শামীম আহমেদ
জন্ম: শাজাহানপুর, বগুড়া, ২৭ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে চিত্রকলায় এম.এফ.এ। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কর্মরত।
শামীম আহমেদ

অন্তিমযাত্রা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

লাফারু এই আদি অন্ধকার অরণ্য ঢিহির সাহসী শিকারি হলেও, তার অতিরিক্ত অজ্ঞতার কারণে সে যেন সাহসী তকমা খুইয়ে বসে। শামানের(ওঝা) চালাকি মার্কা বাক্যবাণে সে জন্তুর মতোই বিঁধে যায়। কারণ, পথের ধারের পটপটি আর ভাঁট পাতার উপর ছড়িয়ে থাকা বালুময় গুড়োগুলোকে শামান বলছে যে, ‘এইগুলান রোদের গুড়া!’ লাফারুর তাতে বিশ্বাস আনতে দমবন্ধের মতো বোধ হচ্ছে। শামান লাফারুর অবিশ্বাসে মূর্খতার স্পষ্ট ছায়া দেখতে পায়, তার ভঙ্গিমায় যেন অবজ্ঞার মূর্তি ফুটে বের হয় । লাফারুর ধারনা নেই ‘হেদা’ বনভূমির এই অঞ্চলে সবই হয়? ‘মনসা’ গাছের ডালগুলো সাপের মতো নড়বড়, লকলক করে।‘ছামি’ গাছের ফল ধরে বারো বছর পর; আর সেই মাকাল রঙ্গা ফল কেউ খেতে পারলে তার বয়স কমে যায়, অমরত্ব পায়। লাফারু কিছুই জানেনা। তাই, শিক্ষকের গাম্ভীর্য শামানের উপর ভর করে তাকে ভারি করে তোলে। সে বলে, ‘ছামি ফলের নাম যে শোনেনি বা দেখেনি- সে মূর্খমনু(মানব); যে দেখেছে- সে জ্ঞানীমনু; আর যে খেয়েছে সে মহামনু। তবে এই অঞ্চলে কোন মহামনু বা মহাজ্ঞানী নেই। তুমি কোন দলে?’ লাফারু পোষা প্রাণীর মতো লোকটির জ্ঞানী কথা নির্দ্বিধায় শুনে ও মেনে নিয়ে বলে দেয় সে মূর্খ।  বন-বাদারে শিকার করে বেড়ালেও সে তার এলাকায় বা গোত্রে কখনো এই ফলের নাম শোনেনি। ‘শামান, তুমি কোন দলে?’

‘এখানে তুমি আমি একই দলের, আমি শুনলেও-দেখিনি। ছামি ফল এক মায়াবী ফল। কারো চোখে তা পরার আগেই ‘হুলু’ পাখি তা খেয়ে ফেলে।’

লাফারুর উপগোত্র থেকে দুই সলজং(সূর্যোদয়) পার করে সূর্যোদয়ের দিকে নিচু এক ঢিবির উপর এই  ‘হেদা অরণ্য’। কখনোই এই দূর অরণ্য তার উপগোত্রের জীবিকার অংশ ছিলনা। এলোমেল ফাঁপানো ঝাঁকড়া চুলের মতো ডালপালা ছড়ানো; জ্ঞানী বৃদ্ধের মতো থম মারা গাম্ভীর্যময়। বুনো খরগোশের পিছে তাড়া করতে গিয়ে লাফারু যখন বনের মধ্যে ঢুকে পরে তখন সূর্য মাথার উপর। তীরবিদ্ধ খরগোশ তিতবেগুন ঝোপের আড়ালে যখন মৃত্যুর হাঁপ তোলে; তখন দূরে-গাছের আড়ালে নড়াচড়ায় বন্য জন্তুর শঙ্কায় লাফারু সতর্ক হয়। বন্য জন্তু এই অরণ্য জীবনের প্রধান শত্রু। আর শত্রু থাকলে  সকল অরণ্য মনুই সদা সতর্ক থাকে। নাক উঁচিয়ে জন্তুর মতো বাতাস শোঁকে। তখন মাথায় পাখির পালক গোঁজা, অর্ধউলঙ্গ- পাকালো লাঠি দেহের কোন আতিরিক্ত অঙ্গের মতো আঁকড়ে ধরা লোকটাকে  নড়বড় করে দুলে দুলে নির্ভয়ে এগিয়ে আসতে দেখে তার চোখের আকৃতি বিস্ময়ে পরিধিতে বাড়ে- যা বহু মস্তকবিশিষ্ট কোন প্রাণী দেখলেও হতোনা । মিশমিশে-খ্যাঙ্গড়া মার্কা চেহারায় তার আক্রমনাত্মক কোন লক্ষণ লেখা নেই, কিন্তু একটা নির্ভেজাল পুলকিত ভাব আছে। আগ বাড়িয়ে এসে তীরবিদ্ধ খরগোশটা তুলে ধরে,‘আমার কাছে হুতার আছে’ বলার আগেই অভ্যাস বশে লাফারু তূণ থেকে তীর বের করে ছিলা টান করে ধরে।  তার নির্বিকার ভাবে ও কথায় বন্ধুত্বের গন্ধ পেয়ে এবার লাফারু ধনুক কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে। এই ঘোর অরণ্যে কোন মনুকে দেখবে তার ধারনা ছিলনা। লোকটি তখন পায়ের কাছে মরা-শুকনো পাতা ঢিবি করে পাত্থর ঠুকে আগুন জ্বালায়। খরগোশটা লাফারুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হাড়ের ছুররাটা এগিয়ে ধরে। আগুনে ধোঁয়ায় তখন অস্ট্রিক লোকটিকে  আধিভৌতিক লাগে।  লোকটির আচরিত অঙ্গভঙ্গি  ও বেশভূষা লাফারুর এই ধারণাকে সমর্থন করে যে, লোকটি শামান। এই অরণ্য এবং আশেপাশের অরণ্যের গোত্রগুলোর সমন্বিত কতিপয় বাক্যাংশ ও ইঙ্গিতের সাথে অস্ট্রিক ভাষা মিলিয়ে তারা কথা বলে, ‘তোমার নাম কি?’  লাফারু তার নির্লিপ্ত আবেগহীন মোটা ঠোঁট ফাঁক করে, ‘শিকারীর পরিচয় শিকারে’ বলে মরা খরগোশটি দেখিয়ে দেয়। লোকটি চালাক; লাফারুর ইঙ্গিত ধরে ফেলে। দৃষ্টি পিটপিটিয়ে ঘন ঘন কাছে ও দূরে ছড়িয়ে দেয়, ‘লাফারু? তার মানে তোমার গোত্র ও লাফারু। তবে, ‘কুলকেতু(টোটেম)’ প্রাণী মেরে কেন মাদাং(বড় পাপ) করলে? কোন গোত্র শিকারী তা করে না।’

‘আমি মাদাং বয়ে বেড়াচ্ছি।’ লাফারুর রহস্য করে কথা ছাড়ে।

‘হেয়ালি করোনা! তুমি জানোনা,- হেদা বনে সূর্য মাথার উপড় থাকলে শিকার অমঙ্গল?’

‘এই নিয়ম আমি মানি না।’

‘তাহলে, তুমি মূর্খ।’

‘তুমি প্রথম বললে, আমি মূর্খ।’

‘মুর্খ মনু বড় শিকারী হয় না।’

‘তাহলে আমি মূর্খ নই।’

২.

‘সর্বশেষ ছামি ফল দেখা মনু আ্মাদের কাছে ছিল ‘তমরু’।’ আদিম অরণ্যের রহস্যপূর্ণ আবহ ও বিচিত্র জন্তু-জানোয়ারের হাক-ডাক উপেক্ষা করে শামান তার কন্ঠ মন্ত্রের মতো গমগমে করে তোলে। নিজের আধ্যাত্ম ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের জন্য অনর্গল কথা বলে শামান; লাফারুর দুই সলজং পার করে হেদা অরণ্যে একা আগমন ছমছমে ভীতিকর হিসেবে মেনে নেয় না, জেনে কিঞ্চিত প্রশংসা করে। কিন্তু বলে, এটা যে কেউ একটু সাহসী হলেই করতে পারে।  শামান তার কথার সাথে চর্বিত খরগোশের আধাসিদ্ধ মাংস ও ঘোরলাগা চোখের ঘোলাটে দৃষ্টির সহযোগে বর্ণিত ঘটনা ঘোরতর করে তোলে । ‘আমরা তাকে সন্মান করে ‘জ্ঞানবৃদ্ধ’ বলতাম। শারীরিক অথর্বতার কারনে সে তা ভক্ষণ করতে পারেনি। পারলে সে আমাদের প্রথম ‘মহাজ্ঞানী’ হতে পারতো। সে ছিল আমাদের গোত্রের সবচেয়ে বৃদ্ধ মনু।’ শামানের নাম জানা যায়না। তার গোত্রের বয়স্করা ছাড়া তার নাম কেউ জানতো না। এই হেদা অরণ্য সে জন্তুর মতো চষে বেড়িয়েছে। হস্ত রেখার মতো হেদা তার পরিচিত। ‘তোমার গোত্রের বাকিরা কোথায়?’ প্রশ্নে শামান কেমন যেন বিচলিত হয়ে যায়। একনজর হেদার জঙ্গল দেখে লাফারুর দিকে মুখ ফিরিয়ে সে বলে, ‘আমি আমার গোত্রের শেষ মনু।’ তারপর লাফারুকে আর প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে, ‘তুমি এই বনে কেন?’ তখন লাফারু, শামানের মতো করে হেদা অরণ্যের চারপাশ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে একপাক ঘুরিয়ে এনে তার মতো করেই বলে, ‘ আমি আমার গোত্রের শেষ মনু।’ তাদের পায়ের তলায় স্থির শীতল ছায়া বৃক্ষের এবড়োথেবড়ো ছায়ার সাথে গড়াগড়ি খায়। শামান চমকে ওঠে, তার মনে আশঙ্কা বাজে। ঝট করে সে লাফারুর বাহুতে প্যাঁচানো পশুর চামড়া সরিয়ে দেখে,- মাংস ভেদ করে বের হয়েছে ছোট দু’টি পাতা সহ অজ্ঞাত গাছের কুঁড়ি।

‘তুমি কি মনু অরণ্যে যাচ্ছ?’ হাতটা সরিয়ে নিয়ে আবার চামড়ায় পেঁচিয়ে নিয়ে লাফারু উত্তর দেয়, ‘আমি ভাবতাম এটা একটা উপকথা!’

শামান তার হাতের কড়ায় হিসেব করে তার জন্মের অনেক আগের হড়পাবানের কথা বলে। দাদু হরম-তার দাদু হরম-তারো দাদু হরমের কালের কথা। হেদার উঁচু অরণ্যে থাকার কারনে তাড়া তলিয়ে যায়না। ‘সলজং দ্যাও (সূর্য) আমাদের উপর রুষ্ট হয়। এর মুখ থেকে একদা হুতারের (আগুন) পুচ্ছলি(লেজ)ওয়ালা পাত্থর হেদা বনের পাশের নিচুভূমিতে পরে। শামানের গোত্রের সেরা শিকারী মনু দুইবেলা পথ মারিয়ে দূর পাহাড়ের উপড় থেকে দেখে। তিন মনু সমান উঁচু পাত্থরের গা থেকে তখনো হুতার জ্বলে। সেই নিচুভূমির অজানা গোত্রের মনুদের চেহারায় আড়ষ্টতা ও ভয় নিয়ে পাত্থরটি ঘিরে রয়েছে। কিছুদিন পর দেখা যায় সেই গোত্র জুড়ে অদ্ভুদ একটা রোগ। যারা পাত্থরের কাছে গিয়েছিল, সেই মনু মরদের শরীর ভেদ করে বের হয়েছে অজ্ঞাত গাছের কুঁড়ি। তাদের গোত্র শামানের সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের শরীর থেকে বের হওয়া ডাল বড় হতে থাকে। অদ্ভূতভাবে তারাই মারা যায়- যাদের শরীর ফুঁড়ে কোন কুঁড়ি বের হয়নি; আর যারা জীবিত ছিল..। আমাদের সেরা শিকারী প্রতিদিন পাহাড়ের উপড় থেকে তাদের গোত্র পর্যবেক্ষণ করতো। সে ছিল বিজ্ঞ ও সাহসী। আমাদের গোত্রের প্রথম আক্রান্ত মনু । গোত্রপ্রান্তে থাকার কারণে আমরা কেউ আক্রান্ত হইনি। দূর থেকে আমার পূর্বপুরুষেরা তাকে শেষ বিদায় জানিয়েছিল। এতোটুকু বলার পর শামান লাফারুর দিকে তাকায়। লাফারু নির্লিপ্ত। নির্লিপ্ততার ভাবান্তর না ঘটিয়ে বলে, ‘তারপর?’

‘রোগটি নিচুভূমির গোত্রের শেষ মনু মরদের শরীরে ছড়িয়ে পরলে, আমাদের মুখিয়া তখন গোত্র শামানকে বলে ‘বাঁধুনীমন্ত্র’ দিয়ে হেদা বনের ওপাড়ের নিচুভূমি বন্ধনী দিতে । আমাদের জন্য সেটি নিষিদ্ধ এলাকা।’

‘তাহলে সেটিই মনু অরণ্য?’

‘হ্যাঁ, এটি একটি সমাধীস্থল। যারা মারা গিয়েছিল , অনুমান,- মাদ্যাও তাদের মঙ্গল করেছে। যারা জীবিত ছিল তারা সকলই বেচারা, তারা সকলে এখনো জীবিত।’ এবার লাফারুর ভাবান্তর ঘটা করে শামানের চোখে পড়ে। শিথিল দেহ উত্তেজনায় আড়ষ্ট করে তোলে। জিজ্ঞাসাটা এখন তার চোখ থেকে সারা দেহে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু মুখের গহ্বর থেকে কিছুই শব্দায়িত করেনা। থেমে থাকা শামান সেটি উপভোগ করে তার চোখের উপর নজর ফেলে আলগোছে বলে, ‘একসময় তারা একে একে পরিপূর্ণ গাছে রূপান্তরিত হয়েছে।’

‘এখন তোমার খেতে হবে রক্তফল। আফাংলতার শিকড়ের রস লাগিয়ে দিতে হবে।’

‘তাহলে তুমি শুধু শামান নও; বৈদ্যও!’

‘গায়ে মাখতে হবে রোদের গুড়া। যাতে আর অন্য কোথাও দিয়ে কুঁড়ি বের না হয়।’

‘রোদের গুড়া, সেটা আবার কি?’

ভ্যাবাচেকা মার্কা প্রশ্ন শুনে শামান রহস্য করে হাসে। বলে, ‘এইজন্যই আমি শামান এখনো একা বেঁচে আছি।’

‘কেন তুমি গোত্রের বাকিদের বাঁচাওনি?’ এই প্রশ্নে শামানের ঠোঁটে ঝুলানো হাসি উবে যায়। চেহারায় ঝপ করে মনখারাপি আঁধার নেমে আসে। লাফারু তা বুঝতে পেরে বিব্রত হয়। কাছাকাছি কোন জঙ্গলে কান্নার মতো সুরে কোন পাখি চেঁচিয়ে ওঠে। শামানের মুখে আবার হাসি ঝুলে পড়ে। সে আলতো করে বলে ওঠে, ‘জলঝড়ি হবে!’

‘কিভাবে বুঝলে?’ লাফারু জঙ্গলের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে তিরের মতো মাটিতে গেঁথে থাকা সূর্যরশ্মির দিকে তাকিয়ে বলে। শামানের মুখে সেই ঝুলানো হাসি বিস্তৃত হয়, সাথে একটা বিজয়ী ভাব। যেন নিজেকে সে জাহির করার জন্যই একটা ভাবগাম্ভীর্যর ভেক ধরে। যেদিকে পাখি ডেকেছে, সেদিকে আঙ্গুলের ইশারা করে, ‘জলঝড়ি হওয়ার অনেক আগে থেকেই হুলু পাখি ডাকে। আর ডাকে বিশেষ এক কারণে!’

‘এই সেই হুলু পাখি?’ এবার আর শামান উত্তর করে না। তার মাঝে উত্তেজনা দেখা যায়। সে ছটফট করে। বিরবির করে মনে মনে। ‘হুলু পাখ্রি এমন ডাকের পর যে জলঝড়ি হয়; সেই জলঝড়ির পরই ছামি গাছে ফল ধরে।’ শামানের কথা লাফারুর কাছে হেয়ালির মতো মনে হলেও, এবার সে কিঞ্চিত আশান্বিত হয়। বেঁচে থাকা অথবা অমরত্বের আশায় উভয়ের চোখ চকচক জ্বলে।

 

৩.

দুই সূর্যোদয় পার করে তারা হেদা বনের মাঝামাঝি পৌঁছায়। আপাতত তারা হুলু পাখির কোন সারা শব্দ পাচ্ছে না। পাত্থরের উপর শিকড় পিষে তার রস শামান লাফারুর আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে দেয়। মনু অরণ্য বরাবর শামানের গোত্রের নজরদারিতে ছিল। ছুছুম দ্যাও(চাঁদ) একবার ক্ষয়ে আবার ভরাট হলে সেখানে গিয়ে তারা নজরদারি করত। জ্ঞানবৃদ্ধের আত্মা ‘মাদ্যাও’ নিয়ে গেলে তাদের এই প্রক্রিয়ায় বেশ ভাটা পড়ে। একদা তাদের গোত্রের অরণ্য অদ্ভূত সুবাসে ভরে গেলে তারা তার সন্ধানে বের হয়। তাদের অরণ্যসহ  হেদা অরণ্য এই ঘ্রাণে মোহিত হয়ে থাকে। গোত্রবুড়ী বলে কোন ফুলের সুবাস। কিন্তু তারা ফুল খুঁজে পায়না। গোত্রের সবাই এরপর অসুস্থ হয়ে গেলে শামানের সন্দেহ জাগে। ‘মনু অরণ্যের সাথে এর যোগাযোগের আশংকায় সেখানে গিয়ে দেখি..!’ অসম্পূর্ণ বাক্যে লাফারু দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’ শামান লাফারুর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টির অর্থ লাফারুর কাছে বিস্ময় হয়ে ধরা দেয়। সেই দৃষ্টি বজায় রেখে শামান বলে, ‘মনু অরণ্যের গাছগুলো নেই।’

‘গোত্রে ফিরে দেখি সবাই মৃত। ততদিনে অরণ্যে সুবাসের মাত্রা কমে আসে। সন্দেহ নিয়ে আবার মনু অরণ্যের কাছে যাই। গিয়ে দেখি গাছগুলো আগের জায়গাতেই আছে। তাদের ডালপালায় হুতাররঙ্গা অদ্ভূত ফুল। মনু অরণ্য তাদের সুবাসে সুবাসিত। হিসেব কিছুতেই মেলেনা। মেলে যদি মেনে নেই যে..।

‘এখন গাছগুলো হাঁটতে পারে!’ শামানের কথা কেড়ে নিয়ে লাফারু বলে ওঠে।

‘তুমি দেখি অতটাও মূর্খ নও!’

‘বাঁধুনীমন্ত্র?’

‘সেটাই প্রশ্ন। কোন ভাবে এটি টুটে গেছে। আবার নতুন করে বাঁধতে হবে।’

‘বাঁধুনীমন্ত্র তুমি জানো, শামান?’

‘আমিই শেষ মনু, যে বাঁধুনীমন্ত্র জানি।’ শামান একটু ভেবে নেয়। ‘এবার পুরো মনু অরণ্য বাঁধুনী দিতে হবে। অরণ্যের ভিতর দিয়ে যেতে হবে।’

‘তুমি যদি আক্রান্ত হও? নাকি শামান বলে তুমি এবারো রক্ষা পাবে মনে করো?’ শামানের এবারের হাসিটা অদ্ভুত। লাফারুর মনে হয় এমন হাসি কোন মনুর হয়না। ‘বাঁধুনী দিতে আমার একজন সঙ্গী দরকার ছিল। এই মহা অরণ্য আর এই ডিহির মহা দ্যাও ‘হুক্কুদ্যাও’ আমার কাছে তোমাকে পাঠিয়েছে।’

‘তোমার কি হবে?’

‘তুমি বোধ হয় আসলেই মূর্খ!’ শামান এবার বিরিক্ত হয়। মাথার উপর থেকে পাখির পালকের টুপিটা খুলে ফেলে। এবং লাফারু অবাক হয়ে দেখে, শামানের কানের পাশ থেকে বেশ বড় একটি কুঁড়ি উঁকি দিচ্ছে।

 

৪.

‘আমরা আত্মহনন করতে পারিনা? অথবা দুইজন-দুইজনের হন্তারক?’

‘কুঁড়ি জন্মানোর পর হত্যা বা আত্মহননে কোন লাভ নেই। সুপ্ত বীজের মতোই তা কাজ করে। বাঁধুনীমন্ত্রের জন্য আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। যাতে বৃক্ষদশায় আমরা বাঁধুনীর বাইরে বের হতে না পারি।’

‘আবার যদি বাঁধন খুলে যায়? এই অরণ্যের ভবিষ্যত গোত্রগুলোর কি হবে? তারা তো আর বাঁধুনীমন্ত্র জানেনা।’

‘নিশ্চয় তাদের আমার চেয়েও ভালো কোন শামান থাকবে!’

লাফারু চুপ হয়ে আছে। শামান তাকিয়ে থাকে সামনের গন্তব্য পথে। কি নীরব নির্জন দোষলাগা একটা অরণ্য। মিহি বাতাস ভেসে আসে নীচুভূমির মানববৃক্ষগুলোকে ছুঁয়ে। অন্য গাছগুলোর সাথে আদৌ যাদের কোন প্রভেদ নেই। লাফারুর কোন অস্থিরতার চাঞ্চল্য নেই। আগের মতোই নির্লিপ্ত সে। শামানের এই অন্তিম সফরের পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেও, লাফারুর নির্লিপ্ততা সে সাহসে পাল্টে নেয়। মনে হয় সে যেন গতানুগতিক কোন শিকারে যাচ্ছে। আর শামান এই অরণ্য জীবনে একমাত্র সাহসীদের ছাড়া আর কাউকেই সমীহ করে না। শেষ বেলায় সে লাফারুকে তার চেয়েও সাহসী হিসেবে ধরে নেয়।

‘বৃক্ষদশার শেষ মূহুর্তে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই!’

‘আমি শেষটা জানতে অস্থির হয়ে আছি।’ শামান মলিনতার হালকা ছোঁপ লাগা সাহসী হাসি তুলে ধরে। দুজন সাহসী অথবা অপারগ আদি অরণ্যভূমির মানব এরপর অবলীলায় মনুঅরণ্যের ঢালুতে নেমে পরে। লাফারু তির-ধনুক শক্ত করে ধরে। যদিও সে জানেনা বৃক্ষদশার পর এইগুলো কোন কাজে লাগবে কিনা!

দূরে কোন অজ্ঞাত জন্তু বিদঘুটে ডেকে তাদের স্বাগত অথবা বিদায় জানায়।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu