মোজাম্মেল হক নিয়োগী
কথাসাহিত্যিক
মোজাম্মেল হক নিয়োগী

অ্যান্টিক

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

মেঘখণ্ডগুলো কালো রং ধারণ করে আকাশ ছেয়ে থেকে থেকে বাঘের মতো গর্জাচ্ছে। যেকোনো সময় ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে প্রবল বর্ষণ শুরু হতে পারে। শরীফ মোটরবাইক থেকে আকাশের দিকে বার কয়েক তাকিয়ে দ্রুত গন্তব্যের দিকে ছুটছে। গন্তব্য বলতে বদরগঞ্জ উপজেলার ডাকবাংলো। পথের হিসাবে এখনো আনুমানিক ত্রিশ কিলোমিটার সামনে। কাঁচা সড়ক। একপ্রকার আতঙ্ক নিয়েই শরীফ বাইক চালায়।

হরিদাসপুরের কাছেই একটা জঙ্গলের কাছে আসতেই মোটরবাইকের স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়।

শরিফ মোটরবাইকটি দাঁড় করিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে প্লাগটা খুলে দেখছে কার্বন জমেছে কি না। কার্বন কিছুটা জমেছে মনে হলেও তা পরিষ্কার করার আগেই প্রবল ধারায় বৃষ্টি, শোঁ শোঁ বাতাস, বিজলি, বজ্রপাত শুরু হয়ে গেছে। শরীফ আশ্রয়ের সন্ধানে কাছেই গাছগাছালিতে ছাওয়া একটা পুরোনো বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঝোড়ো বৃষ্টিতে শরীফের গায়ের কাপড় ভিজে সারা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে একটি ঘর থেকে সন্ধ্যাবাতির মৃদু আলো বেড়ার ফাঁক গলিয়ে বাইরে এসে বাড়িতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান দিচ্ছে। বাকি ঘরগুলো ভাঙা, নড়বড়ে। এ রকম বাড়িকে বুঝি বলে ভুতুড়ে বাড়ি!

ভয়াতঙ্ক ও দ্বিধাগ্রস্ত মনে শরীফ দরজায় টোকা দেয়। কয়েকটি টোকা দেয়ার পর ঘরের ভেতরে থেকে একটা সুরেলা গলার শব্দ শোনা গেল, ‘কে?’

শরীফ কী পরিচয় দেবে? ক্ষণকাল ভেবে বলে, আমার বাসা ঢাকায়। এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। আমি ঝড়ে আটকা পড়েছি। আমাকে একটু সাহায্য করা যাবে?

কিছুক্ষণ আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কোনো পুরুষ না থাকলে এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। সঙ্গে অনেক টাকাও আছে। কী করা যায়?

কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল তাহমিনা। এক অপূর্ব সুন্দরী নারী। হারিকেনের আলোয় যতটুকু সৌন্দর্য দেখা যায় তা দেখেই শরীফ ভাবে এ বাড়িটি ভূতের বাড়ি কি না? এমন সুন্দরী নারী কেন এ বাড়িতে?

তাহমিনা বলল, ভেতরে আসুন।

দ্বিধাগ্রস্ত শরীফ ভেজা কাপড়েই ঘরে ঢোকে। হারিকেনের ক্ষীণ আলো ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। বাড়িতে কোনো মানুষ আছে কি না, তাও বলা মুশকিল। মজবুত কাঠের বেড়া। মোটা মোটা গজারি কাঠের পালা ঘরটিতে ঢুকেই মনে হয়েছে বাড়িটি অনেক দিনের পুরোনো তবে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট।

তাহমিনা বলল, আমি লুঙ্গি দিচ্ছি, আপনি কাপড় বদলে নিন।

শরীফ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভাবছে এমন নির্জন বাড়িতে এ অপূর্ব সুন্দরী নারী কোত্থেকে এলো? অন্ধকারে মনে হলো একটা টিউবলাইট। পলকের মধ্যেই তাহমিনা লুঙ্গি ও একটা তোয়ালে নিয়ে এসে বলে, আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমি চা নিয়ে আসছি।

কয়েক মিনিটের মধ্যে চা আর মুড়ি নিয়ে আসে তাহমিনা। তার স্মিত হাসি সৌন্দর্যের আরেকটি মাত্রা যোগ করল। অভিভূত শরীফ বলল, এত তাড়াতাড়ি চাও করে ফেললেন?

চা খেয়ে একটু বিশ্রাম করুন। আমি রান্না চড়িয়ে দিচ্ছি।

আমার মোটরবাইকটি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে অসময়ে আপনাদের বিপদে ফেললাম।

বিপদ কোথায়? আপনি শহুরে মানুষ। আমাদের হতদরিদ্র পরিবেশে থাকতে পারবেন কি না তা ভেবে লজ্জায় মরছি।

মিছেমিছি লজ্জা দেবেন না। আমি এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। ঝড়ের কারণে…

আচ্ছা, এসব পরে শোনা যাবে। একটু বিশ্রাম করুন। আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

শরীফ চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। ঘুট পাকানো অন্ধকার, চারপাশ সুনসান। কিছু ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। অন্ধকার হাতড়ে বাদল এসে ঘরে ঢোকে। বাদল এ বাড়ির বছরবান্ধা গোমস্তা।

তাহমিনা এসে বলল, রাতে সামান্য ডাল-ভাত খাবেন। আসুন আমার সঙ্গে।

শরীফ বলল, আমার মোটরবাইকটা তো বাইরে পড়ে আছে। সেটা আনা আনা দরকার।

তাহমিনা বলল, হ্যাঁ। আপনি আমাদের বাদলকে নিয়ে যান। বাদল, ও বাদল, ওনার সাথে একটু বাইরে যা তো।

বাদল হারিকেন হাতে আস্তে আস্তে শরীফের সামনে এসে দাঁড়ায়। শরীফ বলল, চলো।

মোটরবাইকটা বাড়ির আঙিনার শেষ প্রান্তে। বাদল বলল, ভাগ্যি বালা, কেউ নেয় নাই কা।

শরীফ ঠেলে ঠেলে মোটরবাইকটি বাড়ির আঙিনায় এনে রাখে।

রাতে খাবারের সময় আশেক খানের সঙ্গে শরীফের পরিচয় হয়। আশেক খান তার নিজের বিছানায় বসে খাচ্ছেন। শরীফ পাশের টেবিলে। আশেক জিজ্ঞেস করে, কী কাজে এখানে এসেছিলেন?

ঢাকায় আমার একটা অ্যান্টিকের দোকান আছে। আমি গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াই। অ্যান্টিক খুঁজে পেলে কিনি।

তাহমিনা খাবার পরিবেশন করছে। কথাটা শুনে কান খাড়া করে তাকালো শরীফের দিকে।

আশেক বলল, বুঝলাম না ভাই। একটু বুঝিয়ে বলুন।

অ্যান্টিক মানে হলো পুরোনো জিনিসপত্র, যার ঐতিহাসিক কিংবা শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য আছে। এসব জিনিস গ্রামে-গঞ্জে অনেক মানুষের বাড়িতে পাওয়া যায়। এসব এসব জিনিসের দাম অনেক।

কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে যায়। খাওয়ার আয়োজন বেশ চমৎকার। বিশেষ করে জামআলু দিয়ে শিং মাছের তরকারি অমৃতের মতো সুস্বাদু।

আশেক বলল, আমি বিছানায় শুয়ে-বসে খাচ্ছি, কিছু মনে করবেন না। আমি অসুস্থ, তাই।

শরীফ বলল, কিছু মনে করবেন না। আপনার কী ধরনের অসুস্থতা?

এটা আমার ভাগ্যের বিড়ম্বনা। আমি ছিলাম ফুটবল প্লেয়ার। আশেক একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, আমার বিয়ের এক বছর পর আমাদের কলেজের মাঠে এলাকার ছেলেপুলে ঈদের দিন বিকেলে একটা ফুটবল খেলার আয়োজন করে। বিবাহিত বনাম অবিবাহিত যুবকদের ফুটবল ম্যাচ। আমি খেলতে খেলতে একসময় অনেক ওপরের একটা বল হেড করতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাই। তখন কোমরে চোট পাই। মানে কোমর ভেঙে গেছে। এখন কোমর ভাঙা নিয়েই বিছানায় পড়ে আছি। আমাদের বিবাহিত জীবনের এখন সাত বছর চলছে। মনে হয় আর ভালো হবো না।

তাহমিনা একটু চেঁচিয়ে বলল, বলছে তোমাকে ভালো হবে না। নিশ্চয়ই ভালো হবে।

চিকিৎসা করাচ্ছেন না?

চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। সে ধরনের আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। কিছু কিছু চিকিৎসা করাচ্ছি। যদিও আমার পূর্বপুরুষ বংশমর্যাদায়, কাজেকর্মে, জমিজমায় খানদানি ছিলেন কিন্তু আমার সময় এসে তলানিতে ঠেকেছে। এখন সামান্য কিছু জমি আছে, সেটাও নিজে দেখতে পারি না। বাদল ছেলেটাই দেখে। কোনো রকম বছরটা চলে যায়।

বাকরহিত শরীফের খাওয়া যেন বন্ধ হয়ে যায়। তবে আশেকের কথায় শরীফ স্বাভাবিক হয়।

আশেক বলল, ভাই, আপনার মনটা খারাপ করে দিলাম। বড় অন্যায় হয়ে গেছে। আপনি একটু আরাম করে খান। সারা দিন কোথায় কোথায় ঘুরেছেন, কি-না-কি খেয়েছেন? সরি ভাই। এই তাহমিনা, ওনার পাতে মাছের তরকারি দাও। শিং মাছের ডিমটা ওনাকে দাও।

তাহমিনা বলল, তুমি অসুখের কথাটা খাওয়ার পরও তো বলতে পারতে। ভাই, আপনি খান তো। ওর কথায় কান দেবেন না। সারা দিন শুয়ে থাকে। কথা বলার মানুষ পায় না। এই জন্য আপনাকে পেয়ে একটু কথা বলছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।

শরীফ বলল, আমাকে লজ্জা দিবেন না। আমি খুব মজা করে খাচ্ছি। মনে হচ্ছে অমৃত। এই খাবার তো ঢাকার মানুষজন কল্পনাও করতে পারবে না।

ভাই, ঘুমাতেও আপনার কষ্ট হবে। আমাদের বাড়িতে তেমন কেউ আসে না। বিছানাপত্র তেমন গোছানো না। আত্মীয়স্বজন বলতে নেই বললেই চলে। তাহমিনার বাবা-মা থাকেন নেত্রকোনা শহরে। এক ভাই আছে। সে থাকে সিলেটে। তারা মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নেয়। এই আমাদের মেহমান।

শরীফ বলল, আমি এতটা আতিথ্য পাব তা তো কল্পনাও করতে পারছি না। আমরা শহরের মানুষেরা আতিথ্য শব্দটা ভুলেই গেছি। আপনজনকেও ভালো চোখে দেখি না। আর অপরিচিতি ব্যক্তির বেলায় তো কথাই নেই।

শরীফ বলল, মেহমান আসা মানে বাড়িতে লক্ষ্মী আসা, বাবা বলতেন। আজকে আপনি আমাদের লক্ষ্মী। কথা শেষ করে আশেক প্রাণ খুলে হাসে।

শরীফ শুয়ে আছে বিছানায়। বাইরে জমাট অন্ধকার। শরীফ শুয়ে শুয়ে ভাবছে তার অতীতের কথা। নাবিলাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত সে। পাঁচ বছর প্রেম করে বিয়ে করেছিল। ব্যাংকের চাকরির টাকায় তার চাহিদা মেটানো যায়নি। সে চাইত দামি গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট, হাত খরচার জন্য মোটা টাকা। নাবিলার নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদার কাছে শরীফের প্রেম ম্লান হয়ে গেল। বিয়ের দুই বছর পরই নাবিলা তালাক দিয়ে চলে গেল এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। এখন সিঙ্গাপুরে থাকে। শরীফের চোখ ভিজে যায়। মনে মনে বলল, নাবিলা সুখে থেকো। আমি আমার কষ্টকে ভুলে থাকার জন্য ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে অ্যান্টিক খুঁজে বেড়াই। জীবনের বেঁচে থাকার এক নতুন পথ। তোমাকেও ভুলে থাকা যায়।

পরদিন শরীফ অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে।

বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই আরেক আশ্চর্য তার সামনে। স্থানীয় বাজার থেকে এক মোটরসাইকেল ম্যাকানিক্স বারান্দায় বসে আছে। এখন হুকুম পেলেই কাজে লেগে যায়।

শরীফ ম্যাকানিক্সকে সহযোগিতা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরাৎ ঘরাৎ ঘরং করে বাইকটি গর্জে ওঠে।

নাশতা খেতে আসুন ভাই, তাহমিনার ডাক, আশেক আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

শরীফ নাশতার টেবিলে গিয়ে বসে। পরোটা, ডিমভাজি, আলুভাজি। বেশ চমৎকার নাশতা।

আশেক জিজ্ঞেস করল, ঘুম হয়েছে ভাই?

না, না। কী যে বলেন। একেবারে নিশ্ছিদ্র ঘুম। কিছুই টের পাইনি। মনে হলো পাঁচ বছর পর এমন ঘুম হলো।

আশেক বলল, ভাই অ্যান্টিকের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন। আমার কাছে বেশ মজা লাগছে।

অ্যান্টিক কী তা গতরাতে বলেছি। ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক মূল্য আছে এমন পুরোনো জিনিসপত্র।

এগুলোর কেমন দাম?

জিনিস যত পুরোনো হয় তত দাম। যত ঐতিহ্য তত দাম।

মোগল আমলের জিনিসপত্রের কেমন দাম হবে?

কী ধরনের জিনিসপত্র?

মুদ্রা, তরবারি, খোদাই করা খেতাব, পোর্ট্রেট, কষ্টিপাথরের মূর্তি, রুপোর জিনিস-এই সব।

এগুলোর অনেক দাম। কয়েক লাখ টাকা তো হবেই। কোটি টাকাও হতে পারে।

আচ্ছা। পুরোনো জিনিস অনেক দামি হয়?

হ্যাঁ। বিদেশি কাস্টমার পেলে কোটি টাকাও হতে পারে।

নাশতা খেয়ে শরীফ বলল, ভাবি অনুমতি পেলে বারান্দায় বসে চা খাব। আমার একটা বদভ্যাস আছে।

তাহমিনার মুখে মিষ্টি হাসি। রাতের তাহমিনা দিনে আরও সুন্দর হলো কীভাবে? শরীফের চোখ যেন ফেরে না। তাহমিনা বলল, বুঝতে পারছি। সিগারেট টানবেন আর চা খাবেন।

শরীফ হাসে। আশেকও হাসল। আশেক বলল, আমি সিগারেট টানতাম। এখন তাহমিনার হুকুমে বাদ দিলাম।

কী আমার হুকুম? তোমার ইচ্ছে হলে খাও।

না, আর কি খাই? একবার যখন তোমার হুকুম তালিম করলাম!

ওরা হাসিতে ফেটে পড়ে।

বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে শরীফ। একটু পরেই তাহমিনা একটা হুইলচেয়ার ঠেলে আশেককে নিয়ে আসে। শরীফ বলল, আপনি কষ্ট করে কেন এলেন? আমাকে ডাকলে তো যেতে পারতাম।

শুয়ে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না ভাই। তা ছাড়া কিছু জরুরি কথা বলতে এলাম। মোটরসাইকেল ঠিক হয়েছে?

ঠিক হয়েছে।

আশেক বলল, আমাদের বাড়িতে কিছু অ্যান্টিক আছে। আমার পূর্বপুরুষের কয়েকজন বংশপরম্পরায় মোগল শাসনামলের প্রথম দিকের যোদ্ধা ছিলেন। তারপর কোনো একজন জমিদার ছিলেন। এখন বংশপরম্পরায় আমি রাবিশ হয়ে তলানিতে ঠেকেছি। আপনি যদি এগুলো নিয়ে বিক্রি করতে পারেন, তাহলে আমার চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা হয়তো হতে পারে। তাহমিনার জন্য খুব খারাপ লাগে। আমাদের বিবাহিত জীবনের সুখ বুঝতে বুঝতেই আমি পঙ্গু হয়ে গেলাম। সে আমাকে ফেলে আর যায়নি। ওকে অনেকবার বুঝিয়ে বলেছি, তুমি আরেকটা বিয়ে করো। আমি তো তোমাকে কোনো দিন সুখী করতে পারব না। সে খুব রাগ করে। তখন আরও খারাপ লাগে। আচ্ছা, বলুন তো একজনের জন্য অন্যজন কেন জীবন উপভোগ করবে না? জীবন কি বারবার আসে?

শরীফ মনে মনে বলল, ওরা মানব না, মহামানব? অ্যান্টিকের সন্ধান পাওয়ার আনন্দ, আশেক-দম্পতির কষ্ট এই দুইয়ের সংমিশ্রণের শরীফ প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

আশেক বলল, আমি তাহমিনার সঙ্গে কথা বলেছি। সেও বলল, তোমার পূর্বপুরুষের স্মৃতির চেয়ে তোমার চিকিৎসা অনেক জরুরি। তাই মনস্থির করলাম এগুলো বিক্রি করে দিতে। আপনি কী বলেন?

শরীফ যেন সংবিৎ ফিরে পায়। বলল, নিশ্চয়ই। আপনার চিকিৎসা সবার আগে প্রয়োজন। জীবন না থাকলে স্মৃতির ভার বইবে কে?

তাহমিনা পুরোনো একটা কাঠের সিন্দুক থেকে কতকগুলো মোগল আমলের অনেকগুলো অ্যান্টিক এনে শরীফের সামনে রাখে।

এগুলো দেখে শরীফের মাথা ঘুরে যায়।

শরীফ হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। ভেতরে ভেতরে তীব্র উত্তেজনা। শরীর ঘামতে শুরু করেছে। ভাবছে এত দামি জিনিস থাকতে কেন এদের এত দুর্দশা? এক অভূতপূর্ব দৃশ্য যেন সে চোখ সরাতে পারছে না, অভূতপূর্ব আকর্ষণ অনুভব করছে এবং দুর্লভ বস্তু প্রাপ্তির আনন্দে তার দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা। শরীফের চোখ পড়ে তাহমিনার দিকে। এক সৌম্যকান্তি, খাঁটি গৌরাবর্ণা নারীর মুখে ক্লান্তির ছাপ সকালের আলোয় ধরা পড়ে।

আশেক ব্রীড়ানত তাহমিনকে বলল, ভাবি আপনি বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

ঠিক আছে ভাই।

আশেক কৌতূহলী ও আগ্রহের দৃষ্টি নিয়ে ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করে, ভাই এগুলো কি বিক্রি করা যাবে?

শরীফ বলল, নিশ্চয়ই। অবশ্যই বিক্রি করা যাবে।

কত দাম হতে পারে?

এসব পুরোনো জিনিসের দামের ঠিক নেই। সবই ভাগ্যের ব্যাপার।

এগুলো কী আপনি কিনতে পারেন?

শরীফ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আপনারা দিলে নিতে পারি।

একটি শব্দই আশেক আর তাহমিনার দৃশ্যত চোখে মুখে এবং অদৃশ্যত অন্তরে খুশির প্লাবন বয়ে যায়। অনেক দিন অযত্নে পড়ে থাকা কাঁসার থালায় জমে থাকা ময়লা তেঁতুল রসে মাজলে যেমন পরিষ্কার হয়ে ঝকঝক করে ঠিক তেমনি অনেক দিনের কষ্টের ছাপ তাহমিনা ও আশেকের মুখ থেকে সরে গিয়ে ঝকঝক করে উঠল। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। তাহমিনা বলল, আমি চা নিয়ে আসি।

আশেক হাসতে হাসতে বলল, ভাই আমার চিকিৎসা তাহলে করতে পারব? আমি তাহলে সুস্থ হব?

নিশ্চয়ই পারবেন। নিশ্চয়ই সুস্থ হবেন।

আমার জীবনের জন্য কোনো দুঃখ ছিল না। দুঃখ হয় তাহমিনার জন্য। আশেক কথাটা শেষ করে আকাশের দিকে তাকায়। তার চোখে পানি।

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আশা করি আপনার চিকিৎসার সুব্যবস্থা হবে। আজ আমি আপনাকে বায়না বাবদ কিছু টাকা দিয়ে যাচ্ছি। বাকি টাকাটা এগুলো বিক্রি হওয়ার পর দেব।

আমি কি চিকিৎসা শুরু করে দেব?

না। যেহেতু চিকিৎসা ব্যয়বহুল তাই সব টাকা হাতে পাওয়ার পর শুরু করবেন। অ্যান্টিক সাধারণ কেনাকাটার মতো নয়। কখনও বিক্রি হতে দেরি হয়।

কত দেরি হতে পারে?

এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। পৃথিবীতে অ্যান্টিকের কাস্টমার খুব কম। শৌখিন আর ধনিক শ্রেণির মানুষের মধ্যে এসব কেনার একধরনের বাতিক আছে। তারাই শুধু কেনে।

ও আচ্ছা।

তাহমিনা চা নিয়ে আসে। দুজনের হাতে দুই কাপ চা দিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আশেক তাহমিনাকে তাদের আলোচনার সারগর্ভ বলল। তাহমিনার চোখে-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র করে শরীফ বায়না বাবদ কিছু টাকা দিয়ে দুপুরের খাওয়ার আগেই বিদায় হয়।

শরীফ আজ যেন বাতাসে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। তার মধ্যে অজানা উত্তেজনা, শিহরণ, রোমাঞ্চ, গুপ্তধন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশের নাগরদোলায় চক্রাকারে ঘুরছে।

কিছু দিনের মধ্যেই অ্যান্টিকগুলো আশাতীত দামে বিক্রি হয়।

 

২.

শরীফের ভেতরের চাপা আগুনটা উসকে ওঠে এবং একদিন সে সিঙ্গাপুরে চলে যায়। ভাবে, ফ্ল্যাট কিনবে, নবিলার নাকের ডগায় ডলার উড়িয়ে বেড়াবে।

সিঙ্গাপুরে ঘুরতে ঘুরতে একদিন নাবিলার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়। শরীফ বন্ধুত্ব করে এবং একদিন নাবিলার স্বামীর বাড়িতে রাতের খাবারেরও নিমন্ত্রণ পায়।

খাবার টেবিলে নাবিলাও বসেছে। তার মাথা নিচু। সারা গা গুলিয়ে আসছে, খেতে ইচ্ছে করছে না। শরীফের বার্তাটা সে পেয়ে গেছে। শরীফ আরও বার্তা দিতে চায়। সে নাবিলার স্বামী ওয়াজিতকে বলল, ভাই, একটা ফ্ল্যাট কিনতে চাচ্ছি। একটু সাহায্য করতে হবে।

ওয়াজিত বলে, নিশ্চয়ই, কেন নয়।

শরীফ বলল, আমি অকৃতদার মানুষ। বড় বাউন্ডুলে। নিজের রুচিজ্ঞান বলতে কিছু নেই। মাঝে মাঝে রাস্তার মোহাজের কুকুরের সাথেও রাত কাটাই। হা হা হা। ভাবি, আমার বাড়িটা কিন্তু আপনাকে পছন্দ করে দিতে হবে।

ওয়াজিত বলল, নিশ্চয় করে দেবে। আমি তো ওর পছন্দেই সব করি।

শরীফ বাড়ি কিনে। শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তির ব্যবসা যা কিছুদিনের মধ্যেই জমজমাট হয়ে ওঠে। আশাতীত মুনাফা হওয়াতে দুবাইয়ে একটা হোটেল প্রতিষ্ঠা করে।

শরীফের উদ্যোগে লন্ডনে পহেলা বৈশাখের একটা ঝমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সে অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁজরের হাড় ভেঙে হাসপাতালে যায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে জীবন নিয়ে ভাবে, শুরু হয় আত্মপীড়ন। আশেকের কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে তাহমিনার কথা। সেই অন্ধকার রাতে যে নারীকে একটা টিউবলাইটের মতো মনে হয়েছিল, যে নারী অচেনা এক পথিককে ঘরে ঠাঁই করে দিয়ে পরম মমতায় রান্না করে খাইয়েছিল, যে পঙ্গু আশেক চিকিৎসার আশায় তাকে অমূল্য অ্যান্টিক দিয়ে দিয়েছিল পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে, তারা এখন কেমন আছে? ধবধবে শাদা বিছানায় শুয়ে থেকে অনুভূতির জানালায় সে দেখতে পায় গ্যাসভর্তি একটা ফাঁপা বেলুন আকাশে উড়ছে তো উড়ছেই। তার গন্তব্য কোথায়? শাদা বিছানাটা তার কাছে কফিনের মতো মনে হয়। নিষ্ঠুর অন্তর্দাহনে সে বিধ্বস্ত হতে থাকে।

লন্ডন থেকে এসে দেখে আশেক বেঁচে নেই। তারপর বাদলের বাড়িটি খুঁজে বের করে আশেক। বাদলের সঙ্গে কথা বলে তাকে রাজি করায় নেত্রকোনায় তাহমিনার বাসাটা চিনিয়ে দিতে।

গাড়িতে বসে বাদল বলল, আফনের কথা ভাইছাবে মইদ্যে মইদ্যে কইত। আফনে যাওনের দুই বছর অইবো ভাইছাব মারা গেল। বাদল অনেক কথা বললেও শরীফের কথা বলতে তার ইচ্ছে হয়নি।

আজ সব কিছু কেন এলোমেলো লাগছে? এত কিছু প্রাপ্তির পরও কেন মনে হচ্ছে জীবন একটা ফাঁপা বেলুন। অসার দিগন্ত শুধু প্রসারিত হয়ে স্থবির নীলাকাশের বৃত্তে হারিয়ে যাচ্ছে। শরীফ মনে মনে স্থির করে তাহমিনাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার সাজাবে।

তাহমিনাদের বাড়ির সামনে গাড়িটি থামিয়ে ভাবছে এ মুখ কীভাবে দেখাবে তাহমিনাকে? বলবে কি যে, অ্যান্টিকগুলো এতদিন পরে বিক্রি হয়েছে? ওরা তো আর বুঝবে না এসব অ্যান্টিক ফ্যান্টিকের রহস্য। কেন মিথ্যে কথন? সত্যকে কেন এত ভয়? মানুষ কি তাহলে সত্যকে ভয় পায়? হ্যাঁ, পায়। আমি একটা কপট, দুষ্ট, মিথ্যেবাদী, হিপোক্র্যাট, প্রতারক, প্রবঞ্চক। ভাবে শরীফ। একপ্রকার গ্লানিতে তার চোখমুখ কালো হয়ে যায়।

তাহমিনা খুব স্বাভাবিকভাবে শরীফের সঙ্গে দেখা করে। কেমন আছেন? তাহমিনা জিজ্ঞেস করে।

শরীফের মনে হয় পাথরের মতো শান্ত, বরফের মতো ঠাণ্ডা এই নারীকে জড়িয়ে ধরে বুকের আগুনকে নিভায়। শরীফ অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারেনি। তাহমিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। শরীফের এ রকম নির্বাক তাকিয়ে থাকাতে তাহমিনা বিব্রতবোধ করে।

শরীফ খুব আস্তে আস্তে বলল, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

ভালো আছি। আশেক মৃত্যুর আগে আপনার কথা খুব বলত। বলত, আমার চিকিৎসার কথা উনি বলেছিলেন। কিন্তু উনি তো আর আসলেন না। হয়তো ওগুলো বিক্রি করতে পারেনি। পুরোনো জিনিস কার ঠেকা পড়ছে কিনতে?

শরীফের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়নি। অনেক কষ্টে বলল, ভাবি, আপনাদের এগুলো বিক্রি হয়েছিল। আমি এখন আশেক ভাই এবং আপনার জন্য কিছু করতে চাই।

এখন আর কী করবেন? মৃত মানুষের জন্য কিছু করলেই কী আর না করলেই কী? এতে মৃতের কী-ই বা আসে যায়?

এটা আমার সান্ত্বনা। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন তার স্মৃতিকে যদি আমরা ধরে রাখি।

তার স্মৃতি আমার কাছেই অনেক বড়। অন্যের কাছে হয়তো নয়।

আপনি অনুমতি দিন তো। আমি উনার নামে একটা স্কুল বা কলেজ করে দেব।

না, তার আর প্রয়োজন নেই। আশেক তো শুধু আমার। শুধুই আমার। আমি যত দিন বেঁচে আছি তত দিন তাকে মনে রাখব।

শরীফের বুকে যেন উত্তপ্ত লোহার তীর বিদ্ধ হয়। শরীফ বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।

কী?

আপনি আবার জীবন শুরু করেন। শরীফ ভাবে, কীভাবে সমর্পণের কথাটা বলা যায়।

না, তা আর পারব না।

দেখেন, আপনি একটু ভেবে দেখুন। শরীফ আকারে-ইঙ্গিতে তাহমিনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।

তাহমিনা শরীফের তাকিয়ে একটু বিদ্রুপের হাসিই হেসে বলল, তা আর হবে না। আশেকের স্থানে আর কোনো মানুষকে আমি ভাবতে পারি না।

শরীফ বাদলের হাতে হাজার খানেক টাকা দিয়ে প্র্যাডো গাড়িটি নিয়ে আস্তে আস্তে ঢাকার রাস্তায় চলতে শুরু করে। তার বুকের ভেতরটা খুব ভারি ভারি লাগছে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu