রাত বারোটা। গ্রামে এই সময়ে গভীর রাত। আজও ঠিক ঘুম আসছে না। তাই খুব পুরোনো একটা ডাইরি নিয়ে বসলাম। লিখতে নয় পড়তে। বাড়ির পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘেঁটে ডাইরিটা পেয়েছি। অনেকদিন লেখা হয়নি। তাছাড়া রাত জাগার আরও একটা কারণ রয়েছে। গ্রামে নাকি ডাকাত হানা দিয়েছে। ডাকাতের উৎপাতে অতিষ্ট গ্রামবাসী। থানার ওসি ও পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন ওসি এসেছে। নতুন ওসি ইতোমধ্যে নজরদারি শুরু করেছে।
বাড়িতে আমি একা। গ্রামে আমি শুধু একা একলা বাড়িতে বসবাস করি। শহরে ব্যাপারটা সাধারণ হলেও গ্রামের লোকজনের কাছে তা দৃষ্টিকটু। টিনের বাড়ির উঠানে গাছ লতা পাতার জঞ্জালে বাড়িটা লোকজনের তেমন চোখে পড়ে না। রাস্তা দিয়ে গেলে লোকজন প্রথম দেখাতে জঙ্গলই মনে করবে।
যাই হোক ডাইরির পাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন যে চোখ দুটো লেগে আসলো খেয়ালই করিনি। উঠানে একাধিক বুট জুতোর শব্দে চেতনায় ফিরে এলাম। উঠানে জমে যাওয়া গাছের পাতার উপর বুট জুতার সন্তর্পণে এগুনোর শব্দ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি। চোখের চশমা গেঞ্জিতে মুছে চোখে দিলাম। সদর দরজার ফাঁকে চোখ রেখে উঠানে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই আঁধারে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। বুট জুতোর শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, পাঁচ সাতজন লোকের পায়চারি চলছে। ফিসফিস শব্দ শুনে মনে হলো, ডাকাতের দল বাড়িতে ঢোকার পরিকল্পনা করছে।
ট্রাঙ্ক ঘেঁটে শাবলটা নিয়ে ঘরে সতর্ক অবস্থান নিলাম। শাবলের ধাতব শব্দে ওরা সতর্ক হয়ে গেছে। দরজা খুলে ওদের মুখোমুখি হবো নাকি? যদি আবার গুলি চালায়। তাছাড়া ওরা আমার বাড়িতে তেমন কিছুই পাবে না। পুরোনো কয়েকটা বই, একটা খাট আর আলমারি। যদিও বাড়িটা বিশাল। বাড়িটা বিশাল দেখেই হয়তো ওরা এখানে হানা দিয়েছে।
বুট জুতোর শব্দ যখন বন্ধ হলো তখনই ঠিক করলাম দরজা খুলে বাইরে বেরুবো।
দরজা খুলে যেই বাইরে পা রাখবো অমনি দুজন দু পাশ থেকে আমাকে সামরিক কায়দায় ঝাপটে ধরল। পড়ে গেলাম মাটিতে। ছিটকে পড়লো হাতের শাবলটা। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর লাইটের আলোয় যা দেখলাম তা আমার সব জল্পনা কল্পনার ধূলিসাৎ করে দিলো।
ওরা ডাকাত নয়, পুলিশ। থানার নতুন ওসি খবর পেয়েছেন আমার বাড়িতে ডাকাতের দল লুকিয়ে আছে। তাই তাদের ধরতে এসেছেন।
—আচ্ছা তাহলে আপনি এই বাড়ির মালিক?
—জী, বললাম আমি।
—আপনার জামা-কাপড়গুলো মনে হচ্ছে খুব পুরোনো দিনের। আগেকার দিনে লোকজন এইরকম জামা পড়তো, দাদার কাছে শুনেছি।
—তা বটে। এইসব এখন আর কেউ পড়ে না।
বলেই খুক খুক করে একটা কাশি দিলাম। ইদানিং হাসি পেলেই কেমন জানি কাশিও আসে।
ওসির সাথে আরও মিনিট পাঁচেক কথা হলো। যা বুঝলাম উনি এখানের পথ ঘাট খুব একটা চেনেন না। কেউ হয়তো তাকে খবর দিয়েছে ডাকাত এই দিকে কোথাও লুকিয়ে আছে। আসলে বাড়িটা জঙ্গলমতো তাই উনিও একই ধারণা করেছেন।
ওসিসহ আসা পাঁচ-সাতজন পুলিশ ফিরে গেলো। আমি আবার পুরোনো ডাইরির “শ্রীংহল দ্বীপের ঝড়” অধ্যায়টা পড়তে লাগলাম।
***
একটা রাত নিস্ফল অভিযান চালিয়ে থানায় ফিরে এসেছে মাহফুজ। ফিরেই চেয়ারম্যানকে কল দিলো। কারণ ওনিই বলেছিলেন পুরোনো সিকদার বাড়িতে ডাকাতের দল লুকিয়ে আছে।
— হ্যালো…চেয়ারম্যান সাহেব বলছেন..?
— জী। মাহফুজ তুমি ওদের ধরতে পেরেছো?
— স্যার আপনার দেয়া ঠিকানায় তো কোনো ডাকাতের আস্তানা নেই। ওই সিকদার বাড়িতে একজন যুবককে দেখলাম। ওনারই বাড়ি। বললো উনার বাড়ির দিকে কোনো ডাকাত আসেনি।
— কী বলো! ওই বাড়িতে মানুষ থাকে কোনো দিন শুনিনি। আমার দাদার মুখে শুনেছিলাম এই বাড়িতে একজন পর্যটক থাকতো। কাজী আকরাম সিকদার। একবার শ্রীলংকায় সমুদ্র ঝড়ে উনি হারিয়ে যান। তারপর অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। তুমি আমাদের উপজেলার ওয়েবসাইট ইতিহাস দেখো। উনার ছবি আছে।
একটানা কথাগুলো বলে শেষ করলেন চেয়ারম্যান। শুনে মাহফুজের মাথা কাজ করছে না। দ্রুত উপজেলার ওয়েবসাইটে ঢুকলো।
একি! সিকদার বাড়িতে যাকে দেখেছে তাঁর চেহারার সাথে পুরোপুরি মিল! কাজী আকরাম সিকদার। দুইশ বছর আগের মানুষের সাথে কী করে দেখা হলো তার। সত্যি নাকি হেঁয়ালি?
ভাবতে ভাবতেই ধপ করে বসে পড়লো মাহফুজ। জানালার পাশে কে যেন খুক খুক করে কাশি দিল। কাশিটা মনে হলো খুব চেনা।