হাসানের ধ্রুবদৃষ্টি বারবার রাস্তায় গিয়ে পতিত হচ্ছে। রাস্তাটি ফাঁকা। চকচকে কনক্রিটের পাকা রাস্তাটি এই আধো কৃষ্ণপক্ষের রাতেও তার জ্যোতি বিলীন করে যাচ্ছে। কতক্ষণইবা হবে, ঘণ্টা দেড়েক! একটি নিঃসঙ্গ পথের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সময়টা খানিকটা বেশিই হয়ে গেছে। দ্বিপ্রহর হলে হয়তো আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত করা যেতো। উদ্দেশ্যগামী পথযাত্রীকে দেখে দেখেও সময় পার করে দেওয়া যায়। কিন্তু নিস্তব্ধ রজনীতে একাকী সময় কাটানো বড়োই দুর্বিষহ ব্যাপার।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ সময় সৌন্দর্য নিবারণের পর হাসান তার সকল প্রকার ধৈর্য্যকে বিসর্জনকে দিয়ে আড়ষ্টমুখে কাউন্টারে নিযুক্ত পদপ্রার্থীকে বাস আসার কথা জিজ্ঞাসা করলো।
ভদ্র মহাশয় প্রশ্নটি শুনলো কি শুনলো না, বুঝা গেল না কিন্তু ‘ও…’ ‘আ…’ জাতীয় কিছু অবোধগম্য শব্দ করে হাসানকে দ্বিধায় ফেলে দিল। ভদ্রলোকের এইসব অপার্থিব জবাব শুনে হাসান তার চোখের সামনে হতে সরে দাঁড়ায়।
উফ! এভাবে আর কতক্ষণ। অপেক্ষা করাটা যে হাসানের বড়োই তিক্ততা লাগছে। তার প্রভাবটা চোখে, মুখে। এমনকি দেহের প্রত্যেকটা অঙ্গতে প্রকাশ পাচ্ছে। অশান্ত চিত্তটাকে স্বল্প স্বস্তি প্রদানের সন্ধানে হাসান কাউন্টার ছেড়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে।
২.
পৌষ মাস। ঘন কুয়াশায় আছন্ন চারপাশ। হাসান তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকায়। ৯:১৭ বাজে। শীতের প্রকোপেই হোক বা অন্য কোনো বিচিত্র কারণেই হোক, আশেপাশের সব দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই শীতের রাতেও শোঁ-শোঁ শব্দে হিম শীতল বাতাস বইছে। হাসানের গায়ে পড়ে থাকা সোয়েটারটা শীত নিবারণের জন্য খুবই ক্ষীণ। তার শার্টের হাতার ফাঁক দিয়ে ফুরফুর করে বাতাস ঢুকছে। বাতাসের শিহরণে দেহের প্রতিটা লোম ক্রমশ কাঁটাস্বরূপ পিনে রূপান্তরিত হচ্ছে। হাসান বারবার কেঁপে উঠছে। দাঁত কপাটি ঠকঠক করে বিচিত্র শব্দে কম্পিত হতে লাগলো। শীতে যে তার সমস্ত শরীর জমে যাওয়ার উপক্রম। চা-টা কিছু খাওয়া গেলে হয়তো ভালো লাগতো। হাসান মূল সড়ক ছেড়ে রাস্তায় এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। দূরে মূল সড়কের গোড়ার দিকটাতে চায়ের দোকানের মত কিছু একটা হাসানের দৃষ্টিগোচর হয়। সে জীবনের অস্তিত্ব বাঁচাবার তাগিদেই হোক বা চায়ের পিপাসায় হোক সেদিকটায় হাঁটতে থাকে।
চায়ের দোকানে একজন মধ্য বয়স্ক লোক বসে আছে। গলায় মোটা মাফলার বাঁধা। শীতের তীব্রতা লোকটা করুণভাবে আক্রান্ত করেছে। বৈঠাহারা নৌকার মতন তার ডেপডেপ দৃষ্টি ইহার জানান দিচ্ছে। হাসানের উপস্থিতিতে লোকটি তার যত্নে গড়া কোমল উমটি হতে নড়ে বসে। গলা খাকারি দিয়ে উচ্চস্বরে হাসানকে চা দেবার কথা জিজ্ঞাসা করে।
হাসান তার বাঁ পকেটে হাত ঢুকায়। বেশ কতকখানি সময় আগে নতুন এক প্যাকেট গোল্ডলিফ কিনেছিলো। সিগারেটের প্যাকেটটা বের করতেই তার সাথে একটি সাদা কাগজ বেরিয়ে পড়ে। কাগজটা হাসান হাতে নেয়। চতুর্ভাজবিশিষ্ট কাগজটিতে চোখ পড়তেই বিষয়টি তার বোধগম্য হয়ে যায়। চিঠিটা অহর্নিশির। গোটা গোটা হরফে কত সুন্দর সুশ্রীভাবেই না তার আবেগগুলো প্রকাশ করেছে। হাসান আর অহর্নিশির বিয়ে হয়েছে আজ আট বছর হলো। অহর্নিশি ভেবেছিলো নুহা হওয়ার পর হয়তো তাদের মধ্যকার প্রেমটা লগবগে হয়ে পরবে কিন্তু অহর্নিশির সকল ভ্রান্তি চূর্ণ করে হাসান ঠিক আগের মতই রয়ে যায়।
মধ্যবয়স্ক লোকটি হাসানের দিকে চা বাড়িয়ে দেয়। আগুন গরম চা-টা হাতে নিয়ে হাসান একটা সিগারেট ধরায়। চায়ের চুমুকে আর সিগারেটের ধোয়ায় হাসানের জমাট বাধা রক্ত কণিকাগুলো তপ্ত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার শিরদাঁড়াতে, যেন প্রাণ ফিরে আসে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সে চা-টা শেষ করে। তারপর সিগারেটটা ফুঁকফুঁকতে প্রাণবন্ত শরীরে পুনরায় বাস কাউন্টারের দিকে ফিরে যেতে থাকে।
৩.
হাসানের মুখখানা একটি নিবন্ত প্রদীপের মত অন্ধকার হয়ে আছে। কপালের শির দপ্ দপ্ করছে। বিষ্ফোরিত চোখ দু’টি সামনের দৃশ্যটা তার ভীত চিত্তটাতে ঠাঁই দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কাউন্টারের ওয়েটিং রুমে একগুচ্ছ মানুষের সমাগম। কেউ পেপার পড়ছে, কেউ কারো সাথে কথা বলছে, কেউ বা অন্য কোন বিষয়ে মনস্থির করে আছে। বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে এখানে সবাই তার পরিচিত। ওই যে বড় মামাকে দেখা যাচ্ছে। ছোট সময় বড় মামাই ছিলো হাসানের সবচেয়ে কাছের মানুষ। আদরটাকে শতকরায় হিসাব করলে অধিক ভগ্নাংশটা বড় মামার দিকেই ঝুলে থাকবে। কিন্তু বারো বছর আগে লঞ্চ ডুবিতে আকস্মিকভাবে মারা যায় বড় মামা। বড় মামির বুকফাঁটা আর্তনাদ-আহাজারি স্পষ্ট চোখে ভেসে উঠছে হাসানের। সেদিন ছোট্ট হৃদয়টাতেও এক গভীর ব্যথা অনুভূত হয়েছিলো। বালিশের উপর মুখ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গুটিকতক অশ্রুও বিসর্জন দিয়েছিলো।
সবার কোণায় দিকটায় বিনোদিনীকে দেখা যাচ্ছে। সম্পর্কসূত্রে খালাতো বোন। স্বামীর সাথে বনিবনা হলো না বিধায় জগত-সংসারের সকল মোহ মায়া ত্যাগ করে এই নিষ্ঠুর ভুবনকে বিদায় জানায়। শেষ বেলায় অপ্সরীর মতো নিথরদেহটাকে বাড়ির পিছনে পুরাতন মোটা প্রকোষ্ঠ কাঠটাতে ঝুলে থাকতে দেখা যায়।
ছোটবেলার বন্ধু রাশেদ, ছোট কাকু উসমান সবাইকেই যে এখানে দেখা যাচ্ছে। হাসান বারবার চোখ কচলাতে থাকে। সামনের দৃশ্যটাকে নিছক অবিশ্বাসের পাতায় লিখে রাখতে চাইলো। কিন্তু হাতের সামান্য ডলা দৃশ্যটার কোনো পরিবর্তন এনে দিতে পারলো না। হাসান কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না! তার মনে হলো, মূর্তির মতো পা জোড়া মাটিতে আটকে গিয়েছে। পাশে রাখা হাত ব্যাগটা নিয়ে জেল পলাতক কয়েদীর মতো সে ছুটতে লাগলো।