দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

অন্য স‌ন্ধ্যে, ভিন্ন বি‌থো‌ফেন – শিল্পী নাজনীন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

দী‌ঘিটা টলট‌লে। স্বচ্ছ। কাকচক্ষু কি এ‌কেই ব‌লে? অাকাশটা নে‌মে এ‌সে‌ছে। হঠাৎ তাকা‌লে ভ্রম হয়। অাকাশ না-‌কি দী‌ঘি? ঘুম ভে‌ঙে ও‌দি‌কে চোখ পড়‌তেই প্রথমটায় নি‌জের ম‌ধ্যেও অমন একটা ভ্রম টের পায় নীল। ভ্রম অথবা মোহ। না‌কি মায়া? নীল বিড়‌বিড় ক‌রে অাপন ম‌নেই। তারপর চম‌কে ওঠে। ম‌নে প‌ড়ে যায় লহমায়। মর‌তে না পারার ব্যর্থতা অার পুনরায় বেঁ‌চে ওঠার গ্লা‌নি মুহূ‌র্তেই গ্রাস ক‌রে নেয় তা‌কে। তার ম‌ধ্যে জে‌গে ও‌ঠে সীমাহীন হাহাকার, বর্ণনাতীত বিষণ্নতা। যন্ত্রণাময় বো‌ধে তা‌ড়িত হ‌তে হ‌তে নীল বুঝ‌তে পা‌রে, বাকী সময়টা, যত‌দিন বাঁচ‌বে সে, সেই পু‌রো সময়টা তা‌কে বহন কর‌তে হ‌বে এই অমানু‌ষিক যন্ত্রণার বোধ, এই তীব্র, তীক্ষ্ণ অনু‌শোচনার জ্বালা। বস্তুত জীবন যে এতটা ভারী, এতটা দুর্বহ সেটা এমন ক‌রে অা‌গে অার কো‌নো‌দিন জানা হ‌য়ে ও‌ঠে নি তার।

‌সে চোখ রা‌খে দী‌ঘি‌তে। কিংবা দী‌ঘি‌তে ডু‌বে যাওয়া অাকা‌শে। কী অাশ্চর্য। তা‌তে মাছ সাঁতরায় না। পা‌খি ও‌ড়ে। অাকা‌শে ওড়া পা‌খির প্র‌তি‌বিম্ব উ‌ড়ে যায় দূ‌রে। নীল দীর্ঘশ্বাস ছা‌ড়ে। য‌দি অম‌নি ক‌রে ওড়া যেত! অাহা। তাহ‌লে জীবন এত ক্লি‌শে হ‌তো না, এতটা দুর্বহ। পরক্ষ‌ণেই মাথা না‌ড়ে হতাশায়। ম‌রে গে‌লেই বেশ হ‌তো। সে যে অাত্মহত্যার চেষ্টা ক‌রে‌ছিল, সে খবর নিশ্চয়ই গোপন নেই অার এতদিনে। কী ক‌রে সে এই বেঁ‌চে ওঠার লজ্জা নি‌য়ে অাবার দাঁড়া‌বে সবার সাম‌নে, বি‌শেষত বকু‌লের সাম‌নে! কল্পনায় সে বকু‌লের মুখটা ম‌নে করার চেষ্টা ক‌রে। বকু‌লের মি‌ষ্টি, শ্যামল মুখটা‌তে সে দেখ‌তে পায় তা‌চ্ছি‌ল্যের হা‌সি, উপহা‌সের ভ্রুকূ‌টি। দুঃ‌খে চো‌খে জল অা‌সে তার। ম‌রে যে‌তে ই‌চ্ছে ক‌রে অাবার। এই উ‌পেক্ষার ভাষা, এই অব‌হেলার ই‌ঙ্গিত সহ্যের দমটুকু অাপাতত নাই তার। সে দীঘির বাঁধা‌নো বেদী‌তে শু‌য়ে প‌ড়ে চোখ বুঁ‌জে, তারপর দুর্বল, অসুস্থ শরীর নি‌য়ে ঘু‌মি‌য়ে প‌ড়ে ফের।

‌বি‌কে‌লের ম‌রে অাসা রো‌দে তখন কেমন একটা ক্লি‌শে বিষণ্ণতা ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ হাওয়ায়। মানুষগু‌লোও কেমন একটু মন‌ভোলা হ‌য়ে বু‌ঝি বা এড়া‌তে চায় কো‌নো হাঁ‌পি‌য়ে ওঠা এক‌ঘে‌য়ে‌মির রেশ। সোনা সোনা অা‌লোয় অপা‌র্থিব লাগে পু‌রো বি‌কেলটা‌কেই। পদ্মার হি‌মেল হাওয়ায় সারা‌দি‌নে রো‌দে পোড়া মানুষগু‌লো তখন গা জু‌ড়ি‌য়ে ‌নেয় অা‌য়ে‌শে। কেউ কেউ দরকারী সওদা ই‌তোম‌ধ্যেই সে‌রে নি‌য়ে বাজা‌রের কো‌ণে ব‌সে ইয়ার দোস্ত‌দের সা‌থে অারাম ক‌রে বি‌ড়ি ফোঁকা অথবা মস্করায় ব্যস্ত হয়, অ‌ন্যেরা নি‌বিষ্ট হয় কো‌নো দরকারী প‌ণ্যের দরদা‌মে। এ তল্লা‌টে য‌দিও বিজ‌লিবা‌তি জ্বল‌ছে ‌বেশ কিছু‌দিন থে‌কে, তবু মানুষগু‌লো এখনও সেভা‌বে অভ্যস্থ হ‌য়ে ও‌ঠেনি তা‌তে। তা‌দের ম‌ধ্যে সন্ধ্যের পরপরই সব কাজ সে‌রে নী‌ড়ে ফেরার ব্যস্ততা চো‌খে প‌ড়ে। কেউ কেউ অবশ্য থা‌কে নীশাচর, তা‌দের কথা অন্য।

ঠিক এমন এক অলস বি‌কে‌লে, পান‌সে, এক‌ঘে‌য়ে জনজীব‌নে হঠাৎ-ই উট‌কো এক ঢেউ এ‌সে লা‌গে। ঝি‌মি‌য়ে পড়া বাজার অার প্রায় ঘু‌মি‌য়ে পড়া গ্রামটা‌কে চাবু‌কের একঘা‌য়ে জা‌গি‌য়ে দি‌য়ে যায় সহসা।

‌দি‌নের অা‌লো মু‌ছে স‌বে অন্ধকার তার ঝির‌ঝি‌রে একটা পর্দা বি‌ছি‌য়ে দেয় অামলাবা‌ড়ি বাজার, পদ্মার কোল অার কা‌লিবা‌ড়ির কা‌লি প্র‌তিমাটার ওপর। তা‌তে কা‌লি প্র‌তিমাটা ঢেরগুণ তে‌জে জ্ব‌লে উ‌ঠে যেন অন্ধকারটা‌কেই ভেং‌চি কা‌টে অারও। বিদ্যুৎ যে কখন অা‌সে, কখন যায় তার খোঁজ বড় একটা রা‌খে না এ অঞ্চ‌লের মানুষ। অন্ধকা‌রে তেমন একটা অনভ্যস্থতাও নেই তা‌দের। সন্ধ্যের সেই অাবছা অন্ধকা‌রে কা‌লিবা‌ড়ির বটগা‌ছের নি‌চের বাঁধা‌নো বেদী‌তে তখন মাত্রই গাঁজার অাড্ডা জ‌মে ওঠে‌ নীল অার তার সঙ্গী‌দের। গাঁজায় নী‌লের গলায় লাল‌নের গান দারুণ জ‌মে ব‌লে কেবলই সে মাথা ঝাঁ‌কি‌য়ে গলা ছে‌ড়ে গাই‌তে শুরু ক‌রে‌, অা‌মি অপার হ‌য়ে ব‌সে অা‌ছি…

‌ঠিক তখন, হঠাৎ-ই, বলা নেই কওয়া নেই পূ‌বের অাকা‌শের এক‌কো‌ণে ফ্যাকা‌শে, ঝাপসা একফা‌লি চাঁদ করুণ মুখ বের ক‌রে দেয়, অার ক্ষণপ‌রেই তার‌চে‌য়েও ফ্যাকা‌সে, করুণ একটুক‌রো জোছনা এ‌সে অাছ‌ড়ে প‌ড়ে পু‌রো এলাকাটার ওপর। শ্যামলা কা‌লো মে‌য়ের মু‌খে হালকা প্রসাধা‌নের ম‌তো ফ্যাকা‌শে জোছনাটা যখন সন্ধ্যার পাতলা কা‌লো মু‌খে প‌ড়ে‌ছে কি প‌ড়েনি, অম‌নি পটাপট জ্ব‌লে ও‌ঠে গেঁ‌য়ো রাস্তায় লা‌গি‌য়ে রাখা ক‌য়েকটা বিজ‌লি বা‌তি। সেই সা‌থে বাজা‌রের ম‌ধ্যের ক‌য়েকটা দোকা‌নেও জ্ব‌লে ও‌ঠে অা‌লো। সেগু‌লোতে এতক্ষণ জ্বল‌তে থাকা কু‌পি বা‌তিগু‌লো ফুঁ দি‌য়ে নেভা‌তে নেভা‌তেই কা‌নে বা‌জে বিকট চিৎকার। এত বিকট যে বাজা‌রের অব‌শিষ্ট লোকজ‌নের বুক কেঁ‌পে ও‌ঠে দুরুদুরু। এমন‌কি নীল‌দের গাঁজার অাসর‌টি‌কে পর্যন্ত তা কাঁ‌পি‌য়ে দি‌য়ে যায়। সবাই উৎকর্ণ হ‌য়ে চিৎকা‌রের উৎস খুঁজ‌তে সশব্যস্ত হ‌য়ে প‌ড়িম‌রি ক‌রে ছো‌টে।

‌ফি‌কে জোছনা অার বিজ‌লির অকরুণ অা‌লোয় খুবই অপ‌রি‌চিত এক দৃশ্য চো‌খের সাম‌নে ভা‌সে তখন তা‌দের। বস্তুত দৃশ্যটা সন্ধ্যের সেই রহস্যঘন অা‌লো-অাঁধা‌রিতে কেমন যেন অা‌ধি‌ভৌ‌তিক ম‌নে হয়।

নেহাতই অ‌তি‌লৌ‌কিক এক ছ‌বি হয়ে সেটা ঝু‌লে থা‌কে তাদের না‌কের ডগায়। দৃশ্যটা তা‌দের কা‌ছে এতটাই বেখাপ্পা অার বেমানান লা‌গে যে, প্রথ‌মে তারা এটা‌কে ভূতু‌ড়ে ‌ভে‌বে ভয় পায়, ফিসফাস ক‌রে। তারা দেখ‌তে পায় বিদ্যু‌তের খাম্বার সা‌থে, অ‌নেক উঁচু‌তে এক‌টি বানরসদৃশ মনুষ্য অবয়ব, কিছু একটা অাঁক‌ড়ে ধ‌’রে ঝোলে। যে বিকট চিৎকারে এতক্ষ‌ণ তা‌দের কান বি‌দির্ণ হ‌য়ে‌ছিল প্রায়, তা ততক্ষ‌ণে থে‌মে গি‌য়ে না‌মে অশুভ, গা ছমছ‌মে এক নীরবতা। পদ্মার কোল ছুঁ‌য়ে নে‌মে অাসা ফুরফু‌রে হাওয়ায় উঁচু‌তে ঝুল‌তে থাকা শরীরটা দারুণ এক অা‌ধি‌ভৌ‌তিক ছ‌ন্দে দো‌লে। ত্ব‌রি‌তে স‌ম্বিত ফে‌রে মোহর অালীর। সে চিৎকার ক‌রে, শিগ‌গির শুহ‌নো বাঁশ অান রে তুরা! মানুষটা মুন কয় ম‌রে গেল রে! তাড়াতা‌ড়ি হর!


‌মোহর অালীর চিৎকা‌রে স‌ম্বিত ফেরে অ‌নে‌কের। কা‌ছেই জ‌ড়ো ক‌রে রাখা শুক‌নো বাঁশ দি‌য়ে তারা অন্ধকা‌রে ঝুল‌তে থাকা শরীরে অাঘাতের পর অাঘাত কর‌তে থা‌কে। পরপর ক‌য়েকটা অাঘা‌তেই গাছ থে‌কে ফল পড়ার ম‌তো নিথর শরীরটা ঝুপ ক’‌রে নি‌চে পে‌তে রাখা কাপ‌ড়ে ঝ’‌রে প‌ড়ে। শরীরটায় অা‌লো ফেল‌তেই অস্ফুট গুঞ্জন ও‌ঠে উপ‌স্থিত মানুষগু‌লোর ম‌ধ্যে। তারা এ ওর মুখ চাওয়া চাও‌য়ি ক‌’রে ব‌লে ও‌ঠে, তা‌লি প‌রে এই হ‌লেগান কা‌হি‌নি!

ম‌রে গে‌চে না‌হি দেক‌দি‌নি?

না না, ম‌রে নাই এহনও। ভ্যান ডাক‌দে, অাঁসপাতা‌লে নিওয়া লাগ‌বি এহনই।

অারও অারও হ‌রেক বাক্যালা‌পের ভী‌ড় ঠেলে নীল অা‌স্তে সট‌কে প‌ড়ে সে তল্লাট ছে‌ড়ে। সঙ্গীরাও। লহমায় গাঁজার নেশা টু‌টে যায় তা‌দের।

শ্মশা‌নের কোল ঘেঁষা নার‌কেল গাছটা‌তে হেলান দি‌য়ে পদ্মার অন্ধকার মু‌খের দি‌কে চুপচাপ তা‌কি‌য়ে থা‌কে নীল। দুু‌য়েকটা নৌকা ভা‌সে। অ‌ধিকাংশই ডি‌ঙি। মাছ ধরে জে‌লেরা। পাল তোলা পান‌সি অাজকাল অার চো‌খে প‌ড়ে না তেমন। ঘন হওয়া অন্ধকা‌রে পদ্মা‌কে কেমন রহস্যময় লা‌গে। দি‌নের পদ্মা‌কে চেনা যায়, কিন্তু এই রা‌তের পদ্মা বড় অ‌চেনা, অন্ধকার। তার নি‌জের ম‌নের ম‌তো। না। তার মন এর‌চে ঢের বে‌শি অন্ধকার। অারও বে‌শি তমসা তা‌তে। নি‌জের ম‌নের দি‌কে তা‌কি‌য়ে নি‌জেই চম‌কে ওঠে নীল। ক‌বে এত অন্ধকার জমেছে তার ম‌নে? এত এত ছোপ‌ ছোপ কা‌লোয় ক‌বে ঢে‌কেছে তার স‌ফেদ মন? মকবুল অালীর মুখটা ভাসে চো‌খের সাম‌নে। ফ্যাকা‌সে, রক্তহীন। সারা শরীর র‌ক্তে মাখামা‌খি, দগদ‌গে ঘা। শিউ‌রে উঠে চোখ ফি‌রি‌য়ে নেয় তখন নীল। পা‌লি‌য়ে অাসে‌। বু‌কের ভেতর একটুও কি অাশঙ্কা উঁ‌কি দেয় না? একটুও ভয়? প্রশ্নটা নি‌জেই নি‌জে‌কে ক‌’রে থম‌কে যায় নীল। বু‌কের কাছটা‌তে কেমন একটু ধাক্কা লা‌গে। ম‌’রে যা‌বে না তো? য‌দি ম‌রে যায়…

‌জোহরা বেগম সুর ক‌রে কাঁ‌দে। ছে‌লের এমন কষ্টে দিক-‌বি‌দিক ভু‌লে ছে‌লেবউ অার না‌তি‌কে শাপ-শাপান্ত ক‌রে। হা‌লিমা তে‌লে‌বেগু‌নে জ্ব‌লে ও‌ঠে তা‌তে। জোহরা বেগ‌মের চৌদ্দ‌গোষ্ঠী উদ্ধার ক‌রে সে মু‌খে। শা‌স্তিস্বরুপ জোহরা‌ বেগম‌কে এক‌বেলার ভাত বন্ধ ক‌রে দেয়। অন্ধ, অা‌লোহীন চো‌খে জোহরা বেগম তসবী টে‌পে, ছে‌লের অা‌রোগ্য কামনা ক‌রে, সেইসাথে হা‌লিমা অার তার ছেলের মৃত্যু কামনা ক‌’রে চ‌লে অনবরত। দাওয়ায় বিছা‌নো কলাপাতায় দগদ‌গে ঘা অার নির্জীব শরীর নি‌য়ে মকবুল মরার ম‌তো প‌ড়ে থা‌কে প্রায় পথ্য ও প‌রিচর্যাহীন। তার শরী‌রের ক্ষত থে‌কে ফ্যাকা‌সে লাল রঙা অাঠা‌লো কষ গ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে, শরীরময় ওড়াউ‌ড়ি ক‌রে কতকগু‌লো বি‌চিত্ররঙা মাছি, মা‌ঝেমা‌ঝে লেপ্টে ব’‌সে প‌ড়ে অাঠা‌লো ক্ষ‌তে, শুঁড় ডু‌বি‌য়ে মহান‌ন্দে ব্যস্ত হয় ভো‌জে। পৃ‌থিবীর এইসব তুচ্ছা‌তিতুচ্ছ বিবাদ-‌বিসম্বাদ থে‌কে নি‌জে‌কে অ‌বিশ্বাস্য নিস্পৃহতায় গু‌টি‌য়ে রা‌খে মকবুল। চোখ বন্ধ ক‌রে সে প‌’ড়ে থা‌কে অনড়। গ্রা‌মে ঢি ঢি প’‌ড়ে যায়। কেউ অার এবা‌ড়ি মাড়ায় না বিনা প্র‌য়োজ‌নে। মকবুল চোর। রা‌তের অন্ধকা‌রে সে বিদ্যু‌তের তার চু‌রি ক‌রে শহ‌রে নি‌য়ে বে‌চে। সে‌দিনও তেমনই হ‌তো, য‌দি না হুট ক‌রে বিদ্যুৎ চ‌লে অাসত। হুঁহ বাবা! কথায় ব‌লে না, সাত‌দিন চো‌রের তো এক‌দিন গৃহ‌স্থের! বো‌ঝো এখন ঠ্যালা! প্রা‌ণে যে বেঁ‌চেছ, এইই ঢের!


বাড়ি‌তে এ‌সে, তা‌দের‌কে শু‌নি‌য়ে শু‌নি‌য়েই এসব ব‌লে যায় গ্রা‌মের লোকজন। হা‌লিমা চোখমুখ শক্ত ক‌রে শো‌নে। না পার‌লে খিস্তি ক’রে তাড়ায়। দামড়া ছে‌লেটা সারা‌দিন টো টো ঘো‌রে। রা‌তেও ফে‌রে না মা‌ঝেমা‌ঝে। দুঃ‌খে গলায় দ‌ড়ি দি‌তে ই‌চ্ছে ক‌রে তার। কত ক‌ষ্টে লেখাপড়া শেখাল ছে‌লেটা‌কে। ক‌লেজ পাশ করালো। তারপরও ব‌খে গেল ছে‌লে। অ‌শি‌ক্ষিত বাপমা‌য়ের কত অাশা ছিল! জ‌লে গেল সব। নেশা ক‌রে ছে‌লে। নেশা ক‌’রে এ‌সে টাকা চায় বা‌পের কা‌ছে, না পে‌লে উ‌লোটপা‌লোট ক‌রে দেয় সব। এর‌চে বরং নি‌জের ম‌তো দিনমজু‌রি শেখাত ছে‌লে‌কে মকবুল, তা‌তে অন্তত এমন দূ‌র্দিন দেখ‌তে হ‌তো না চো‌খে। ছে‌লে এখন চু‌লে টে‌রি কে‌টে, পা‌য়ে বাবু‌দের ম‌তো স্যা‌ন্ডেল প‌’রে ফটাস ফটাস শব্দ তু‌লে হাঁ‌টে, শুদ্ধ ভাষায় কথা কয়, হা‌তে ঘ‌ড়ি প’‌রে সময় মা‌পে, মা‌ঝেমা‌ঝে চো‌খেও কা‌লো চশমা লাগায়।

মকবুল অালী হতাশ, দুঃ‌খিত চো‌খে ছে‌লের দি‌কে তা‌কি‌য়ে দীর্ঘশ্বাস ছা‌ড়ে। রাগে, দুঃ‌খে, শো‌কে, জল এ‌সে যায় চো‌খে। বু‌কের ম‌ধ্যে কেমন একটা ভয়ও জ‌মে থা‌কে অাজকাল। নি‌জের ছে‌লে‌কে চিন‌তে পা‌রে না অার। কো‌লে-‌পি‌ঠে ক’‌রে বড় করা ছে‌লেটা কেমন অনাত্মীয়, অ‌চেনা হ‌য়ে গেল চো‌খের সাম‌নে, কেমন অ‌চেনা ভাষায় কথা কয়, মা‌ঝেমা‌ঝে রেগে গে‌লে ইং‌রে‌জিও কয়। তার মাথামুণ্ডু কিছুই বো‌ঝে না মকবুল। শুধু শুন‌লে কেমন একটু বুক ধুকপুক ক‌রে। কেমন একটু ভয় ভয় লা‌গে। শুন‌তে শুন‌তে দু‌য়েকটা শব্দ বেশ চেনাও হ‌য়ে গে‌ছে তার। নন‌সেন্স, ই‌ডিয়ড, শিট, ফাক ইউ। ছে‌লের বলার ধর‌ণে মকবুল বো‌ঝে, ওগু‌লো বি‌শেষ ভা‌লো কো‌নো শব্দ নয়, গা‌লি‌বি‌শেষ। ত্যক্ত মকবু‌লের সব রাগ, ক্ষোভ গি‌য়ে জমা হয় যত ন‌ষ্টের গোড়া ঐ ইং‌রে‌জি ভাষা অার বউ হা‌লিমার ওপর। ছে‌লের অনুপ‌স্থি‌তি‌তে সে নি‌জের সব ক্ষোভ ঝা‌ড়ে এই দু‌য়ে। রা‌গে, দুঃ‌খে মাথার চুল ছিঁড়‌তে ছিঁড়‌তে সে ব‌লে ও‌ঠে, গু‌ষ্টি চু‌দি তোর ইং‌রে‌জি’র! শালার বেটা শালা! এটা পয়সা কা‌মা‌নের মু‌রোদ নাই অাবার ইং‌রে‌জি ঠাপাও, অ্যাঁ? সুম‌ন্দির ছাওয়াল যি‌নি কো‌নেকার!

ক্ষ‌ণেক বিরতি নি‌য়ে অাবার সে বকে চ‌‌লে, শা‌লির বি‌টি শা‌লি! অাজই তোর শি‌ক্কিত্ ছাওয়াল নি‌য়ে তুই অামার বা‌ড়ি‌ত্তে বাড়া‌বি! অা‌মি অার এই বু‌ড়ো অা‌ড়ে তোর দামড়া ছাওয়া‌লেক খাওয়া‌বের পারব না‌কো বসা বসা!

বলাবাহুল্য, শে‌ষোক্ত বাক্যাবলি হা‌লিমাকে লক্ষ্য ক‌রে ব‌র্ষিত হয়। হা‌লিমাকে এই বাক্যবা‌ণে বি‌শেষ বিচ‌লিত দেখায় না। সে এসব অগ্রাহ্য ক‌রে নি‌জ কা‌জে অখণ্ড ম‌নো‌যোগ অক্ষুন্ন রা‌খে।

সে‌দি‌নের দূঘর্টনার পর থে‌কে, ‌নিত্যকার চেনা চি‌ত্রে চিড় ধ‌রি‌য়ে মকবুল মৃতবৎ শু‌য়ে থা‌কে বারান্দায় বিছানো কলাপাতায়, প‌রিব‌র্তে ঘ‌রের দাওয়ায় ব‌সে শাপ-শাপান্ত ক’‌রে চ‌লে তার অন্ধ মা, অার পাথ‌রের ম‌তো ভাব‌লেশহীন মু‌খে ঘ‌রের কাজ ক‌রে হা‌লিমা। বা‌ড়ির কোথাও তাদের শি‌ক্ষিত, ইং‌রে‌জি বলা ছে‌লের টি‌কি‌টিও মে‌লে না। সে বন্ধু-বান্ধব নি‌য়ে দূ‌রে কোথাও গাঁজার অাড্ডায় ব্যস্ত, তেমন‌টিই দস্তুর হ‌য়ে ওঠে‌ যেন।

‌সূর্যটা তীর্যকভা‌বে প‌শ্চি‌মে হে‌লে যায় অার তার থে‌কে লাল‌চে অা‌লো এ‌সে পড়ে বাঁধা‌নো ঘা‌টে। পা‌ড়ের দীর্ঘ, সা‌রি সা‌রি গা‌ছগু‌লোর ছায়া অারও বে‌শি দীর্ঘ, এলােচুল মে‌লে নাই‌তে না‌মে দী‌ঘির জ‌লে। নতুন এক বি‌কেল না‌মে পৃ‌থিবী‌তে। দু‌চোখ ভরা মায়ায় অা‌রেক অদ্ভুত মায়াবী অপরাহ্ন চোখ রা‌খে অজপাড়াগাঁ‌, গোসাইডাঙ্গীর চো‌খে। দুর্বল, অভুক্ত শরী‌রে হঠাৎ সেদি‌কে চোখ পড়‌তেই কেমন উদ্ভ্রান্ত, অ‌স্থির লা‌গে নী‌লের। তার ম‌ধ্যে জে‌গে ও‌ঠে অপার বিস্ময়, অাশ্চর্য ঘোর। কোথায় রয়েছে অাদ‌তে, প্রথ‌মে বুঝ‌তে পা‌রে না। ম‌নে হতে থা‌কে বি‌থো‌ফে‌নের মাতাল করা সুর ভাসে হাওয়ায়, মোৎসা‌র্টের সু‌রজা‌লে বিহ্বল হয় চরাচর। ম‌নে হয় পৃ‌থিবী নয়, অন্য কো‌নো গ্র‌হবাসী সে।

ত‌বে কি স্ব‌র্গেই চ‌লে এ‌লাম? নি‌জের ম‌নেই ভা‌বে নীল। চোখ কচ‌লে তাকায় দী‌ঘির জ‌লে স্নানরত দীঘল বৃক্ষরা‌শির কা‌লো কা‌লো ছায়ার দি‌কে। পলকহীন তা‌কি‌য়ে থাক‌তেই চো‌খ পড়ে দূ‌রে, দী‌ঘির পাড় ঘেঁ‌ষে একপাল হাঁসে‌দের সাঁতরে তী‌রে ওঠায়, দিন‌শে‌ষে তাদের নি‌জে‌দের ‌চেনা প‌থে ফি‌রে যাওয়ার অা‌য়োজ‌নে। অার তখনই দুম ক’‌রে সব ম‌নে প’‌ড়ে যায় অাবার। বিষণ্নতা অার অনু‌শোচনায় নু‌য়ে প‌ড়ে তার ক্লান্ত, অবসন্ন মন। ঘু‌মের ওষুধটা কড়া ছিল। খে‌য়েও ‌ছিল প‌রিমাণ ম‌তোই। তবু যে ঘুম ভাঙে তার, অাবার যে সে চোখ মেলে পৃ‌থিবীর অা‌লোয়, এই পুনর্জ‌ন্মের কৃ‌তিত্ব কিংবা দায়, পু‌রোটাই পিয়া‌রের। সে ই প্রথম অা‌বিষ্কার ক‌রে‌ নী‌লের ঘুমটা অস্বাভা‌বিক, অদ্ভুত।

নীল ছাড়া বাকী বন্ধু‌দের অবস্থা ভা‌ল। গ্রা‌মের অবস্থাপন্ন ঘ‌রের সন্তান তারা। পিয়া‌রের সা‌থে ঘ‌নিষ্ঠতা বে‌শি হওয়ায় এ বা‌ড়ি‌তে নীল প্রায়ই অা‌সে। অা‌সে মূলত পিয়ার‌দের বা‌ড়ির পাঠাগা‌রের লো‌ভে। সেটা প্রায় অম‌নি অব্যবহৃতই প’‌ড়ে থাকে, য‌দি না নীল মা‌ঝে মা‌ঝে হানা দেয় তা‌তে। মূলত এখান থে‌কেই ধী‌রে ধী‌রে চোখ খো‌লে নী‌লের। পৃ‌থিবীর উজ্জ্বলতম অা‌লোক চিন‌তে শেখার সা‌থে সা‌থে সে অা‌বিষ্কার কর‌তে শে‌খে নি‌জের জীব‌নের ঘোরতম অন্ধকারও। অ‌শি‌ক্ষিত, অনুদার এক প‌রিবা‌রে জন্ম তার, দিনমজু‌রির অাড়া‌লে মূলত ছিঁচ‌কে চু‌রি‌তে অভ্যস্ত এক ঘৃণ্য পিতার সন্তান সে। বন্ধুরা তার সা‌থে মে‌শে দূরত্ব রে‌খে, করুণার দৃ‌ষ্টি‌তে। শুধু পিয়ারই তা‌কে যা একটু অন্য চো‌খে দে‌খে। জীব‌নের এই ঘোরতম অন্ধকার অা‌বিষ্কা‌রের উ‌ত্তেজনায় রা‌গে, ক্রো‌ধে হিতা‌হিত বোধ ক্রমশ হারা‌তে থা‌কে নীল। বাই‌রে তেমনই শান্ত‌শিষ্ট গো‌বেচারা‌টি দেখতে থাক‌লেও ভেত‌রে ভেত‌রে সে হ‌য়ে ও‌ঠে অবাধ্য, গোঁয়ার। তার চোখ এ‌ড়ি‌য়ে যায় সন্তা‌নের প্র‌তি অ‌শি‌ক্ষিত, তস্কর বাবার বাৎসল্য, প্রেম, মা‌য়ের অন্ধস্নেহ।

সে ভুলে যায় তার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করে তার প‌রিবার, তার শিক্ষা, ভরণ‌পোষণ, যা কিছু চা‌হিদা সব পূরণ কর‌তে কতটা নাভিঃশ্বাস ওঠে তার না খে‌তে পাওয়া, রুগ্ন, হতভাগ্য বাবার। সে ভু‌লে যায় তা‌কে ঘি‌রে তার বাবার চো‌খে, মা এমন‌কি অন্ধ দাদীর চো‌খেও জ্বল‌তে থাকা একটুক‌রো সোনালী স্বপ্ন। তা‌কে শি‌ক্ষিত ক‌রে, তার ম‌ধ্যে অা‌লো জ্বে‌লে, সে শিখায় নি‌জে‌দের জীব‌নে লে‌প্টে থাকা অন্ধকার দূর করার যে উদগ্র বাসনা লালন ক‌রে তার প‌রিবার, স্বপ্ন দে‌খে ‌যে প্রাত্য‌হিক জীব‌নে জ‌ড়ি‌য়ে যাওয়া দৈ‌ন্যের কা‌লো ছায়া মু‌ছে ফেলার, বেমালুম সে কথাও ভু‌লে যায় নীল। বরং এই কথা তা‌র মাথার ম‌ধ্যে গেঁ‌থে যায় দৃঢ়ভা‌বে যে, তার ভিত্ অন্ধকার, তার বাবা মূলত একজন চোর, সমা‌জের অন্ধকার অং‌শে তার অবস্থান। ফলে পড়া‌শোনায় ক্রমশ অাগ্রহ হা‌রা‌তে থা‌কে সে। পিয়ার‌দের অব্যবহৃত পাঠাগা‌রে সে যায় ব‌টে, বইও প‌ড়ে, কিন্তু তা‌তে যে অা‌লো, যে বিভা, তার ছটায় বরং নি‌জের অন্ধকারটাই অারও বে‌শি প্রকট হ‌’তে থা‌কে তার কা‌ছে, ততই সে কুঁক‌ড়ে যে‌তে থা‌কে ভেত‌রে ভেত‌রে। নি‌জের ভেত‌রে জন্ম নেয়া নব্য শিল্পসত্ত্বা অার তার হীনমন্য প্রকৃত সত্ত্বা, এই দু‌য়ের সংঘ‌র্ষে সে হ‌য়ে প‌ড়ে অারও বে‌শি হতাশ, অারও বে‌শি বিষণ্ন। সমস্যাটা প্রকটাকার ধারণ ক‌রে তখন, যখন সে দে‌খে ক‌লেজ শেষ করার পর তার অ‌ধিকাংশ বন্ধু উচ্চ‌শিক্ষা‌র্থে শহ‌রে চ‌’লে যায়, এমন‌কি পিয়ারও। তার বাপের তেমন সামর্থ্য নেই যে তা‌কে শহ‌রে রে‌খে অারও বে‌শি পড়ায়। বরং তার বাপ-মা দুজ‌নেই চায়, সে বরং এবার একটা চাক‌রি যোগাড় করুক, প‌রিবা‌রের ভার নি‌জের কাঁ‌ধে নি‌য়ে বা‌পের বোঝা হালকা করুক খা‌নিক। তীব্র অা‌ক্রো‌শে ফে‌টে প‌ড়ে নীল। এবং সে উপল‌ব্ধি ক‌রে যে, পড়া‌শোনার না‌মে যা সে শি‌খে‌ছে এত‌দিন, তা‌তে না সে বা‌পের ম‌তো দিন মজুরী পেশায় নাম‌তে পারে, না রা‌তের অাঁধা‌রে বা‌পের ম‌তো চু‌রি কর‌তে পা‌রে, অার না সে পা‌রে কো‌নো একটা ছো‌টখাটো চাক‌রিও যোগাড় কর‌তে। দিনমজুরী বা চু‌রি কর‌তে তার অাত্মসম্মা‌নে বা‌ধে। অার যা দিনকাল প‌ড়ে, তা‌তে ছোটখাট এক‌টি চাক‌রি যোগাড় কর‌তেও লা‌গে গু‌চ্ছের টাকা, নয়‌তো কেউ‌কেটা কারও ত‌দবির। যা তার ম‌তো একজ‌নের প‌ক্ষে যোগাড় করা অসম্ভব। কিন্তু তার অ‌শি‌ক্ষিত, মূর্খ বাপ-মা কিছু‌তেই এই বাস্তবতা বুঝ‌তে চেষ্টা ক‌রে না, উ‌ল্টে উত্ত‌রোত্তর তার ওপর চাপ বাড়া‌তে থা‌কে অার সে কোণঠাসা হ‌য়ে দিন দিন বিগ‌ড়ে যে‌তে থা‌কে অারও। শে‌ষে সে ‌যােগ দেয় গ্রা‌মের ব‌খে যাওয়া, উচ্ছ‌ন্নে যাওয়া কিছু নেশা‌খোর ছে‌লে‌দের সা‌থে। যারা দি‌নে টে‌রি কে‌টে, হা‌তে ঘ‌ড়ি, চো‌খে সানগ্লাস অার পা‌য়ে হাওয়াই চপ্পল প’‌রে ফটাস ফটাস শব্দ তু‌লে রাস্তা দি‌য়ে হাঁ‌টে, সন্ধ্যেয় গাঁজার অাড্ডা জমায় অার রাত দুপু‌রে বা‌ড়ি ফি‌রে টাকার জন্য বাপ-মার সা‌থে হুজ্জত ক‌রে। এ‌দের অারও একটা কাজ অা‌ছে। এরা সপ্তাহা‌ন্তে সবাই মি‌লে চাঁদা তু‌লে দূর গ্রা‌মে ক‌ণে দেখ‌তে যায়, সে বা‌ড়ি‌তে পেট পু‌রে খায়, তারপর প‌রে মতামত জানা‌বে, ব’‌লে কে‌টে প‌ড়ে। প্রথম প্রথম এ দ‌লে ভি‌ড়ে মা‌নি‌য়ে নি‌তে বেশ একটু বেগ পে‌তে হ‌য় নী‌লের, শে‌ষে স‌য়েও যায়। বকু‌লের সা‌থে নী‌লের প‌রিচয়ও এভা‌বেই।

বকুল ব’‌সে ছিল হালকা গোলাপি, তার ওপর অাকাশী ছোপ ছোপ একটা ডু‌রে শা‌ড়ি প’‌রে। তার শ্যামলা মু‌খে শা‌ড়ির গোলা‌পি অাভা প’‌ড়ে মি‌ষ্টি দেখা‌চ্ছিল খুব। নীলরা এ‌সে‌ছিল চারজন। ক‌ণে দেখার উ‌দ্দেশ্যে এ‌সে‌ছে, বকু‌লের বা‌ড়ির লোকজন এমনটা জান‌লেও মূলত তা‌দের লক্ষ্য ছিল খাওয়া। চারজ‌ন মি‌লে শ দু‌য়েক টাকা ক‌ণের হা‌তে ধ‌রি‌য়ে দি‌লেই দি‌ব্যি ভর‌পেট ভূ‌রি‌ভোজ হ‌য়ে যায়। ক‌ণে‌কে তারা দু‌য়েকটা প্রশ্ন ক‌রে, বেশ একটু পরখ ক‌রে দে‌খে, সেটা বাড়‌তি পাওনা। দ‌রিদ্র, অসহায় এসব প‌রিবা‌রের

কা‌ছে কন্যা মা‌নে দায়, যে কো‌নোভা‌বে তা‌দের‌কে পাত্রস্থ কর‌তে পার‌লেই তারা হাঁফ ছে‌ড়ে বাঁ‌চে। মে‌য়ে‌কে পাত্রস্থ করার চিন্তায় অ‌নেক সময়ই তারা এই চ‌ক্রে ফেঁ‌সে যায়, ভো‌জের অা‌য়োজনটুকুই সার হয় তা‌দের।

বকুল মাথায় অাধা ঘোমটা টে‌নে তা‌দের সাম‌নে নতমু‌খে ব‌সে, প্রশ্ন কর‌লে নিচুস্ব‌রে উত্তর দেয়। নীল বে‌শিরভাগ দিন চুপচাপ থা‌কে। খাওয়ার সময় গোগ্রা‌সে গে‌লে, তারপর সবার সা‌থে ফির‌তি হাঁটা দেয়। সে‌দিন বকুল‌কে দে‌খে তার হঠাৎ কী ম‌নে হ‌য়, ফস ক’‌রে প্রশ্ন ক’‌রে বসে, তু‌মি কি গান জা‌নো?

অবাক, ভীত চো‌খে ঝট ক’‌রে তাকায় বকুল। এমন অদ্ভুত, বেয়াড়া প্রশ্ন সে কো‌নো‌দিন শো‌নে নি। শুন‌বে ভা‌বেও নি। গরীব, দিনমজুর এক প‌রিবা‌রের মে‌য়ে সে, পঞ্চম শ্রে‌ণি পর্যন্ত নামে মাত্র প‌ড়া হ‌য়েছিল তার, সেও ঢের অা‌গে। পেটপু‌রে খে‌তে পায় না তিন‌বেলা, সেখা‌নে গান কো‌ত্থে‌কে অার কীভা‌বে শিখ‌তে পারত, ভে‌বে পায় না সে। নিরুত্তর কিছুক্ষণ নী‌লের চো‌খে কী একটা খোঁজে, তারপর না‌মি‌য়ে নেয় চোখ। নি‌জের প্র‌শ্নে নি‌জেই থতমত খে‌য়ে চুপ ক’‌রে যায় নীল। বন্ধুরাও ন‌ড়েচ‌ড়ে বসে একবার, গলা খাঁকা‌রি দেয়।

নী‌লের এমন সৃ‌ষ্টিছাড়া প্র‌শ্নে বকু‌লের প‌রিবা‌রের লোকজন‌কেও হতাশ, বিমর্ষ দেখায়। পাত্র হি‌সে‌বে সে‌দিন নীলকেই জা‌হির করায় তার প্র‌শ্নের গুরুত্ব ঢেরগুণ বে‌শি হ‌য়ে পাত্রীপ‌ক্ষের কা‌ছে ধরা দেয় এবং তারা, পু‌রো অা‌য়োজ‌নের পয়সাটাই জ‌লে গেল, এবারও মে‌য়ে‌কে পাত্রস্থ করা গেল না ইত্যাকার বিষয় ভে‌বে ম‌নে ম‌নে ভীত, সন্ত্রস্ত হ‌য়ে ও‌ঠে। কিন্তু নী‌লের সে‌দিন কী হয় হঠাৎ, সে সবার সব অাশংকা ফুৎকারে উ‌ড়ি‌য়ে দেয় নি‌মে‌ষেই। বন্ধু‌দের, বকু‌লের প‌রিবারের লোক‌দের স‌র্বোপ‌রি বকুল‌কে অবাক, হতভম্ব ক‌’রে দি‌য়ে সে সহসাই ঘোষণা দেয় যে পাত্রী তার পছন্দ হ‌য়ে‌ছে, এবং খুব শিগ‌গিরই সে একটা দিনক্ষণ স্থির ক’‌রে, বি‌য়ে কর‌তে প্রস্তত। নী‌লের এমন অদ্ভুত অাচর‌ণে বন্ধুরা অবাক, প্রশ্নভরা চো‌খে তার দি‌কে তাকায়, পাত্রীপ‌ক্ষের মুখ অান‌ন্দে উজ্জ্বল হ‌য়ে ও‌ঠে কিন্তু সেস‌বের বাই‌রেও, নীল সহসা দে‌খে, তার এমন ঘোষণায় বকু‌লের শ্যামলা মু‌খে দপ ক‌রে একটুক‌রো অা‌লো জ্ব‌লে ও‌ঠে, সে অবাক, লজ্জা লজ্জা ডাগর চোখ তু‌লে নী‌লের চো‌খে তা‌কি‌য়ে তখন তখনই চোখ না‌মি‌য়ে নেয়। অার নীল, নি‌জের ম‌ধ্যে কেমন অদ্ভুত এক কাঁপু‌নি টের পায়, বু‌কের ভেতর কী একটা ছল‌কে ও‌ঠে, সারা শরী‌রে ছ‌ড়ি‌য়ে প’‌ড়ে অভূতপূর্ব শিহরণ। ‌

ফেরার প‌থে বন্ধু‌দের টিটকারী, ঠাট্টা-মস্করা উ‌পেক্ষা ক‌রে সে চুপ থা‌কে পু‌রোটা সময়, এবং একফাঁ‌কে জা‌নি‌য়ে দেয় যে এমন ধাপ্পাবা‌জি‌তে অার সে থাক‌বে না এরপর। তারপর থে‌কে বকু‌লের প‌রিবার এবং বকু‌লের সা‌থে যোগা‌যোগ রা‌খে, জা‌নি‌য়ে দেয় শিগ‌গিরই কো‌নো একটা কাজ যোগাড় ক’‌রে বাপ-মা‌য়ের মত নি‌য়ে বকুল‌কে ঘ‌রে তুল‌বে সে। বকু‌লের সা‌থে সম্পর্ক যতটা দৃঢ় হয় গাঁজার অাড্ডার সা‌থে সম্পৃক্ততা ততই দ্রুত অালগা হ‌য়ে অা‌সে তার। নি‌জের ভেত‌রে ঘু‌মি‌য়ে থাকা অন্য সত্ত্বাটা‌কে সে প্রাণপ‌ণে চেষ্টা ক‌রে বাই‌রে অানার। একটু একটু ক’‌রে সে নি‌জের ভেত‌রের অন্ধকারটা‌কে মু‌ছে ফেলার চেষ্টা ক’‌রে চ‌লে।

‌কিন্তু সন্ধ্যেটা সব উ‌ল্টেপা‌ল্টে দেয়। তার ভেত‌রের অন্ধকারটা‌কে ঢেরগুণ বা‌ড়ি‌য়ে তু‌লে স‌ন্ধ্যেটা তা‌কে ডু‌বি‌য়ে দি‌য়ে যায় সীমাহীন অন্ধকা‌রে। পিয়ার বা‌ড়ি ফেরে শহর থে‌কে। বাজা‌রের উত্তরপা‌শের কা‌লিবা‌ড়ির বাঁধা‌নো বে‌দি‌তে সে‌দিন শ‌খের গাঁজার অাড্ডা ব‌সে। স‌ন্ধ্যের অাবছা অন্ধকারে, ফি‌কে জোছনায়, অাড্ডা স‌বে জ‌মে ও‌ঠে তা‌দের, বন্ধু‌দের অনু‌রো‌ধে গলা ছে‌ড়ে কেবলই নীল গে‌য়ে ও‌ঠে লাল‌নের গান, অার তখনই বিষম চিল-‌চিৎকা‌রে সচ‌কিত, উৎকর্ণ হ’‌য়ে ও‌ঠে পু‌রো এলাকা। অাড্ডা ফে‌লে তারাও ছু‌টে যায় দুদ্দাড়। তারপর একছু‌টে পা‌লি‌য়ে যায় নীল। জীবন থে‌কে, পৃ‌থিবী থে‌কেও পালা‌তে চায় সে।

‌পিয়ারই তা‌কে অা‌বিষ্কার ক‌রে পর‌দিন, শ্মশা‌নের নির্জন কো‌ণে, ঘু‌মে অ‌চেতন, সংজ্ঞাহীন। সে হাসপাতা‌লে ছো‌টে নীল‌কে নি‌য়ে সেই প্রায়ান্ধকার ভো‌রে, একা। ফলত একই হাসপাতা‌লে মাত্র এক‌টি রা‌তের ব্যবধা‌নে বাপ-‌ছে‌লে‌কে দু‌টি বে‌ডে মৃতবৎ প’‌ড়ে থাক‌তে দেখা যায় তখন। একজন চৌর্যবৃ‌ত্তি‌তে নে‌মে বিদ্যুৎস্পষ্টতায়, অন্যজন জীব‌নের দুঃসহ লজ্জা অার গ্লা‌নি থে‌কে বাঁচ‌তে অাত্মহত্যা-চেষ্টায়। তিন‌দিন পর হাসপাতাল থে‌কে পিয়ার তা‌কে ফি‌রি‌য়ে নেয় নিজ বা‌ড়ি‌তে, ভাল‌বে‌সেই হয়‌তো।

‌দিন দু‌য়েক পর দুর্বল, অসুস্থ শরী‌রে ধী‌রে ধী‌রে পিয়ার‌দের বাঁধা‌নো দী‌ঘির ঘা‌টে গি‌য়ে শু‌য়ে দী‌ঘি‌তে নামা অাকাশ দে‌খে নীল। দেখ‌তে দেখ‌তে ঘু‌মি‌য়ে প‌’ড়ে, অাবার জা‌গে, অাবার ঘু‌মোয়। স‌ন্ধ্যের অন্ধকার ঘন হয়, ঘন হয় নী‌লের ম‌ধ্যে জন্ম নেওয়া ঘোর। সে বুঝ‌তে পা‌রে না কোনটা স‌ত্যি, তার বেঁ‌চে থাকা না‌-কি মৃত্যু, জে‌গে থাকা না-‌কি ঘুম। তার ম‌ন থে‌কে মু‌ছে যায় সব অন্ধকার, মু‌ছে যায় একহাট লো‌কের সাম‌নে রক্তাক্ত, শরীরময় দগদ‌গে ক্ষত নি‌য়ে মৃ‌তবৎ ফ্যাকা‌সে মু‌খে সংজ্ঞাহীন প’‌ড়ে থাকা তার জন‌কের মুখ, বিদ্রুপাত্মক, অপমা‌নের চাবু‌কে ভরা সেই একহাট জনতার ছুঁ‌ড়ে দেওয়া শ্লেষাত্মক বাক্যরা‌শি, যা মূলত ব‌র্ষিত হয় তা‌কেই লক্ষ্য ক‌রে। সে ভু‌লে যায় কলাপাতায় শুই‌য়ে রাখা তস্কর মকবুল অালীর নি‌র্জিব, ঘেন্না জাগা‌নো ঘেয়ো শরীর, ভু‌লে যায় তার গ্লা‌নিময় জীবন, বেঁ‌চে থাকার দুঃসহ, দুর্বহ লজ্জা। স‌ন্ধ্যের অন্ধকা‌রে দী‌ঘির বাঁধা‌নো ঘা‌টের খোলা হাওয়ায় শু‌য়ে নি‌জের জীব‌নে নামা অন্ধকার‌কে ধী‌রে ধী‌রে বিস্মৃত হ‌তে থা‌কে নীল। প্রবল এক ঘো‌র তা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে নি‌তে থা‌কে। তার মাথার ওপর ঝাঁকঝাঁক মশা সেই অন্ধকা‌রে বা‌জি‌য়ে চ‌লে অন্য এক বি‌থো‌ফেন। নী‌লের ম‌নে হয় এমন এক ঘু‌মেরই সে অ‌পেক্ষায় ছিল এতকাল, এমন এক পৃ‌থিবীর। ঘু‌মের ম‌ধ্যে সে ত‌লি‌য়ে যায় অন্য এক পৃ‌থিবীর স্ব‌প্নে, ডু‌বে যায় অন্য এক সু‌রের মায়ায়। সেখা‌নে অন্ধকার নেই, বিদ্রু‌পের ছু‌রি নেই, অপমা‌নিত, লা‌ঞ্চিত জন‌কের মুখ নেই এমন‌কি ক্লি‌শে এক জীব‌নে পুনরায় বেঁ‌চে ওঠার গ্লা‌নিটুকু পর্যন্ত নেই। অন্য এক ঘু‌মে, ভিন্ন এক বি‌থো‌ফে‌নে ডু‌বে নতুন এক জীবন খোঁ‌জে নীল, মু‌ক্তিও।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu