তরু আমার হতে পারতো, কিন্তু সে কারোর নয়। এতদিন পর তার সাথে হঠাৎ এভাবে দেখা হবে কখনো ভাবিনি, কিন্তু এ যে নিয়তি। অনেকগুলো বাচ্চাকে একসাথে পড়াচ্ছে সে, সাথে মাতৃসুলভ আচরণ। পরনে খয়েরে রংয়ের একটি শাড়ি। অথচ শাড়ি পরার জন্য একসময় কত চেষ্টা করেছে সে, কিন্তু হয়নি। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে, কিন্তু সৌন্দর্য একটুও লোপ পায়নি। এমনিভাবে শ্যামলীর একটি শিশুপল্লীতে তার দেখা মিললো। হা করে তাকিয়ে দেখলাম তার নিষ্পাপ চেহারা, কিছু বলার সাহস পায়নি।
পনের বছর আগের কথা। আমি পড়াশুনার ফাঁকে একটি প্রতিষ্ঠানে পার্ট টাইম চাকুরি করতাম। এখানে অধিকাংশই পার্ট টাইম চাকুরি করেন। বেতন সীমিত কিন্তু আমার খরচ টেনে টুনে চলে যায়। আসলে নিজের ভাললাগা থেকেই কাজটা করতাম। মাস শেষে একটি করে মিটিং ডাকা হতো কর্মকর্তাদের নিয়ে। সবাই সবার সুবিধা-অসুবিধা উত্থাপন করতো। সমস্যা থাকলে প্রতিষ্ঠান সমাধান করার পদক্ষেপ নিত। মিটিংয়ে আমরা সহকর্মীরা একসাথে বসে সামান্য আলাপ বিনিময় চালাতাম। সবাই এখানে আন্তরিক। অল্প কিছুদিনেই সাবার সাথে পরিচিত হয়ে যেতে সমস্যা হয়নি।
সবকিছুই সাধারণ ছিল। হঠাৎ অসাধারণের আগমন ঘটতে পারে তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। চাকুরির বয়স বছর খানেক হয়ে গেল, আমাদের বেতন কিঞ্চিৎ বাড়ল, মিটিংয়ের আহ্বান করা হল। আমরা যথারীতি উপস্থিত হলাম। সেদিন সবাই এসেছিল সাথে অতিরিক্ত একজন। গোল গাল চেহারা, কোঁকড়ানো চুলগুলো বাম কাঁধের উপরে শুইয়ে দেয়া আর গায়ের রং সাদার সাথে হলুদ মিশ্রণ করলে যেমনটা হয় ঠিক তেমন-ই। আমি একনজর দেখেছিলাম মাত্র। সহকর্মীদের কাছ থেকে জেনেছি, সে অফিসে নতুন জয়েন করেছে আর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করে। মা ও ভাই-ভাবির সাথেই ঢাকাতেই থাকে। আমাদের হিসাবরক্ষক সুমন ভাই ‘তরু’ বলে ডাক দেওয়ায় মেয়েটি সাড়া দিল। আমি তার নাম মনে রাখতে ভুল করিনি।
মিটিংয়ের পর কয়েকদিন পর্যন্ত মেয়েটির কথা মনে ভাসত, তার কারণ মেয়েটির সৌন্দর্য। পরে আবার আমি আমার মত হয়ে যেতাম, অতীত আমি। পরবর্তী মাসে মিটিংয়ে তার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছিল। মুচকি হেসেছিল মেয়েটি। আমি তার হাসিতে বিলীন হয়ে যায়নি। তার কারণ এখানে আমার থেকে সুন্দর ছেলে বন্ধুর অভাব হবে না তার। আমার সাথে কথা হতো না তার, যা হতো তা একটু আধটু চোখে চোখ পড়া মাত্র। তার মন চাইলে একটু হাসি দিত, না চাইলে না। আমি নিজেকে একটু গুরুগম্ভীর রাখার চেষ্টা করতাম, যেন কোনো ভাবেই তার সামনে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়। আমার মত বাচাল মানুষের পক্ষে এ কাজটি পাহাড় আরোহণের মতো কঠিন ছিল।
এভাবেই মাস যায় মাস আসে। আর তরুর প্রতি আবার ভাল লাগা চার পাঁচ দিনের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমি দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টাও করি না। আকস্মিক একদিন আমার উপরের কর্মকর্তা আমাকে ফোনে মতামত চাইলেন, হোটেল সোঁনারগাওয়ে পরিবেশ সচেতনতামূলক একটি প্রোগ্রাম হবে, আমি যেতে ইচ্ছুক কিনা? সোঁনারগাও হোটেলে প্রবেশের সুযোগ কখনো ঘটেনি। সুতরাং এ সুযোগ হাতছাড়া করা চলে না। আমি কোন কিছু না ভেবেই ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম। তিনি আমাকে মুঠোফোনে একটি বার্তা দিয়ে দিনক্ষণ এবং সময় জানিয়ে দিলেন। মনে মনে খারাপ লাগতে লাগল যে, মাথার চুলগুলো কেন যে এই সময় ফেলে দিলাম। টাক মাথায় ব্যাপারটা পরিপূর্ণ হবে কিনা।
কয়েকটা দিন আমার অপেক্ষায় কাটল। হ্যাঁ, প্রত্যাশিত দিনের অপেক্ষা। অবশেষে সময় আসল। যথারীতি সময় অনুযায়ী উত্তেজনা নিয়ে আমি হোটেলের পশ্চিম পার্শ্বের দরজায় উপস্থিত হলাম। সেখানে আরেকজন সহকর্মীর সাথে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমি সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কি শুধু আমরা দুইজন, আর কেউ আসবে না?” তিনি বললেন, আর দুই একজন আসতে পারে, তবে কারা আসবে তা আমি নিশ্চিত নই। ভিতরে ঢুকেই আমি থমকে গেলাম। একি! এতো তরু আর তুলি। আমার ভাল লাগা পূর্ণতা পেল। খোলা চুলে আমাদের সামনে এগিয়ে আসছে তরু এবং তুলি। আমি নিজের দিকে ফের তাকালাম। হুম আমিও ফিটফাট। শুধু মাথায় চুল নেই। যাই হোক, তাদের সাথে আমাদের সালাম বিনিময় হলো। দুএকটি কথাও হলো। আমরা একসাথে ভিতরের কক্ষে প্রবেশ করলাম। পাশাপাশি বসলামও কিন্তু কোনো কথা নেই। মাঝে মাঝে অতি প্রয়োজনীয় দুএকটি কথা না বলে উপায় থাকলো না। প্রোগ্রাম চলাকালীন আমাদের পরিচালক মহোদয় আসলেন। আমাদের পাশেই বসলেন। কিভাবে কি করতে হবে তার দিক নির্দেশনা দিলেন। প্রোগাম শেষে চা, কফি আর নাস্তার আয়োজন ছিল। একটি টেবিলকে কেন্দ্র করে পরিচালক মহোদয়সহ আমারা পাঁচজন খাবার গ্রহণ করছিলাম। অনেক নিকট থেকে তরুকে দেখে আমাকে আর আমার ভিতর রাখার সাধ্য ছিল না। হয়তো কারোর-ই থাকে না। তরুর সাথে এই প্রথম এত ঘনিষ্ঠ সময় পার করলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে অপ্রস্তুত লাগত। আমি কদাচিতৎ দুএকটি সারগর্ভ বাক্য উচ্চারণ করতাম। সেগুলো আবার বিশ্লেষণ ও করতে হতো।
এদিকে, আমাদের সব কাজ সম্পন্ন হলো। এবার হোটেল থেকে বের হবার পালা। “একি সন্ধ্যা হয়ে গেল যে। তরু এবং তুলি তোমাদের যেতে সমস্যা হবে না তো।” পরিচালক মহোদয় প্রশ্ন করলেন। না কোনো সমস্যা হবে না স্যার, তরু জবাব দিল। তোমরা তাহলে মেয়ে দুটোকে একটু গাড়িতে তুলে দিও কেমন? জ্বী স্যার, আমরা উত্তর দিলাম। সেদিন বিদায়ক্ষণটা আমার জন্য ছিল অতি মধুর। বিদায়বেলায় সাবার মনই একটু নরম হয়। একটু সহানুভুতিও উদয় হয়। গাড়িতে উঠে তরু এক নজর তাকিয়েছিল, তা ছিল মায়ায় ভরা।
নিজের কাছে এখন মনে হয়, বিষয়টা সামনে অগ্রসর হলে মন্দ হয় না। আমি তরুর ফেইসবুক আইডি খুঁজে তাকে নক করেছিলাম। সে ইতিবাচক উত্তরও দিয়েছিল। মনে ভাবলাম, এখন তরুকে একটু বেশিদিন মনে রাখার একটা অজুহাত পাওয়া গেল। অনলাইনে তরুর সাথে কথা বলার চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখিনি। তরু বেশি কিছু বলতো না। আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর করতো মাত্র। আর সৌজন্যবোধ বজায় রাখার জন্য যে কথাগুলো বলা দরকার সেগুলো বলতে ভুল করত না। ধীরে ধীরে আমরা পরিচিত হলাম।
অনলাইনে আমাদের প্রায় কথা হলেও মুখোমুখি কথা বলতে লজ্জাবোধ হতো। একে অপরের দিকে মুচকি হাসতে জানতাম শুধু আর কিছুই নয়। ইতোমধ্যে অফিসের অনেকেই আমাদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে শুরু করল। আমি তাতে মোটেও রাগ করার প্রয়োজন বোধ না করলেও তরু একটু আধটু ক্ষেপে যেত। আমি তরুকে চুপ থাকতে বলতাম। সেও আমার কথা শুনতো। আমাদের ভিতরে কি যেন ঘটতো আমি তা বলতে পারি না। তরুর সামনে অবস্থানকালে আমার মুখ কথা বলার সাহস পেত না। দুনিয়ার শত জড়তা উপস্থিত হতো তখন। তার মনের ভিতর তখনো ঢুকার সুযোগ হইনি আমার কিন্তু চেষ্টা চলছিল।
কিছুদিন পর প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্রমণের আয়োজন করা হলো। সাবার উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক নচেৎ সামান্য জরিমানা গুনতে হবে। তরু অনেক আনন্দিত হলো। ঘুরতে যাওয়ার অনেক সখ তার। সে অবশ্যই পরিচালক মহোদয়ের কাছে আরজি করেছিল দীর্ঘস্থায়ী ভ্রমণের আয়োজন করা যায় কিনা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্টদের সুবিধার্থে একদিনের একটি ভ্রমণের আয়োজন করা হলো। একটি কাছের সহকর্মী বন্ধু আমাকে খোঁচা দিয়ে আমার আর তরুকে নিয়ে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিল। আমি শুধু হেসে দিলাম। তরু এবং আমাকে নিয়ে মানুষ কানাঘুষো করলে আমার খারাপ লাগতো না বরং আনন্দ অনুভব হয় এই ভেবে যে, মানুষ আমাদেরকে স্বীকৃতি দিতে অতিশয় আগ্রহী।
দিনের পর দিন পার হয়ে ভ্রমণের দিন চলে আসল। ভ্রমণের বাস নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থান করায় আমরা কয়েকজনকে সবার আগে সিট দখল করতে দেরি করিনি। এক সহকর্মীর জন্যে অপেক্ষা করায় দেরি হয়েছিল। আমরা অনেক বিরক্ত হয়েছিলাম। সে যদি ছেলে হতো তাহলে উপরমহল তাকে সতর্ক করতে পারত কিন্তু সে মেয়ে, সাবার কাছে নরম দৃষ্টির পাত্র। যাই হোক, আমরা সবকিছু প্রস্তুত করে রওনা দিলাম। বাসের ভিতরে এখনো সবার আগমন ঘটেনি। সামনে থেকে একে একে সবাই উঠে পড়বে। বিশেষ করে মেয়ে মানুষের আগমন না ঘটলে অনেক কিছু ঠিক জমে না, এমনটা অনেকের ধারণা হলেও বিষয়টি একেবারে ফেলনা নয়। হঠাৎ গাড়ি থামল। তিনজন মেয়ে সাথে দুইটা পুরুষ গাড়ির অন্তরে পা দিল। আমি শুধু একজনকেই মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, যাকে দেখতে আমি অতি ব্যাকুল; সে তরু। আমি ডানপাশের সিটে বসে আছি। তরু আস্তে করে আমার বিপরীত পার্শের সিটে বসতে ভুল করেনি। “পাঞ্জাবিতে অনেক ভাল লাগছে আপনাকে। স্যুট বুট বাদ দিয়ে মাঝে মাঝে একটু পাঞ্জাবি পরবেন, দেখবেন অনেক সুন্দর লাগবে।” তরু মাথা নিচু করে ফিস্ ফিস্ করে বলল আমাকে। তরুর এইরূপ কথায় অস্বাভাবিক ভাল লেগেছিল আমার। আমি প্রত্ত্যুত্তরে শুধু ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। আমার কাছাকাছি সিটে বসায় অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল তাকে।
এদিকে, বাসের ভিতরে সবাই নানারূপে আনন্দ করতে লাগল। কেউ কেউ আবার অন্যদের আনন্দ দিতে ব্যস্ত। কেউ গান, কেউ কবিতা, কেউ কৌতুক যে যেভাবে পারছে মজা সৃষ্টি করছে। হঠাৎ সবাই তরুকে পাকড়াও করলো কিছু একটা উপস্থাপন করার জন্য। সে নারাজ হওয়াতেও কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে সে রাজি হলো। সে নেচে তা ধিন ধিন করতে চায়, তবে শর্ত হলো তার একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আমি ভাবলাম আমার মাথা কাটা যেতে পারে। আত্মরক্ষার জন্য মাথা নিচু করে রইলাম। একটু মুখ উঁচু করে তরুকে উদ্দেশ্য করে না বোধক মাথা নাড়ালাম যেন সে আমাকে না ডাকে এই আত্মহননের পথে। হঠাৎ আমার দুপাশ ধরে টানাটানি পড়ে গেল। একি টানাটানি কেন করছো? আরে তরু তোমার সাথে নাচতে চাই, সকলের একত্রে উত্তর। আমি হয়তো মনে মনে এটাই চেয়েছিলাম। আমি নাচতে জানি না তবে তরু অন্যজনের সাথে নৃত্য প্রদর্শন করবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। কিন্তু কেন? তরু আমার কে আর আমিই বা তরুর কে? এত প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই তবে এতটুকু বলতে দ্বীধা হয় না যে, তরু আমাকে জুড়ে নিতে বসেছে, আমি তরুতে পরিণত হতে বসেছি। যাই হোক, আমি অনিচ্ছাকৃত কোমর দুলোনোর চেষ্টা চালালাম। যতটুকু কোমর দোলানো হল তার থেকে বেশি লজ্জাবোধ পেয়ে বসল আমাকে। তরু যেন আমাকে লজ্জার অতল গভীরে ফেলে এক পৈশাচিক শান্তি অনুভব করছে। তার লোক লুকানো হাসি তাই প্রামাণ করে। এক পর্যায় সবকিছু শেষ হলো। আমরা গন্তব্যে পৌছালাম। সেখানে অনেক আনন্দে সময় কাটল আমাদের। তরু আমার সাথে ছবি তোলবার জন্য কয়েকবার আবেদন করেছিল কিন্তু তা না হওয়ায় সামান্য মনঃকষ্টে ভুগেছিল মেয়েটি। মনে মনে হয়তো আমাকে তিরস্কার করতে ভুল করেনি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল এবং আমদের ফেরারও সময় হলো। সবাই বাসে চেপে বসল। বাস চলতে শুরু করলো। কিছুদূর আসার পর সাময়িক বিরতির জন্য একটি তেল পাম্পে বাস রাখা হল। সবাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নিচে নেমে পড়ল। আমিও নামলাম কিন্তু কাজ নেই, তেল পাম্প ঘুরে দেখছি। হটাৎ কী মনে করে আমি বাইরে থেকে বাসের জানালার কাছে গিয়ে বললাম, তরু, এই তরু নিচে আস। এতদিনে আমি তরুকে তুমি বলি। আর তরু এখনো আপনি বলেই সম্মোধন করে আমাকে। হইতো বয়সের কিঞ্চিৎ গরমিলের কারণে এমনটা হয়। যাই হোক, কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই সে নিচে নেমে এল। কাছে এসে মৃদু হেসে বলল, কিছু বলবেন? আমি তুহিনকে তার ক্যামেরা আনতে বললাম আমাদের ছবি উঠোনোর জন্য। তরু আমার পাশে দাঁড়াল। তুহিন আমাদের আর একটু নিকটবর্তী হতে বলল। আমি ধমক দিলাম, “ঔই যেমনে আছি তেমনে উঠাও।” ছবি তোলা শেষে তরু আমাকে ধন্যবাদ দিল আর আমি দিলাম তুহিনকে। ছবিগুলো যেহেতু তুহিনের কাছেই ছিল, সেহেতু এই ছবি নিয়ে তুহিনের একটু ইচ্ছাকৃত ঝামেলাসূচক আচরণ অস্বাভাবিক নয়। তুহিনের আর বুঝতে বাকি রইলো আমাদের ভিতর কী হচ্ছে। তরু ছবিগুলো নেওয়ার জন্য আমাকে অনেক বলেছিল। আমার অসাধারণ ভাল লেগেছিল আমার প্রতি তার আগ্রহ দেখে।
দিনে দিনে আমরা আবেগের অন্তরে প্রবেশ করতে লাগলাম। ভ্রমণের পর থেকে আমরা মানসিকভাবে অধিক কাছাকাছি বিচরণ করছিলাম। সে আমাকে ক্ষণে ক্ষণে ফোন কল করত। আমিও কঠিন বিপদের ভিতরেও কথা বলতে দ্বীধা করতাম না। দিনের চব্বিশ ঘণ্টা আমরা কে কি করতাম তা উভয়েই অবগত থাকতাম। সামনে এগোনো থেকে বিরত থাকার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। ক্রমশ গভীরে প্রবেশ করেছি।
একবার আমাদের প্রতিষ্ঠান হতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে ফেরার পথে আমি আর তরু একসাথে রিকসায় চড়েছিলাম। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠেছিল আমার সেদিন। আমি রিকসায় বসে সোজাসুজি তাকিয়েছিলাম। এত নিকট থেকে তরুকে দেখার সাহস আমার লজ্জাকে অতিক্রম করতে পারিনি। হঠাৎ তরু আমার হাত ধরে বসল। আমি চমকে উঠলাম। এই ভার আমি এখন কিভাবে সইবো। কিন্তু এ ভার সয়ে যায় কারণ, এ ভার যে সুখের ভার, এ বোঝা যে আনন্দের বোঝা। তার কোঁকড়ানো চুল আমার শরীরে এসে স্পর্শ করছিল। আমি তা নাকের অগ্রভাগে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। তরু আমাকে বলেছিল, পাগল একটা। চুল শুখে কি পাও? আমি প্রত্ত্যুত্তর করেছিলাম, তোমাকে পাই।
এমনিভাবে আমরা একে অপরের হয়ে গেলাম। আমার সব কিছুতে যেমন তার অধিকার ফলিত হতো ঠিক তেমনি তার সবকিছুতে আমার অধিকার ফলিত হতো। আমরা এখনো কেউ কারোর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়নি, কেউ কাওকে কাছে আসার কিংবা ছেড়ে না যাওয়ার কথাও দেইনি, একজনের মৃত্যুতে আরেকজনের সহমরণে যেতে চাইনি, একজনের অপ্রাপ্তিতে অন্যজন ধ্বংস হতে চাইনি। এতো কিছু না চাওয়ার মাঝেই যেন আমরা সবকিছু চেয়ে ফেলেছি। মৌখিক কোন চুক্তি আমাদের না হলেও মানসিকভাবে যেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চুক্তিতে আমরা আবদ্ধ।
মাঝে মাঝে আমার অদ্ভূত লাগত। তরু আমাকে প্রায়ই বলত, সে প্রথম একটি বিয়ে করবে তারপর স্বামীকে তালাক প্রদানের পর অন্যজনকে বিয়ে করবে। এত সব জেনে শুনে যে তার হাত ধরতে রাজি হবে তাকেই সে সারাজীবনের জন্য আপন করে নেবে। আমি তাকে বার বার বোঝাতাম, কেন এসব বলছো তরু? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? কিন্তু তার চিন্তা ধারারা কোন পরিবর্তন আনতে আমি সক্ষম হয়নি।
তরুর একটি সখের কথা আমাকে প্রায়ই বলত, সে গৃহ সংসার ছেড়ে দূরে চলে যাবে আর অনেকগুলো বাচ্চা মানুষ করবে। এই বাচ্চাগুলোই হবে তার বেঁচে থাকার পাথেয়। তার এসব চিন্তায় আমি সায় দিতাম। আর বলতাম, দেখো সেদিন আমিও তোমার সাথে থাকব।
আমি ভাবতে বাধ্য হতাম তরু কি আসলে মানসিকভাবে সুস্থ। কেন তার মনে এমন অদ্ভুদ চিন্তার উদয় হয়। তবে, সবকিছুর উত্তর আমি পেয়েছিলাম, নিষ্ঠুরভাবে পেয়েছিলাম।
সবকিছু ঠিকমত চলছিল। হঠাৎ একদিন সন্ধায় তরুর ফোন আসল। তরুর ফোন সারাদিনব্যাপী আসাটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু কিছু সময় কথা বলার পর তরু আমাকে বললো– তোমাকে একটা কথা বলবো।
অনেকদিন হলো তরু আমাকে তুমি করে ডাকে।
আমি বললাম– হ্যাঁ, তরু বলো।
– তুমি কি মানসিকভাবে প্রস্তুত?
– হ্যাঁ প্রস্তুত, একটু আগ্রহ নিয়ে বললাম।
আমি ভাবলাম, হয়তো সেই বহুল প্রত্যাশিত বাক্যটিই এখন তরু তার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে যাচ্ছে।
– তুমি রাগ করবানোতো? আর আমাকে খারাপ ভাইবো না প্লিজ।
– কী হইছে সেটা তো বলো।
– আসলে আমার এখন নিজের ফিল হচ্ছে যে, কথাটা বলা উচিত যদিও নিজেকে অপরাধী লাগতেছে অনেক।
– বলবা তুমি? আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম।
– আমি বিবাহিত। অপরাধীর স্বরে তরু বলল।
– কী বললা তুমি তরু?
– তুমি শান্ত থাইকো প্লিজ। সব দোষ আমার। আমাকে তুমি অনেক অনেক গালি দাও। তাইলে তোমার রাগ কমবে।
আর কোনো কথা বলার শক্তি আমার সেদিন ছিল না। তরু অনেক অনুরোধ করেছিল আমাকে সেদিন, আমি যেন ফোন না কেটে দিই, উল্টাপাল্টা কিছু না করে ফেলি। সেদিন আমি তরুকে নির্লজ্জের মতো বলেছিলাম, আমাকে ভালবাস তরু? তার উত্তর ছিল, সে জানে না। সেদিন তরু আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি আমার সাথে আর কথা বলবা না কোনোদিন? আর কোনদিন যোগাযোগ করবা না? আবি বোবার মতো শুনেছিলাম শুধু, উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।
এতদিন দুইটি পাহাড় বিশাল এক রাশি দন্ড দ্বারা সংযুক্ত ছিল, কিন্তু আজ হঠাৎ একটি দানব এসে বিশাল এক অস্ত্র দ্বারা তা দ্বিখন্ডিত করে দিল। সব কিছু যেন সমুদ্র তীরে বালু দ্বারা তৈরি স্বপ্নগুলোকে এক ঝলক ঢেউ এসে তা সমুদ্রে ম্লান করে দিল। তরু এত দ্রুত পর হয়ে যেতে পারে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। আমি জানি না তরুও আজ থেকে আমার মত করে চিন্তা করছে কিনা। আমি প্রায় এক সপ্তাহ ঠিকমতো খাবার খেতে করতে পারিনি আর ঘুমোতে গেলেই মাথার ভিতরে তরুর চিন্তারা মিছিল দিয়ে বসত। অদ্ভুত কষ্টকর সময় পার করেছিলাম আমি।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। কেন তরু সব কিছু জেনে শুনে আমার সাথে এমনটা করল। আর কেনই বা সে এখনো আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাই। একে একে সবকিছুর উত্তর আমি পেয়েছিলাম ।
আমাদের ফের যোগাযোগ করার প্রয়োজন হয়নি, কেননা কোনো কিছু ভাঙ্গার পরেই তো গড়ার আয়োজন হয়। আমি বরংবার তরুকে বলতাম, কী লাভ বলো তরু আর যোগাযোগ করে? তরু বলত, মানুষ কি শুধু লাভের জন্য সবকিছু করে? বিনা লাভে কি কেউ কিছু করে না? এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমার জ্ঞানগত হলেও উত্তর দিতে পারিনি। আমি তরুর কথা উপেক্ষা করতে না পেরে এবং নিজের ইচ্ছার বিপক্ষে অবস্থান না করে নিজের অজান্তেই ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ফেললাম। এভাবেই আগের মতো প্রাণ ফিরে পেল দুটি অস্তিত্বের। কোনো উপরি পাওনার আকাঙ্খা নেই তাতে, নেই কোনো সুখেরে মিলনের পরম সুখ।
তরু অনেক আগে থেকেই বার বার বায়না ধরতো আমার ক্যাম্পাসে আসার জন্য। ক্যাম্পাস অনেক ঘুরে দেখার সাধ তার। কিন্তু আমি নানা রকম অজুহাতে তাকে বিরত রাখতাম । এই বিরত রাখাকে আমি দীর্ঘস্থায়ী করতে পারিনি। একদিন আমার স্বদিচ্ছায় সে এসেছিল। আমি তাকে ক্যাম্পাসের বেশ কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলাম। কার্জন হল প্রাঙ্গণে ঘুরতে নাকি অনেক ভাল লেগেছিল তার। রিকসা চেপে যখন তরুকে বিদায় দিতে গিয়েছিলাম আমার কাঁধে মাথা রেখে সে বলেছিল, তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারো না? হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বলার সাহস হয়নি আমার। আমি আরেকজনের স্ত্রীকে নিজের স্ত্রীতে রুপান্তরিত করব সে অনুমতি আমার বিবেক আমাকে দেয়নি। তাহলে কি আমি একটা সম্পর্কের মূল্য দিতে অপারগ, আবেগের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে? এসকল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি বরং মনে করি যে, কোনো সৃষ্ট জিনিস ভেঙ্গে তা হতে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নতুন কিছু সৃষ্টি করার চেয়ে নতুন কাঁচামাল দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করাটাই অধিক উত্তম। যাই হোক, দিনশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বিদায় দিতে হয়েছিল। বাসের জানালা দিয়ে শেষ পলকটি পর্যন্ত তরু আমাকে দেখেছিল। আমার মন বোধহয় সেদিন তাকে অধিক আপন ভেবে ফেলেছিল কিন্তু আমি সে ভাবনার লাগাম টেনে ধরেছিলাম।
নিজেকে নানাভাবে বোঝালেও অস্বীকার করার জো নেই যে আমি পরকীয়ায় লিপ্ত। কিন্তু আমার কাছে কখনো তা মনে হয়নি, আর বুঝি তা মনে হয়ও না। আমি রহস্য উন্মোচন করতে ব্যাকুল হয়ে পড়লাম, কেন সবকিছু থাকার পরেও তরু আমাকে চাই। তাহলে কি তরুকে চরিত্রহীন বলবো। না, তাও তো আমার মনে হয়নি। হ্যাঁ, এসবের উত্তর তরুই আমাকে দিয়েছিল।
কয়েক বছর আগের কথা। মাধ্যমিক পাস করার পর পাশের বাড়ির সুদর্শন একটি ছেলের সাথে বিয়ে হয় তরুর। কার্যত ছেলের চেয়ে ছেলের বাবাই বেশি পছন্দ করেছিল তরুকে। অনেক দিন যাবৎ মেয়েটিকে দেখেছে ভদ্রলোকটি। তার চোখের সামনে থেকে এত সুন্দর চরিত্রবান মেয়েকে হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছা-ই ছিল না তার। এদিকে তরুর বাবা কন্যা দায়মুক্ত হওয়ার তালে ব্যতিব্যস্ত, কারণ ছেলে হাতছাড়া হলে ছেলে মেলা কঠিন। তরুর কিঞ্চিৎ অমত ছিল বিয়েতে, কারণ সে পড়ালেখা করতে চায়, বিয়ে করে সন্তান উৎপাদন নয়। তার ধারণা বিয়ে মানেই পড়ালেখার ইতি টানা। কিন্তু পাত্রপক্ষ তরুকে পড়ালেখা অব্যহত রাখার ব্যপারে আশ্বস্ত করেছিল। আর তাতেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল, সাথে সাথে বিয়েটাও। সবকিছু অতি মধুর চলছিল কিন্তু গন্ডগোলটা বাধলো বছর খানেক পর। তরুর শশুর মশাই এখন আর তরুর পড়ালেখার ভার বহন করতে রাজি নন। যাবতীয় ভরণ-পোষণ আর অন্যদানের পর লেখাপড়ার বাবদ অতিরিক্ত পয়সা খরচ তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে অবশ্যই তরুর বর মাহিনের কোন বক্তব্য ছিল না। কারণ, সব ব্যাপারে তার শ্রদ্ধেয় পিতা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। তরু তার পড়ালেখার স্বার্থে আপন পিতৃগৃহে গমন করতে বাধ্য হলো। এদিকে তরুর বাবা তরুর বিয়ে কার্য শেষ করেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন জীবিকার জন্যে। সমস্ত সিদ্ধান্ত তাকে সেখান থেকেই নিতে হচ্ছে। তরু তার বাবার বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি যায় না প্রায় এক বছর হলো, কিন্ত অপরপক্ষ তরুর কোনো প্রয়োজনই বোধ করছে না। তরুর বাবা বাড়িতে আসল এবং তরুকে মাহিনের নিকট থেকে আনু্ষ্ঠানিকভাবে আলাদা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মাহিন হলো তরুর আত্মসচেতনতাহীন স্বামী। এমতাবস্থায় ছেলের পিতা হাজির হলো তার ছেলে বউ ভিক্ষা চাইতে। অনেক আকুতি শেষে তরুর বাবা তরুকে ফের মাহিনের ঘরে পাঠালেন এবং তরুর পড়াশুনার শর্ত আবার পুনর্বহাল হলো।
মাহিন একটু বেখেয়ালি প্রকৃতির মানুষ হলেও বেশ কয়েকবার সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল। তরু তা চতুরতার সাথে মোকাবিলা করেছিল, কারণ, সে মনে করে, কোলে সন্তান আসা মানেই গৃহবদ্ধ হয়ে পড়া যা তরু কখনই চাই না। সংসার, শ্বশুর, শাশুড়ি সবকিছু ঠিকঠাক রেখে চলা তরুর পক্ষে অসম্ভব হতো না, যদি না তার মাথায় পড়াশুনার ভূতটা বাঁসা না বাঁধতো। সে যে পড়াশুনায় অনেক ভাল ছিল ব্যাপারটা একদমই তা নয়, কিন্ত আগ্রহের কমতি ছিল না।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হলো কিন্তু তরুর ঘাড়ের ভূত যায়নি। সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায়। দেশের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোত পড়ার সুযোগ হয়নি তার। তাতে কি, যেভাবেই হোক পড়ালেখা সে করবেই। সে সিদ্ধান্ত নিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু এ তো তরুর পক্ষে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা কিনা মাধ্যমিকের পড়ালেখার খরচ বাঁচাতে তরুকে তার বাবার কাছে পাঠাতে দ্বিধা করেনি, তারা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে পড়াবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে? সে কথা তো ভাবাই পাপ। যা হবার তাই হলো। তরুকে আবার তার আপন জায়গায় ফিরে আসতে হলো। তবে এবার ছেলেপক্ষরা গরুর দড়ি হাতে রেখে গরুকে মুক্ত করে দিল। তার মানে, তরু যখন পড়ালেখা শেষ করবে তখন আবার তারা তরুকে স্বাগতম জানিয়ে আপন গৃহে বরণ করবে এবং লেখাপড়া চলাকালীন সময়ে তরু মাঝে মাঝে তার স্বামীগৃহে এসে স্বামী মাহিনকে পরিতৃপ্তি করে যাবে। কথাটি কটু শোনালেও এর কার্যকারিতা প্রস্তর। এ যেন মাছরাঙ্গার ক্ষুধা লাগলে পুটি মাছ আপনা আপনি পানি ত্যাগ করে মাছরাঙ্গার বাসায় সওয়ার করবে মাছরাঙ্গার ক্ষুধা নিবারণের জন্য।
এভাবেই চলছিল তরুর জীবন। বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি, আবার শশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি। এ যেন একটি প্রাণীকে দুইটি রশি দিয়ে বেধে দুপ্রান্ত থেকে টানাটানি করা।
তরু আমাকে বারবার বলত যে, মাহিনের সাথে মন মানসিকতার কোন মিল সে খুঁজে পায় না। তরুর ভাললাগা খারাপ লাগাতে মাহিনের কিছু আসে যায় না। তরু যেটা চায় মাহিন সেটা চায় না। তরুর অনেক ইচ্ছা দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশুনো করার, কিন্তু সেটা ইচ্ছাতেই বেশি শোভনীয়। মাহিন এবং তার পরিবার শুধু দেশ ত্যাগের ঘোর বিরোধী তা নয়, গৃহ ত্যাগেরও। তবে তরু এখনো সে আশার কবর দেইনি, জিইয়ে রেখেছে মনের গভীরে। যেদিন-ই সুযোগ পাবে বিদেশ পাড়ি জমাবে সে, তাতে কার কি আসে যাই তা দেখার সময় তার নেই।
এদিকে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তরু বহুবার বিবাহ বিচ্ছেদ কামনা করেছে মাহিনের কাছে কিন্তু মাহিন তাতে ‘হ্যাঁ’ আথবা ‘না’ কোনটাই বলেনি। সে শুধু বলেছে, “তোমার ভাল না লাগলে চলে যেতে পার, কাগজপাতি রেডি করে পাঠিয়ে দিয়ো আমি স্বাক্ষর করে দিবো”। কিন্তু ঝামেলাটা ছিল তরুর বাবাকে নিয়ে। তিনি চাইতেন যত ঝামেলাই হোক না কেন তরু যেন তালাকের কথা মুখে না আনে। এমন চিন্তাধারা দেখে আমি মোটেই অবাক হইনি কোনো দিন, তার কারণ, অধিকাংশ অভিভাবকরা যেখানে আইবুড়ো মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে নাকাল হন সেখানে বিয়ে ফেরত মেয়ে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করাই বাতুলতা বই আর কি। আজ যদি আমি একজন কন্যার পিতা হতাম তাহলে যে তরুর বাবার সিদ্ধান্তের বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম তা আমি বলতে পারি না। কিন্তু, তরুর দুঃখ কষ্ট দেখার একমাত্র দায়িত্ব যে তার পরিবারের উপর ন্যাস্ত তা অস্বীকার করা যায় না। মেয়ের ভাল খারাপ বিবেচনা করার দায়িত্ব যে বাবার ঘাড়ের উপরে তা হয়তো তরুর বাবা ভুলে যাননি কিন্তু মেয়ের বৈবাহিক জীবনের চিন্তটাই তার মাথায় বেশি বিরাজ করতো।
এদিকে তরুর একটা দায়িত্বহীন বড় ভাই ছিল, যে কিনা একটি চাকরিও করত কিন্তু বোনের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সামান্য সময় তার ছিল না। এমনকি যে তরুকে এমন কথাও বলতো যে, “তোকে বিয়ে বিয়ে দিয়েছি এখন আমাদের কাছে থাকিস ক্যান তোর শশুর বাড়ি থাকতে পারিস না?” এরূপ কথা শুনে তরুর খারাপ লাগতো না কারণ, এসব তার নিত্য দিনের শ্রব্য কথা। এসবের ভিতরেও তরুর বাবা তরুর সমস্ত খরচ বহন করত। তিনি চাইতেন তরু পড়াশুনা শেষ করে আবার মাহিনের কাছে ফিরে যাক, কিন্তু তরু সর্বদা মাহিন থেকে মুক্তি চাইতো। এই রসহীন মানুষটিকে একদম দেখতে ইচ্ছে করে না তার। তারপরেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে যেতে হতো মাহিনের কাছে নইতো বাবা যে রাগ করবেন। আশ্চর্য বিষয় হলো, তরু দীর্ঘ তিন বছর তার বাবার সাথে কথা বলে না। কারণ একটাই, কেন তার বাবা তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে আবার মাহিনের কাছে পাঠিয়েছিল।
একবার তরু মাহিনের কাছে একটি উপহার আবদার করেছিল এই কারণে যে, উপহার দেওয়া নেওয়া করলে নাকি সম্পর্ক তৈরি হয়, কিন্তু অলস মাহিনের তার বউয়ের জন্য একটা উপহার কিনার সৌভাগ্য হয়নি। এমনিভাবে তরু অনেক চেষ্টা করেছে দুইজনের ভিতরে একটি ভাল সম্পর্ক তৈরি করার, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। এভাবে দিনের পর দিন তরু আমাকে তার জীবনের সুখ দুঃখ বর্ণনা করত আর আমি অবাক হয়ে শুনতাম।
তরু যেন বনের ভিতরে বসবাস করে, যেখানে তার কোন বন্ধু নেই। এই ভয়ংকর জগৎ থেকে মুক্তি চাই সে, আর এই মুক্তিদাতা যেন একমাত্র আমি। তরু আমাকে বারবার বলত, “তুমি আমাকে বিয়ে করবা না, তার কারণ আমি বিবাহিত, তাই না বলো? কিন্তু আামি সবকিছু ছেড়ে তোমার আশ্রয় গ্রহণ করতে চাই। বলো দিবে না আমাকে আশ্রয়?” সে আমাকে কখনো বাধ্য করতো না বিয়ে করার জন্য, নিরীহর মতো বলতো শুধু। কিন্তু আমি যে স্বার্থলোভী একজন অক্ষম পুরুষ তা নয়। সমাজ আমাকে তরুর কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছে। এ সমাজ যেমনি কোন নারীকে সুখে রাখতে তার সংসার ভাঙনকে সমর্থন করে না, ঠিক তেমনি একজন বিবাহিতা নারীর সাথে অবিবাহিতা পুরুষের মিলনকেও নয়। এ দুটির দ্বিতীয়টি অপেক্ষা প্রথমটি অধিক নিন্দনীয়। আমরা সমাজে বাস করি তাই সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে নিজ আত্মার উপর অহর্নিশ নির্যাতন করে ফেলি, কিন্তু সে নির্যাতনকে সবাই বাহবা দিয়ে দিব্যি দিন পার করে দিচ্ছে, আর যেই না কেউ তার বিপরীত কিছু করে তাকে তার আত্মার সাথেই সারাজীবন বাস করা লাগে, সমাজের সাথে আর থাকা চলে না। গ্রামের পঞ্চায়েত গ্রাম ছাড়া করবে অথবা একঘরে করতে দ্বিধা করবে না। অতএব, আমি তরু থেকে মুক্তি পেয়ে সমাজে টিকে থাকতে চাই, কিন্তু নিজের ভেতরটা বার বার এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আবেগের গলা টিঁপে যুক্তিকে টিকিয়ে রাখতে আমি আজ বদ্ধ পরিকর।
জীবনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম আর ফোনের সিম কার্ডটার অবস্থান হয়েছিল ডাস্টবিনে। তরুর সাথে সমস্ত যোগাযোগ চিরতরে বন্ধ করে দিলাম। জানি না কয়েকটা দিন তরুর অবস্থা কেমন ছিল, তবে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না। অনেক বন্ধুকে ফোন কল করে কান্নাকাটি করতাম। সবাই সবার মতো করে স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু আমার একটাই স্বান্ত্বনা ছিল, তা তরু। শরীরের অবস্থাও বেগতিক হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সময় হলো সব চেয়ে বড় প্রতিষেধক। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে গেল, সব ঠিক হয়ে যায়।
তারপর পনের বছর কেটে গেল। একটি সরকারি চাকুরি করি আমি। চাকুরির সুবাদে পটুয়াখালি থাকতে হয়। দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিতে বন্ধু আতাউরের সাথে ঢাকা আসলাম বেড়াতে। শুক্রবারে নামাজ শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর বন্ধু বলল, চল আজকে একটু ভ্ন্নি জায়গায় নিয়ে যাই তোকে, মন ভাল হওয়ার মতো যায়গা। আমি বললাম, চল। গেলাম শ্যামলীর একটি শিশুপল্লীতে। সব ঘরগুলো একটি একটি করে দেখছি। কোথাও বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, কোথাও আবার পড়াশুনায় ব্যস্ত। হঠাৎ জানালার ভিতর দিয়ে একটি ঘরের ভিতরে আমার চোখ আঁটকে গেল। একি, এতো তরু! আমি থমকে দাঁড়ালাম। তরু এখানে? অনেক প্রশ্ন হাজির হলো মনের ভিতরে। কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে আমি শুধু দেখছি তাকে, নাম ধরে ডাকার অধিকার আমার নেই। চিন্তাগুলো মুহুর্তের ভিতরে পনের বছর আগে ফেরে গেল। সবকিছুই কল্পনা করতে শুরু করলাম। তরু সত্যিই তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে ফেললো? ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে মৃদু পানির আগমন হলো। “কিরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখিস?” আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় বন্ধু পিছন ফিরে ডাক দিল। আমি ধড়ফড় করে উত্তর দিলাম, “কিছু না, দাঁড়া আমি আসছি।”
পরে বন্ধুর কাছে তরু সম্পর্কে শুনেছি। তরু নাকি মাহিনকে ডিভোর্স দিয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে আর বিয়ে করেনি। বাবা মার দ্বারস্থ হয়নি আর। সবাইকে ত্যাগ করে একা একা চলে এসেছে এখানে। এই শিশুপল্লীতে চাকরি নিয়েছে সে। এখানকার প্রত্যেকটা বাচ্চাই নাকি তরুর জন্যে পাগল, তাকে ছাড়া বাচ্চারা বাঁচেই না। আসলে এখানে কোনো বাচ্চার মা বাবা নেই তো তাই তরুই ওদের মা এবং বাবা। এইটাই তরুর পৃথিবী, এইটাই শান্তি, এইটাই সুখ।
আমার একটি মেয়ে আছে, আর সুন্দরী একটি বউ। সংসারের ব্যস্ততায় আমি মত্ত। তরুও কি ইচ্ছা করলে পারতো না একটা বর জোগাড় করতে, পারতো না ঘরসংসার করতে? তা পারতো, কিন্তু না। আমি মনে মনে ভাবি, এ জগৎ সংসারের সমর্থক আমি এক সুপুরুষ। তালের সাথে মিলটা কত সুন্দরভাবেই না করলাম। কতই না সুখে আছি আমি। তবে, আমার সুখটা সহজে অনুমেয় এবং দৃশ্যমান হলেও তরুর সুখটা অদৃশ্য এবং এ সমাজ সে সুখ পরিমাপ করতে অক্ষম।