতুর পাখিরা পুকুরচুরি করতে না পারে, মাছ চুরি করতে না পারে; তবু গ্রামে পুকুরচুরি ঠেকাতে পারি না, তখন, আমাদের বয়স থেমে থাকে না; তখন, পাখির স্বভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো কিশোরীর চিন্তায় আমরা তার আসা-যাওয়া অথবা যাওয়া-আসার পথের দিকে দেখি, পুকুরপাড়ে অনন্ত গোধূলির ভেতর বসে থাকি; অথবা, এরূপ মাত্র;
গ্রামের লোকেরা কেউ কেউ পাখিদের পুকুরচুরির কৌশল শেখে গোপনে; আমরা জানতে পারি না এই কৌশলের জ্ঞান, আমাদের বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকে ষড়ৈশ্বর্যশালী মায়াময় পাখির প্রতিচ্ছবি চিত্রিত দেখি, কিন্তু পুকুরচুরির বাক্যমালা দেখি না; দেখি পুষ্পগন্ধের মধ্যে আঁকা পাখির নম্রনীল পালকের সরল রেখা, দেখি পুচ্ছনাচের উদ্ভিন্ন বর্ণচ্ছটা আর সংগীতের আনন্দ; এই সুযোগে আমাদের বসে থাকা আর বিদ্যালয়ের আনন্দ ও নির্মলতার ভেতর চোর ঢুকে পড়ে। চোরেরা শহর থেকে চুরির নতুন নতুন বিদ্যা আমদানি করে, ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে তারা শেখে দেশ-বিদেশের চোরদের বিবিধ জ্ঞান। চুরিবিদ্যায় সকলে পারদর্শী হলে পুকুরপাড়ে আমাদের বসে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে, সবসময় চুরি যাবার ভয়ে আমাদের বসে থাকার আনন্দ ফুরিয়ে আসতে থাকে– কোনো সুর নেই, ছন্দ নেই, ছায়া নেই, অভিজ্ঞতা নেই, নির্মাণ নেই, রং নেই, ছবি নেই, বিকেল নেই, মেঘ নেই, পাখি নেই, ফুল নেই, পাতা নেই, সবুজ নেই, লাল নেই, হলুদ নেই, শস্য নেই…
পুকুরপাড়ে বসে থাকার আনন্দ চুরি হয়ে গেলে আমরা, তখন, হয়ত পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে হারিয়ে গৃহে ফিরি, অথবা সে হয়ত হারায় না, আমাদের আনন্দহীনতার দিনে তাকে হয়ত ভুলে থাকি, অথবা তাকে আমরা ভুলি না; এবং পুকুরপাড়ে বসে থাকা ভুলে আমরা একদিন হয়ত গৃহে ফিরি, অথবা ফিরি না; দেখি আমাদের গৃহপুকুরে জল নেই– মাছ মরে গেছে। এমন কী যে মাছ হেঁটে চলে গেছে চাঁদে, মেঘে; জলশূন্য গৃহপুকুরের ভাঙা আয়নার ভেতর চাঁদ নেই, মেঘ নেই, মাছ নেই, চাঁদমুখের ছায়া নেই– টুকরো হয়ে গেছে চাঁদ, চাঁদমুখ, মেঘ, ভেঙে গেছে মাছ; তখন, কীভাবে চোরকে প্রতিরোধ করা যাবে, কীভাবে পুকুরচুরি বন্ধ হবে– এই ভয় রাতের প্রতীক্ষার ভেতর ঢুকে পড়ে, ঘুমের ভেতর ঢুকে পড়ে, গৃহের অন্তর আর ছায়ায় উঁকি দেয়, রাষ্ট্রের উপর ডানা বিস্তার করে। তখন পাঠ্যপুস্তকে দেখি চোরের জ্ঞান আর বক্তিমা; গৃহপুকুর জলশূন্য হলে আমাদের গৃহে তখন অভাবের দিনে আমরা বিদ্যালয়কিশোরীকে অনেকদিন দেখি না, কতকাল দেখি না; গাছের ছায়ায় সে নেই, তাকে দেখার ইচ্ছা নিয়ে আমরা গ্রামের একমাত্র স্যাকরার দোকান থেকে ছোট্ট লাল পাথর বসানো রূপার একটা নাকফুল বানিয়ে অপেক্ষা করি এবং পুকুরপাড়ে বসে বসে আমরা ক্রমশ চোরের জ্ঞানে, চোরের বাক্যে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। মনে হয় চোরের জ্ঞান, চোরের বাক্য আমাদের জীবনের সর্বত্র আলো-বাতাসের মতো অবিচ্ছেদ্য; চোরের জ্ঞান চোরের বাক্য আমাদের জীবনে আমাদের রাষ্ট্রে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠলে আমরাও চুরি করি আমাদের জ্ঞান। আমাদের চোখ চুরি করি, চুল চুরি করি, মেঘ চুরি করি, পুকুর চুরি করি, নদী চুরি করি, মাটি চুরি করি, গণিত চুরি করি, বাক্য চুরি করি, বাতাস চুরি করি, অপেক্ষা চুরি করি;
চুরি করতে করতে করতে করতে এমন যে, চুরি করতে না পারলে আমাদের পুকুরপাড়ে বসে থাকা আনন্দহীন হয়ে ওঠে; এবং চারদিকে চুরি বেড়ে গেলে আমাদের গৃহে অভাব ছড়িয়ে পড়ে। চুরি বেড়ে গেলে, তখন, হয়ত পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে হারিয়ে গৃহে ফিরি, অথবা সে হয়ত হারায় না, আমাদের আনন্দহীনতার দিনে তাকে হয়ত ভুলে থাকি; তখন, অভাবের দিনে আমাদের প্রতীক্ষার ভেতর হয়ত ভুলে থাকা কিশোরীটিকে দেখি, হয়ত সে তখন বিদ্যালয়ের নীল পোশাকে ছিল না, পুরোনো একটা ছাপা শাড়ি মলিন বিষণ্ণ সন্ধ্যার মতো তাকে আবৃত করেছিল। আমরা হাত চুলকাতে চুলকাতে বুক পকেটে রাখা নাকফুল কিশোরীকে দিই, আর সে হয়ত নাকফুল দেখে বিস্মিত এবং নাকফুলটি সে গ্রহণ করে না, অথবা করে। আমাদের আবেগ ও বিহ্বলতার ভেতর এমন গোপন প্রণয়ে আমাদের বয়সের ভেতর জন্ম নেয়া পুকুরের পানিতে মৃদু একটি বৃত্তাকার তরঙ্গের হাসি ছড়িয়ে পড়ে; অথবা তাকে হাসিই বা বলি কেন, এবং হাসিও অনেক রকমের হয়, নয়! কী যে,
গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা নারীরা বলে চুরি করে আমাদের প্রেমে পড়ার বিহ্বলতার দিনে তাদের মনে হয়, প্রেম তাহলে আশ্চর্য এক চুরিবিদ্যা। গৃহ যাদের আড়াল, গৃহ যদি মুখ লুকিয়ে থাকার, তবে নারীরা হয়ত বলে, তাদের জীবনে এমন প্রেম ছিল না, চুরি ছিল না; গৃহের এই নারীদের জীবনে প্রেমের কথা না থাকলে আমরা আরো চুরি করি। চুরিবিদ্যায় আমরা পারদর্শী হয়ে উঠলে পাঠ্যপুস্তকে শিখি চুরির আরো নতুন নতুন বিদ্যা, নতুন নতুন জ্ঞান। আমাদের চারপাশে সকলেই যখন চোর, তখন, আমাদের আনন্দ পায়; এবং তখন, আমাদের দেয়া লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতার গ্রহণ করেছিল কি না এই দ্বিধার মধ্যে পড়ি, তখন, চুরি করে কিশোরীর নাকের দিকে দেখি; তখন, যখন, সকলেই চোর– চুরির এত ঐশ্বর্য কোথায় রাখি? আমাদের গৃহে তার স্থান নেই। আমাদের বিদ্যালয়ে তার ভ্রমণ নেই। আমাদের সংগীতে তার সুর নেই। তখন দেখি চাঁদ চুরি গেছে, জল চুরি গেছে, পাখি চুরি গেছে। চাঁদ চুরি গেলে পুকুরে মেঘের নিরুদ্দেশ নেই, পাখি চুরি গেলে গাছের ছায়া হারিয়ে গেছে, ছায়া হারিয়ে গেলে কিশোরীর নাকে লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল দেখি না; আমরা গাছের ফুলপাতার ছায়ার ভেতর কিশোরীকে হারায়, অথবা, তখন,
জল চুরি গেলে এতকিছু হারিয়ে গেলে দেখি গ্রামের পুকুরপাড়ে একটা লাশ পড়ে আছে। আমরা দৌড়ে গৃহপুকুরে ঢুকি, গৃহপুকুরের জলে পড়ে আছে ভাঙা আয়না, পড়ে আছে ভাঙা চাঁদ; আমরা গৃহপুকুরে উঁকি দিলে চারপাশে কোনো লাশ দেখি না, দেখি ভাঙা আয়নার ভেতর আমাদের মুখ, আমাদের মুখগুলো আমাদের লাশ, এইসব মুখলাশ হয়ত আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়; কেউ বলে, লাশের গলায় লোহার তার পেঁচানো; অথবা বলে, লোহার তার না, গলার রগ কালো হয়ে বেরিয়ে এসেছিল; কোথা থেকে এল এই লাশ, অথবা কে এই লাশ– এসব পরিচয় জানতে জানতে বুঝতে বুঝতে পচা মাছের গন্ধ আমাদের নিঃশ্বাসের ভেতর ঢুকে পড়ে। লাশের শরীরে পচা মাছের গন্ধ নিয়ে পুকুরপাড়ে গেলে, এই বিস্ময়ের ভেতর লাশের চেহারা আমাদের চোখের ভেতর দুলে ওঠে; আমাদের মুখের ভেতর, শরীরের ভেতর দুলে ওঠে; তখন আমরা আমাদের দ্বৈত আত্মা গজারমাছের লোহিত রক্তের জ্যোৎস্নার ভেতর লুকায়; লাশের খবর পেয়ে পুলিশ আসে এবং আমাদের হয়ত একদিন মনে পড়বে অভাবের দিনে আমাদের গোপন প্রণয় কীভাবে গাছের ছায়ার ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল; পুলিশের ভ্যানগাড়ি পথের ধূলি উড়িয়ে এলে ভয়ে গ্রামের পুরুষেরা পালিয়ে যায়, গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নারীরা বলে, তাদের পুরুষেরা উড়ন্ত ধূলির ভেতর লুকিয়ে পালালে পুলিশ লাশের শরীরে মাছের গন্ধে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে; তারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রান্তরের দিকে দেখে– ধু-ধু কুয়াশা। তারা গ্রামের দিকে দেখে– গৃহপুকুর জনশূন্য, নিস্তরঙ্গ। তারা মাছের আড়তের ভেতর উঁকি দেয় এবং দেখে আশ্চর্যই বটে যে, কোনো আড়ৎদার নেই, যেন কখনো থাকে না– জমে আছে স্তূপে স্তূপে মাছ। আড়ৎভর্তি মাছ দেখে কী হয় যে, তাদের এইসব মাছের প্রতি লোভ থাকে, তারা তাদের ভ্যানগাড়ি বোঝাই করে মাছে। তারা, পুলিশেরা, তখন, হয়ত ভাবে, এত মাছের জন্যই লাশের শরীরে মাছের গন্ধ, তারা হয়ত লাশটিকে ভ্যানগাড়ি বোঝাই মাছের নিচে রাখার চিন্তা করে; গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা নারীরা বলে, পুলিশেরা পুনরায় ভ্যানগাড়ি বোঝাই মাছ নামায় এবং প্রথমে তারা লাশ তোলে, তারপর আড়তের প্লাস্টিকের ড্রামে পানির ভেতর নড়ে বেড়ানো প্রকাণ্ড মাগুরগুলো তোলে এবং সবশেষে বরফ দেয়া মাছে ভ্যানগাড়ি বোঝাই হলে পুলিশেরা গ্রাম ত্যাগ করে; তখন, পথের উড়ন্ত ধূলির ভেতর লুকিয়ে পুরুষেরা গ্রামে ফিরে আসে, আর পুকুরপাড়ে বসে,
আমাদের ভয় হয়– মাছ শূন্য হয়ে গেলে পুকুরের মৃত্যুর ভেতর আমাদের বয়সের মৃত্যু অনিবার্য এবং আমরা দ্রুত পৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছি লাশে। পুকুরের মৃত্যু হলে আমাদের গ্রামে মাছ বিলুপ্ত, নদী নিঃশেষিত, শস্যক্ষেতে মৃত্যুর মিছিল, সকল ফুল রং হারিয়ে গন্ধহীন। তখন, লাশ অথবা মৃত্যুর অনুভূতি শরীরে, বয়সে, অপেক্ষার গভীরে ছড়িয়ে পড়লে আমরা বিদ্যালয়কিশোরীর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি, পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে দেখার জন্য আমাদের হৃদয়ের গাছপালা পুড়তে থাকে; পুলিশেরা থানায় ফিরে ভ্যানগাড়ি বোঝাই মাছ ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন, আমাদের চুরিবিদ্যার পারদর্শিতা সম্পর্কে সন্দেহ হয়; মনে হয়, পুলিশেরা আমাদের সব মাছ দিনেদুপুরে এভাবে চুরি করে নিয়ে গেল কীভাবে, কী কৌশলে? পাখিদের চাইতে পুলিশ কত চতুর, কত ধুরন্ধর; তারা, পুলিশেরা, ভ্যানগাড়ি বোঝাই মাছ ভাগাভাগি করতে হয়ত লাশের কথা স্মরণ করে, তারা ভ্যানগাড়ি বোঝাই মাছের নিচে লাশ খুঁজে না পেয়ে বিস্মিত। পুলিশেরা হয়ত বলে, লাশ ভ্যানগাড়িতে তোলা হয়েছিল তো? তারা নিজেদের মধ্যে সন্দেহের ছায়া রূপায়িত করলে আমরা দীর্ঘদিন গৃহের বাইরে যেতে পারি না; পুলিশেরা মাছের ভাগ তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে লাশের খোঁজে পুনরায় গ্রামে এলে পথের উড়ন্ত ধূলির ভেতর লুকিয়ে আমরা দ্বিতীয়বার পলায়ন করি। গ্রামে কোনো পুরুষ না পেয়ে পুলিশেরা ফেরার পথে আড়তে উঁকি দেয় এবং দেখে যে, আড়ৎদারেরা কেউ নেই; তখন, পুনরায় তারা সব মাছ নিয়ে যায়; এভাবে চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে আমাদের আড়ৎগুলো মাছশূন্য হয়ে উঠলে আমাদের গৃহে অভাবের ছায়া বিস্তৃত হয়, এবং আমাদের বিদ্যালয়কিশোরীর কথা মনে পড়ে, হয়ত;
তখন, মাছের আড়তে অথবা পুকুরপাড়ে বসে আমরা কিশোরীর বিদ্যালয়ে যাওয়াআসার পথে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া পাউডারের গন্ধের ভেতর প্রবেশ করি, তখন, পুলিশের বাড়িতে তাদের কাজের বুয়া মাছ কুটতে বসে। প্রথমে সে বরফ দেয়া মাছগুলো কেটেকুটে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে, পরে জ্যান্ত মাগুরগুলো কাটে আর আমাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না যে, আমাদের গ্রামের বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেতের ভেতর আমরা পুকুরপাড়ে পড়ে থাকা লাশটিকে গজারমাছ হাতে হেঁটে যেতে দেখি। তখন, কত কতকাল পর আমাদের দ্বিতীয় আত্মার শোকাবহ স্মৃতি ফিরে আসে, এবং আমাদের মুখলাশ গোধূলিবেলায় গজারমাছ হাতে ধরা লাশের পিছনে পিছনে হাঁটে; চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমাদের মুখলাশ হাঁটতে হাঁটতে গজারমাছ হাতে আমাদের লাশ হেঁটে চলেছে। তখন, হয়ত আমাদের ভয় দূর হয়, এবং আমাদের এই বোধ হয় যে, মাছচাষের জ্ঞান আমাদের জীবন রক্ষা করে চলেছে। মাছের ভ্রমণ আমাদের সকাল-দুপুর-রাত আর প্রত্যুষ সূর্যালোকে দীপান্বিত হলে আমরা পুকুরের জলে নেমেছি প্রাচীন কালে। এতদিন এতরাত এতকাল ভ্রমণ করেছি গৃহ থেকে গৃহে, সমাজ থেকে সমাজে, রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে, বিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয়ে, পাঠ্যপুস্তকে থেকে পুস্তকে– এতসব ভ্রমণের ভেতর, তখন, আমরা কিশোরীর বিদ্যালয়ে যাওয়াআসার পথে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া পাউডারের গন্ধের ভেতর প্রবেশ করি, আমাদের মনে হয়, এই অভ্যাসের ভেতর দীর্ঘদিন কিশোরীর স্মৃতি অনিবার্য একটা অবলম্বন রূপে কাজ করে, অথবা করে না; অথবা এমন কী যে, হয়ত আমাদের জীবনের ভেতর ছড়িয়ে থাকা মাছের ভ্রমণ আর জলের অভিজ্ঞতা, আমাদের গৃহ সমাজ রাষ্ট্র আর জীবনের সকল বিস্ময় ও কৌতূহলের ভেতর হৃদয়ের সকল উজ্জ্বলতা নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে বসে আমরা দেখি পুকুরের কালো জলে ডুবে আছে মাছ; অতঃপর, আমরা গজার হাতে লাশটিকে আর দেখি না, হয়ত দেখি সে ধূসর দিগন্তের দিকে চলেছে, আর আমাদের নিঃশ্বাসের ভেতর অনেকদিন পর মাছের বুদবুদ মাছের আঁশটে গন্ধ ঢুকে পড়ে; তখন, পুলিশের কাজের বুয়া মাগুরমাছ কাটতে মাছের পেটের ভেতর লাল পাথর বসানো একটি রূপার নাকফুল দেখে; এবং,
আমাদের আড়ৎগুলো মাছশূন্য হয়ে পড়লে গৃহে গৃহে অভাব নেমে আসে, গ্রামে ছড়িয়ে যায় অভাব; পা আর শরীরে অভাব ছড়িয়ে গেলে আমাদের গৃহ আর গ্রামজীবনের যাবতীয় সবুজসম্ভাবনার ভেতর আমরা হয়ত পুকুরপাড়ে বসে থাকতে পারি না, অথবা বসে থাকি, আর কীই বা করার আছে ভেবে চুরি করে পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারের হৃদয়ে ঢুকে পড়ি; তখন, দূর দূর গ্রামে অভাব ছড়িয়ে গেলে আমরা গ্রামের চতুর ও চোর পাখিদের সম্পর্কে পুনরায় সচেতন হই; এবং আমরা বিস্ময়ে দেখি, বিদ্যালয়কিশোরীকে আমরা অনেক অনেকদিন দেখি না; তখন, আমাদের পকেটের উষ্ণতার ভেতর হয়ত লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল পড়ে থাকে; অথবা আমাদের পকেটে কিছুই ছিল না, তখন, হয়ত আমরা মন খারাপ নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে থাকা ছাড়া কীই বা করার আছে, তখন, আমরা পুকুরপাড়ে বসে হয়ত মেঘ গণনা করি; মেঘেরা কোথায় যায়, কতদূর যায়, কতদূর গেলে বৃষ্টি নিয়ে বর্ষা নিয়ে; মেঘের ধ্বনিময় রঙের ভেতর বর্ষা উড়ে যাচ্ছে কোথাও, কোথায় যায় এইসব ছাই-ছাই ধূসর বর্ষা; এইসব মেঘবর্ষার দিনে আমরা কিশোরীর প্রতীক্ষায় হয়ত গাছের পাতা গণনা করি– পাখিরা নিশ্চল বসে আছে গাছে। একদিন মনে হয়, দীর্ঘদিন আমরা কোনো পাখির সুর শুনি না; গাছের দিকে তাকাই– পুষ্পগন্ধহীন গোধূলি। তখন, আমাদের প্রতিটি শস্যদানা বন্ধ্যা; গাছের ফুলপাতার ছায়ায় আমাদের গোপন প্রণয়ের প্রতীক্ষার ভেতর কিশোরীকে খুঁজি– কোথাও কৃষ্ণবিন্দু ছায়ামেঘ দেখি না– উড়ে যাচ্ছে কোথায়? দেখি দিকচক্রবাল জুড়ে ভাসমান নীল, এবং তখন, আমাদের মনের ভেতর বিদ্যালয়কিশোরীর নীল ড্রেসের ছবি ভেসে ওঠে, কিন্তু নীলের কোথাও পাখির উড়াল নেই; আমরা, তখন, চাই– আকাশের নীলে পাখিরা উড়ুক, পাখিরা পুকুরের জল চুরি করে নিয়ে যাক নক্ষত্রলুব্ধ কৃষ্ণময় ছায়ামেঘের নাচ আর সংগীতে; এবং তখন, আমাদের বিস্ময় যে, আমাদের প্রতীক্ষার ভেতর পাখিদের নিশ্চলতার ভেতর কিশোরী পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতার অনৈসর্গিক বিষণ্ণতায় গ্রামের দিকে হেঁটে গেলে চৈত্রের খা খা রোদে আমাদের হৃদয় শুকিয়ে কাঠ। আমরা কাঠহৃদয় নিয়ে কিশোরীর চলে যাওয়া দেখি, কিন্তু তাকে আমাদের কিছুই বলা হয়ে ওঠে না, অথবা বলি; হয়ত সে আমাদের দেখেই না, অথবা দেখে; আমরা তখন, পুনরায় আমাদের গোপন প্রণয়ের প্রতীক্ষা নিয়ে পানির সন্ধানে গৃহপুকুরে যাই– ভেঙে পড়ে আছে জলের আয়না। গৃহপুকুরে ঢুকে পড়া মেঘের ভেতর তখন কৌতূহলভরা একটা-দুটো পাখি ওড়ে, আর আমাদের কাঠহৃদয় পানির ঘ্রাণ পাই– গাছের পাতায়, শস্যের ফুলে বীজে পাখিরা জল সঞ্চয় করে রেখেছে; পাখিরা মেঘ বৃক্ষ ও পতঙ্গের ছায়াগুঞ্জরিত পথের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যায় জলসঞ্চয়ের কাছে। আমাদের গৃহবাসী আত্মা পুনরায় বেঁচে ওঠে আর আমাদের ছায়ার ভেতর জেগে ওঠে পুকুরের বিস্ময়। আমরা বিস্ময়ে দেখি গৃহপুকুরে ভেঙে খান খান আয়না তখন ভাঙা নয়, একটা সম্পূর্ণ আয়না; সেখানে, পুকুরের সরল জলের আয়নার ভেতর ভেসে ওঠে গ্রামের হৃদয় আর অনন্ত দিনের ইতিহাস। পুকুরের পৃথুল ছায়ার আয়নার উপর ছড়িয়ে আছে খণ্ড খণ্ড মেঘ, প্রাচীন পুকুরের অতল জলের আয়নায় সহস্র রঙিন শ্যাওলার ভেতর মাছেরা ডুবে থাকে; অতঃপর, আমাদের ক্রমাগত নশ্বর স্বপ্নলোকের দিকে আহ্বান করে; তথাপি কেন না,
তখন, পুলিশের বউ মাছ কুটা দেখতে এসে দেখে তাদের কাজের বুয়া মাছ কুটা রেখে নাকে নাকফুল পরায় ব্যস্ত। সে নাকফুল কোথায় পেল, আর তার সাহস কত যে মাছ কুটা রেখে সে সাজগোজ করে; তখন, পুলিশের বউ বুয়াকে বলে, এই ছেমড়ি মাছ কুটা রাইখা তুই সাজনগোজন করস, এই নাকফুল তুই কই পাইলি? আচমকা এমন ঝাঁঝালো প্রশ্নে মেয়েটি থতমত, সে হয়ত কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারে না, অথবা সে হয়ত ভয় পায়, অথবা সে হয়ত বলে, আমার নাকফুল; অথবা সে কিছুই বলে না। তখন পুলিশের বউ তার এই নীরবতায় অবাক; সে বলে, তুই চুরি করছস, কই পাইলি ক… বুঝছি, না পিডাইলে কইবি না! পুলিশের বউ মারের উদ্দেশে কিছু একটা আনতে এদিক-ওদিক তাকালে, তখন, বুয়া ছোট্ট লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল একটি জ্যান্ত মাগুরমাছের মুখ হা করে পেটের ভেতর চালান দেয়; পুকুরের একটি মাছ চিৎপটাং লাফ দিলে আমরা কাঠহৃদয় নিয়ে মাছশূন্য আড়ৎ বা পুকুরপাড়ে বসে থাকি বিদ্যালয়কিশোরীকে গোপনে ভালোবেসে, পুকুরপাড়ের চারপাশে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউয়ের ভেতর মাছের নাচ দেখি, বুদবুদ দেখি; মাছের নাচ অথবা মাছের বুদবুদ দেখা ছাড়া আর কীই বা করার আছে আমাদের, দেখি ঝাঁক বেঁধে মৃদু মাছেরা মেতে উঠেছে পৌরাণিক নৃত্যকলা আর চঞ্চল চিৎপটাং লাফে, আমাদের কাঠহৃদয়ে বিলীয়মান গোধূলির স্পর্শে মাছের শরীরে চন্দ্রালোকিত লাবণ্য খেলা করে, আর মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে; তখন, পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতার মাছশূন্য আড়তের সামনের পথ দিয়ে অথবা পুকুরপাড় দিয়ে আমাদের নিশ্চুপ কৌতূহলের ভেতর দিয়ে বিষণ্ণতার ভেতর হেঁটে যায়। অনেক অনেকদিন পর কিশোরীকে দেখে আমরা কথা হারিয়ে ফেলি, অথবা কিছু একটা কথা আমাদের ঠোঁটের নিচে আটকা পড়ে, ঠোঁট থেকে কথা আমাদের শরীরের ভেতর বেজে ওঠে, অথবা বাজে না; কথারা চলে গেছে শরীর ছেড়ে, হৃদয় ছেড়ে। কথারা হৃদয় ছেড়ে গেলে তখন নিঃসঙ্গ বেজে চলে; তবু কিশোরীকে দেখে আমরা হয়ত আনন্দে কিছু একটা কথা বলে ফেলি, হয়ত বলি না; আমরা তার নাকে কোনো লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল দেখি না, অবর্ণনীয় কষ্টে আমাদের হৃদয় কাঠ হয়ে গেলে আমাদের বিষণ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে একটি মাগুরমাছ শরীর নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে পুকুরে লাফিয়ে পড়ে; অথবা,
পুকুরপাড়ের পথে আমরা পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে দেখি না, তাকে দেখা হয়ত ছিল আমাদের বিহ্বলতার ছায়াছবি মাত্র; আমাদের মনে পড়ে, আড়ৎগুলো মাছশূন্য হয়ে গেলে আমাদের অভাব ও ক্ষুধার দিনে কিশোরীটিকে আমরা গাছের ফুলপাতার ছায়ার ভেতর হারিয়ে ফেলি, একটা মলিন বিষণ্ণ সন্ধ্যা রঙের শাড়ি পরে সে গ্রাম থেকে দিগন্তের দিকে হেঁটে গিয়েছিল, অথবা সে হেঁটে গিয়েছিল গ্রামের দিকে; তখন, আমাদের গোপন প্রণয়ের আনন্দ ও আবেগের ভেতর পুলিশের ভ্যানগাড়ি লাশের সন্ধানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থবার গ্রামে এলে পথের উড়ন্ত ধূলির আড়ালে আমরা তৃতীয় বা চতুর্থবার পলায়ন করি; গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নারীরা বলে যে, বিদ্যালয়কিশোরী সেদিন সন্ধ্যায় থানা শহরে যায়, সেখানে হয়ত সে বুয়ার কাজ নেয় পুলিশের বাড়িতে, এবং সে হয়ত ছুঁড়ে ফেলে দেয়া নাকফুলের জন্য, অথবা হয়ত তার প্রকাশের দ্বিধাজড়িত প্রেমের চিহ্নস্বরূপ– তার চোখে নীরব এক ফোঁটা অশ্রু জমে, অথবা তার শরীরই রূপান্তরিত হয় এক ফোঁটা অশ্রুতে; গ্রামের নারীরা এই কথা বললে অশ্রুমতি কিশোরীকে আমাদের গাছ মনে হয়– পাখিরা তার পাতায় জমা রেখেছে অশ্রুজল, তার ফুলে জমা করেছে অশ্রুজল। তখন আমরা কিশোরীকে হারিয়ে গাছের পাতার দিকে ফুলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি; সন্ধ্যা নেমে এলে, বিকেল ভেসে এলে, ভোর হেসে এলে গাছের ফুলপাতায় পাখিদের চুরি করা জলের দিকে দেখে আমাদের বয়সের ভেতর পুকুরের জন্মের ইতিহাস মনে পড়ে, আর কিশোরীর মতোই আমাদের হারিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় আত্মার স্মৃতির ভেতর পুলিশদের রান্নাঘর থেকে নিঃশ্বাসের গভীর পরিপ্রেক্ষিতহীন এবং রোমাঞ্চিত যৌন ইচ্ছার ভেতর প্রকাণ্ড একটা আফ্রিকান মাগুর শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে রান্নাঘরের জানলায় লাফিয়ে বৈঠকখানা পেরিয়ে, কালো কালো বুট জুতোর ভেতর দিয়ে, থানা শহরের সাম্প্রতিক ক্রসফায়ারের শুকনো রক্ত, সভামঞ্চের বক্তিমা, নুলো ভিখেরি, বিদ্যালয়ের বালকবালিকা, রিকসাভ্যান, মোটরগাড়ি, ট্রাক, টিংটিংয়ে সাইকেল, কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি, ভাঙা কালভার্ট পেরিয়ে ফেটে চৌচির শুকনো আচষা জমির মধ্যে লাফিয়ে পড়ে। তারপর মাগুরটা একটু থেমে রোদে তেতে লাল আচষা জমির ফাটল দেখে নিতে চাইল– যতদূর দেখা যায় তার পেরিয়ে আসা পথ একটা দুমড়ানোমোচড়ানো বিকৃত মানচিত্রের রেখার মতো পড়ে আছে। এইটুকু দেখে সে আবার চলতে শুরু করে। পানির গন্ধ পেলে তার চলার গতি বেড়ে যায়, লেজ পাখনা এত দ্রুত ঘূর্ণায়মান হয়ে ওঠে যে তার শরীর একটা রাবারের চাকতি, আর দ্রুত ঘূর্ণায়মান ওই চাকতির ভেতর থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে ভয়ঙ্কর ক্রোধ, তীব্র ক্ষুধা এবং পৈশাচিক উল্লাস; আড়তের পিছনে হোগলার চাটায়, দূর্বা ঘাস, পানি আর মাছের আঁশটে গন্ধে লোভার্ত বিভোর মাগুরটি চিৎপটাং লাফ দেয় পুকুরে; তখন পানির গন্ধের ভেতর পুলিশের ভ্যানগাড়ি থেকে হারিয়ে যাওয়া অথবা হয়ত চুরি যাওয়া লাশ হেঁটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে; আমরা, তখন, হারিয়ে যাওয়া কিশোরী পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারের চিন্তায় আচ্ছন্নতার ভেতর দেখি লাশের বুকপিঠের মাংস নেই, চোখনাকঠোঁট নেই– একটা ক্ষবিক্ষত ছায়ার মতো সে গ্রামের অন্ধকারে চুপি চুপি হেঁটে আসে, আমরা পুনরায় ভয় পাই; দৌড়ে যাই গৃহপুকুরে, জলের আয়নায় ভাঙা চাঁদের জ্যোৎস্নার ভেতর আমাদের দ্বিতীয় আত্মার মৃত মুখ দেখি, তার ছায়ার উপর পাখিদের উড়াউড়ি পানির জলীয় গন্ধ নিয়ে;
তখন, পুকুরপাড়ে আমরা আমাদের গোপন প্রণয়ের প্রতীক্ষার ভেতর বসে থাকি, বসে থাকা ছাড়া আর কীই বা করার আছে; বসে বসে পাখিদের উড়াল দেখি, পাখিদের এতসব উড়াল আমাদের কতদূর নিয়ে যাবে; কোথায় নিরুদ্দেশ হবে আমাদের বসে থাকা, আমাদের প্রেম, আমাদের শরীর, গৃহপুকুর, মাছের আড়ৎ, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র। এতসব উড়ালে যদি না থাকে ডানার সাহস, যদি না থাকে আকাশের জ্ঞান, যদি না থাকে দূরকে জয় করার অভিজ্ঞতা– আমাদের উড়ালের ভেতর পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতার হারিয়ে যায়; পুলিশের বউ লাফিয়ে বেড়ানো মাগুরমাছ কুটতে রান্নাঘরে ঢোকে, সে কোনো জ্যান্ত মাগুর না পেয়ে বিস্মিত যে, কুটে রাখা মাগুরের টুকরোর ভেতর একটা আঙুল তার দিকে তাকিয়ে। তখন, তার মনে হয়, মাগুরমাছের টুকরোগুলো আসলে মাংসের টুকরো। সে ভয় পায়। ভয়ে হয়ত চিৎকার করে, হয়ত মূর্ছা যায়। রান্নাঘর থেকে এমন ভয়ার্ত চিৎকার এবং মূর্ছা ভেসে এলে পুলিশের দল ছুটে আসে এবং তারা দেখে তাদের রান্নাঘরে মাংসের টুকরো ছড়ানো। পুলিশের সকল লোক তাদের রান্নাঘরে মাছের পরিবর্তে ছড়ানো মাংসের লাল টুকরোর ভেতর আবিষ্কার করে যে, আঙুলের ডগায় রুক্ষ কালচে নোখ; পুলিশকলোনির ভেতর এমন ভয়ার্ত চিৎকারে আমাদের মনে হয়, তাইলে লাশ চুরি হয়ে গেল!
তখন, আমাদের পুকুর চুরি করে পালানো পাখির কথা মনে পড়ে, আর আমাদের বয়স এবং বয়সের ভেতর জীবনের সকল অনুভূতি চুরি যাবার ভয়ে আমরা আমাদের গৃহপুকুরের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠি। পুকুরের উপর আকাশের রং নেই, চুরি হয়ে গেছে; জলের আয়নায় চাঁদমুখের ছায়া নেই, বয়স বেড়ে গেছে। তখন পুকুর চুরি যাবার ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটাই– হৃদয় জেগে থাকে অন্ধকারে। আমরা অন্ধকার পাহারা দিই, সূর্য পাহারা দিই, বিকেল পাহারা দিই, গোধূলি পাহারা দিই, গ্রীষ্ম পাহারা দিই, শরৎ পাহারা দিই, শীত পাহারা দিই, ঘুম পাহারা দিই, বাক্য পাহারা দিই, ভাষা পাহারা দিই– তখন, হয়ত, এতসব পাহারার ভেতর, তবু, আমাদের বয়সের গাছপাথর থাকে না; পাখিরা আমাদের পাহারার ভেতর উড়াউড়ি করে এবং পাখিরা আমাদের পাহারার সঙ্গী হয়; তখন, পুলিশেরা তাদের বউদের চিৎকার এবং হয়ত মূর্ছা যাওয়ায় রান্নাঘরে মাগুর মাছের বদলে মাংসের টুকরো আবিষ্কার করে এবং তারা হয়ত গ্রামের অজ্ঞাতকুলশীল লাশের স্মৃতি ভুলে গিয়েছিল। অথবা তারা হয়ত লাশটিকে আর না খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু তাদের নীল ইউনিফরম আর ভ্যানগাড়ি হয়ত তাদের পুনরায় গ্রামে ফিরিয়ে আনে, পুলিশের বউরা হয়ত বলে যে, তাদের চুরি যাওয়া লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল খুঁজে আনতে। বউদের এই নির্দেশে পুলিশের দল দ্বিধার মধ্যে পড়ে– চুরি যাওয়া লাশ অথবা বুয়া অথবা লাল পাথর বসানো নাকফুল– গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা নারীরা বলে, কিসের খোঁজে পুলিশেরা গ্রামে আসে? বউদের নির্দেশ অমান্য করার সাহস পুলিশদের না থাকলে আমরা গাছের দিকে তাকাই, গাছের ফুলপাতার ছায়ায় কিশোরীর পায়ের গন্ধ ছিল, তার বিদ্যালয়ের নীল ড্রেসের ছবি চাঁদ হয়ে ছিল– আমরা ফুলপাতার ছায়ায় মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে দিই; পুলিশের দল মাছের আঁশটে গন্ধে বিভ্রান্ত হয়, দ্বিধা পায়। তারা লাল পাথর বসানো নাকফুল চোর তাদের বুয়াকে মাছের আঁশটে গন্ধের ভেতর হারিয়ে ফেলে এবং নাকফুল না পেয়ে বউদের খুশি করার জন্য হয়ত তারা ভ্যানগাড়ি ভরে মাছ নেয়ার উদ্দেশে আড়তে প্রবেশ করে। আড়তে মাছের গন্ধ দূর অতীতে শুকিয়ে সংরক্ষিত প্রাচীন লবণাক্ততায় ছড়িয়ে ছিল, কিন্তু তারা কোনো মাছ দেখে না, দেখে আড়তের আলোছায়াময় গোধূলির ভেতর এইসব প্রাচীন শুঁটকি অথবা দূর অতীতে মৃত মাছের গন্ধ শুঁকে শুঁকে শরীরহীন ছায়ারা নেচে নেচে হারিয়ে যাওয়া লাশ হয়ে ফিরে আসে–লাশের শরীর নেই, মাংস নেই–নেচে চলেছে হাড়ের খাঁচা। এইসব অশরীরী নাচ পুলিশের দৃষ্টিকে আঁধার করে, এবং ক্রমাগত জোনাকির রহস্যে পরিত্রাণহীন খেলায় মেতে উঠছে ভয়; আর আমাদের হয়ত লুকিয়ে থাকার কোনো জায়গা অবশিষ্ট ছিল না, গৃহের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নারীরা বলে, এই প্রথম আমরা পুলিশের ভ্যানগাড়ির চাকায় উড়ন্ত ধূলির আড়ালে পালিয়ে যাইনি, হয়ত সাহস নয়, হয়ত ভয় নয়; অসহায় নির্বিকারে আমরা পুকুরের সবুজ শীতল জলের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের দ্বিতীয় আত্মার কথা ভাবি, অথবা হয়ত যে আমাদের গোপন প্রণয়ের বিষণ্ণতার ভেতর পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারের জন্য প্রতীক্ষা করি, তখন কষ্টে আমাদের হৃদয় প্লাবিত হলে মাছশূন্য আড়তে গোধূলির আলো-আঁধারের ভেতর অশরীরী ছায়ানৃত্যের দিকে পুলিশের দল তাদের রাইফেল তাক করে, গুলি ছোঁড়ে
গ্রামের গোধূলি অন্ধকারে গুলির শব্দে পানির গন্ধ নিয়ে পাখিরা উড়ে গেলে আমরা জানতে পারি এমন যে কী, আমাদের গ্রামের লাশ চুরি হয়ে গেল; আমরা পুকুরের শীতল জলের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের দ্বিতীয় আত্মার জন্য শোক করি, আমাদের বিষণ্ণতার ভেতর লাশ চুরি হয়ে গেলে আমাদের গৃহপুকুর চুরি যাবার ভয়ে জানলাদরজায় পেরেক ঠুকে দিই আর অনন্ত আঁধারের রাজত্ব শুরু হয়। আঁধারে আমাদের আরো ভয়– এখন তবে কী করি, কোথায় যাই? কোথায় লুকিয়ে রাখি পুকুরের জলের আয়নায় ফুটে ওঠা আমাদের মুখলাশ? আঁধারের শূন্যতার ভেতর মাটির রঙিন আমকাঁঠালের পেটে জমানো মাছ মুরগি কলা আনারস রয়েলবেঙ্গল টাইগার হাইকোর্ট স্মৃতিসৌধ শাপলা ফুলের ছবি আঁকা টাকাপয়শা চুরি হয়ে যায়। চারদিকে চুরি হত্যা আর মৃত্যুর খবর উড়ে এলে আমাদের সকল রাতে, সকল প্রভাতে, সকল বিদ্যালয়ে, সকল সংগীতে, সকল শরীরে, সকল বাক্যে, সকল জ্ঞানে নিরাপত্তার অভাব বোধ করি, তখন হয়ত এই বেদনা ও বিষণ্ণতার দিনে আমাদের পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারের কথা মনে পড়ে; ধীর মন্থর স্বভাবের ভেতর লাল পাথর বসানো নাকফুল ছুঁড়ে ফেলার সাহস সে কোথায় পেল– এই কথা ভেবে আমাদের হয়ত মনোবল ফিরে আসে, অথবা আমরা ক্রমঅপস্রিয়মাণ গোধূলিভাষার ভেতর দিয়ে দীর্ঘদিন পর তাকে গৃহের দিকে ফিরতে দেখি, এবং তখন, গুলির শব্দে উড়ে যাওয়া পাখিরা ফিরে আসে গ্রামে, গাছে, গৃহে, পুকুরে; আমরা আলো হারিয়ে পানি হারিয়ে মাছ হারিয়ে পুকুরপাড়ে বসে থাকি ভাঙা আয়নার ভেতর; তখন, আমাদের বয়সের ভেতর গ্রামের সকল পুকুরচুরি করে আমাদের দ্বিতীয় আত্মা, এই কথা জেনে বিষণ্ণ বিকেলগোধূলির ভেতর আমাদের বিস্ময় কী যে,
আমাদের গোপন প্রণয়ের বিষণ্ণতার ভেতর পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতার গ্রামে ফিরে এলে পুকুরপাড়ে মাছের গন্ধ ঘন হয়ে আসে, এবং আমাদের কাছে এই গন্ধ এমন যে, কিছু অচেনা মনে হয়, আমাদের এতকালের পরিচিত আঁশটে গন্ধ এভাবে কী হয় যে বদলে গেলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি, অজানা শঙ্কা নিয়ে গ্রামের জেলেদের গৃহে যাই। জেলেরা বলে, আঁশবিহীন মাছের গন্ধ– এসব নতুন মাছচাষের পদ্ধতি তাদের জানা নেই, তারা জানে চাঁদকপালি গজারের পাতালভ্রমণ, তারা জানে খলসে কই পুঁটির যাবতীয় শিল্পসম্ভাবনা আর উজ্জ্বল হৃদয়। জেলেরা বলে, গৃহের প্রাঙ্গণে লাউকুমড়া গাছের গোড়ায় তারা এসব মাছের আঁশ আর কাঁটা উৎসর্গ করে–ফলন বাড়ে। মাছের যদি আঁশ না থাকে তবে তাদের শস্য হারিয়ে গেছে, পুকুর শুকিয়ে গেছে। জেলেদের কথা শুনে নতুন ভয় আমাদের অমলিন ঘুমের ভেতর, রূপায়িত ছায়ার নির্জনে ঢুকে পড়ে, তখন আমরা আমাদের দ্বিতীয় আত্মা চাঁদকপালি গজারের স্মৃতির ছায়ায় ছায়ায় পুকুরপাড়ে বসে থাকি, বসে থাকা ছাড়া কীই বা করার আছে আমাদের; পুকুরপাড়ে বসে গাছ দেখি, গাছের ছায়া দেখি। দেখি গাছের সকল পাতায় তন্দ্রামগ্ন পাখি গায়ক পাখি ভাবুক পাখি শিকারী পাখি নর্তক পাখিরা পুকুরের সকল জল তাদের ঠোঁটে বহন করে নিয়ে যায় গোধূলিগন্ধচিহ্নিত মেঘে, তবু আমাদের যেন কোনো ভাবান্তর নেই; যেন,
পাখিরা জল চুরি করে নিয়ে গেলে পুকুরে পড়ে আছে জলের কঙ্কাল; পুনরায় পুকুরচুরি কীভাবে বন্ধ করা যায় ভাবতে ভাবতে পুকুরের মুমূর্ষু শুকনো করোটি আর অবলীঢ় কঠিন কাদার ভেতর কালো প্রকাণ্ড মাগুরেরা তীক্ষè কাঁটার নিঃসঙ্কোচ হ্রেষায় নিকষ আঁধারের স্তব্ধতা ভেদ করে খেয়ে ফেলছে ছোট ছোট মাছ; আমরা এইসব কালো মাগুরকে ধাওয়া দিলে, আমাদের ভয়ার্ত অস্তিত্বের ভেতর, পুকুর উপচে মাগুর ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে, গৃহে, শস্যক্ষেতে, গাছে। কাদাজলত্যাগী কালো মাগুরেরা কেটে ফেলে আমাদের গোপন প্রণয়ের প্রতীক্ষার ভেতর বাগীশ্বরী বিকেল; কেটে ফেলে মাটির আমকাঁঠালের পেটে জমানো মাছ রয়েলবেঙ্গল টাইগার চাঁদতারা মসজিদ; কেটে ফেলে আলো আর গান। এইসব কালো মাগুরের ভয় ভুলে যেতে আমরা মেঘবৃষ্টির প্রার্থনা করি, তখন আমাদের বয়স আর গাছের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া কিশোরী, মাছ, রয়েলবেঙ্গল টাইগার চাঁদতারা মসজিদের মিনার জমিয়ে রাখা মাটির আমকাঁঠাল, আলো আর গানের আত্মা ঢুকে পড়ে। ভয় দূর করতে পারি না; তখন হয়ত বিমূঢ় বিষণ্ণতার ভেতর আমরা গানের অনুভূতি নিয়ে, আলোর অনুভূতি নিয়ে আমাদের হারানো গোপন প্রণয়ের কথা ভাবি এবং সীমাহীন দুঃখের ভেতর হাজার হাজার পাখি রোমহর্ষোল্লসিত কলো মেঘমণ্ডল থেকে উড়ে আসে গাছে, গৃহে, পুকুরে, মাছের আড়তে; তখন,
ঝটিতে অসংখ্য ছায়ানিকুঞ্জে আর গৃহের জানালায় পাখিরা ছুটাছুটি শুরু করলে নিসর্গের সমস্ত রং রেখা রহস্য ছায়া একখণ্ড নীলাঞ্জন কৃষ্ণবিন্দুতে রূপান্তরিত, লীন। একখণ্ড কালো বিন্দু উপচে ছড়িয়ে পড়ে দুর্দম জলকুণ্ড। মেঘ ভেঙে পড়ে ঘূর্ণায়মান বায়ুতরঙ্গে। হরষিত ঝিমঝিম মেঘপুঞ্জ ঊর্ধ্বশ্বাসে কৌতুক করে চলে। আমরা পুকুরপাড়ে বৃষ্টির ভেতর বসে থাকি, বৃষ্টির ভেতর বসে থাকা ছাড়া কীই বা করার ছিল আমাদের; বৃষ্টির ভেতর বসে দেখি বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় ক্ষুদ্র একটি গজার মাছ বড় হয়ে উঠছে। পুকুর উপচে পড়া বৃষ্টিচূর্ণগন্ধ সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে; আর আমাদের বসে থাকা ঢ্যামনা স্বভাবের ভেতর, বৃষ্টির ভেতর বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় ছোট গজার মাছ বড় হতে হতে বড় হতে হতে প্রকাণ্ড; তখন, বৃষ্টির সমুদ্র হয়ে যাওয়া পুকুরে খেলা করে চন্দ্রালোকসম্ভব ঢাউস গজার। বৃষ্টির তুমুল নির্ঝরে মেঘমণ্ডল থেকে লাফিয়ে পড়ে অজস্র শিশু গজার, খলসে, পুঁটি, ডাটকিনি, চাপিলা, কই,
অনেক অনেককাল পর আমাদের গ্রামের উঠোনে, গৃহের চালে, গাছের পাতায়, ফুলের গন্ধের ভেতর মৎস্যবৃষ্টি হলে ডম্বরু বৃষ্টির আঁধার গন্ধে, বৃষ্টির রূপালি প্রতিভার ভেতর, বৃষ্টির নীল নাচের অমিত্রাক্ষর ছন্দের ভেতর পুকুরপাড়ে পড়ে আছে চুরি যাওয়া লাশ– ক্ষতবিক্ষত। তখন, পুনরায় আমরা পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে যাওয়ার চিন্তা করি; তখন, মনে হয় যে কী, পথের ধূলি বৃষ্টিতে কাদা হয়ে গেলে পালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব; হয়ত এই ভয় আমাদের গ্রাম এবং বিকেলের উপর ছায়া বিস্তার করলে আমরা ভয়ে বিস্ময়ে লাশের কাছে যাই, দেখি, পুকুরপাড়ে পড়ে আছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া চাঁদকপালি গজারের মৃত্যু এবং ঘাসের ছায়াবৃষ্টিগন্ধের ভেতর ছোট্ট লাল পাথর বসানো রূপার নাকফুল; তখন, আমরা আমাদের গ্রামের দিগন্তের দিকে দেখি, পারভিন সুলতানা অথবা সুমনা আখতারকে দেখি না;