আমি তখন অনেক ছোট, ক্লাস ওয়ান কিংবা টু-তে পড়ি। সময়টা ছিলো শীতকাল। আমার চার নম্বর চাচার ছোট ছেলে রিপনকে নিয়ে এই ঘটনা। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক মাসের বড় ছিলো, তাই রিপনকে ভাই বলেই ডাকতাম। আগে গ্রামে অধিকাংশ বাড়িতেই খেজুরের রস জ্বালানো হতো গুড় তৈরির জন্য। সকালে আমি হাঁটতে হাঁটতে রিপন ভাইদের বাড়িতে যাই।
তখনও সূর্যের দেখা মেলেনি। হাড় কাঁপানো শীত। আমি আর রিপন ভাই বাগানে হাঁটছি। ছোটবেলা থেকে তার একটা বদ অভ্যাস ছিলো– দাঁড়িয়ে প্রসাব করা। এটা বড় হয়েও করতে দেখিছি। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। তার প্রসাব যেখানে পড়ছে সেখানে কিছু একটা নড়াচড়া করে উঠলো। তারপর দেখলাম রিপন ভাই কাঠি দিয়ে নেড়ে একটা ছোট্ট পাখি বের করে এনেছে। সে হাতে তুলে নিলো, দেখি নড়ছে। শীতে পাখিটার অবস্থা অনেক করুণ। রিপন ভাইয়ের প্রসাবের গরমে পাখিটা নড়েচড়ে ওঠে। কারণ, পাখিটার সমস্ত পশম কুয়াশা ও শিশিরে ভিজে গিয়েছে। পশম আর বোঝা যাচ্ছে না শুধু পাখিটার মাংস পিন্ডগুলো দেখা যাচ্ছিলো। তারপরে রিপন ভাই কলের পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিলো পাখিটাকে। বেশি শীত পড়লে কলের পানিও মোটামুটি গরম অনুভব হয়।
তারপরে আমরা রস জ্বালানোর বাইনের (যে চূলায় রস জ্বালানো হয় তাকে বাইন বলে) কাছে গেলাম। পাখিটা হলো টুনটুনি। রিপন ভাই পাখিটাকে দুই হাতের কোটরে রেখে আগুনের উষ্ণতা দিচ্ছিলো। এভাবে অনেক সময় পার করার পরে পাখিটা যে টুনটুনি তা দেখে বোঝা গেল। পাখিটা এখন একটু একটু করে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে।
আমাদের মনের মধ্যেও নতুন একাট আশা বেঁধেছে। আমরা দুইজন পরিকল্পনা করলাম, একটা পাখির খাঁচা তৈরী করবো। পাখিটাকে আমরা পুষবো। নিজেদের মধ্যে একটা উত্তেজানা কাজ করছে। এমনিতেই পাখি পেয়েছি এটা একটা ভালো লাগা; তারপর আবার পাখিটা পুষবো, অন্য রকম এক ভালো লাগা নিজেদের মধ্যে কাজ করছিল।
রিপন ভাই আমাকে বললো, আমরা পাখিটা যদি পুষি তাহলে তো খাঁচা তৈরী করতে হবে। রোদটা ভালো ভাবে উঠুক তারপরে আমরা বাঁশ বাগানে গিয়ে বাঁশের কুঞ্চি কেঁটে নিয়ে এসে, খাঁচা তৈরী করবো। কিরে থাকবি তো আমার সাথে!
– হ্যাঁ থাকবো।
– টুনটুনি কী খায় জানিস?
– জানি, চালকুমড়ো পাতার ছোটছোট পোকা খায় আবার ফুলের মধুও খায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
– টুনটুনি ভাত খায়?
– আমি জানি না। দিলে খেতে পারে।
– ঠিক আছে, আমরা টুনটুনিকে পোকাও খাওয়াবো আবার ভাত খাওয়ানো শিখাবো।
– রিপন ভাই, পাখিটাকে আমরা শিকারী করবো (পোষ মানাবো)।
– ঠিক আছে। শিকারী করতে পারলে আমরা স্কুলে নিয়ে যেতে পারবো। তখন লোকে আমাদের বলবে ছেলে দুটি অনেক ভালো, পাখি শিকারী করেছে।
মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা খেলা করেছে। একের পরে এক মনের মধ্যে নানা ধরনের স্বপ্ন বাসা বাঁধছিলো। সে আনন্দ কাউকে বোঝানোর নয়। পাখিটা আমরা যেহেতু পুষবো, তাই আমাদের একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। টুনটুনি পাখিটা আমাদের কাঁধে বসে থাকবে। আমরা কোথায়ও গেলে আমাদের সাথে যাবে। যেমনটা সিনেমায় দেখি।
এখন পাখিটা ভালো ভাবেই ডানা ঝাঁপটাতে পারছে। এদিক ওদিক একটু একটু উড়ছেও। আগুনের উষ্ণতায় পাখিটা প্রাণোচঞ্চল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে পাখিটা উড়ে গিয়ে বাইনের আগুনের মাঝখানে পড়লো। শুকনো বাবলা গাছের মগডালের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। দেখতে দেখতে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে খাক হয়ে গেলে। পাখিটা হয়তো ভেবেছে, আগুনের উত্তাপে আমি সম্পূর্ণ প্রাণোচঞ্চল হয়ে উঠেছি। এতটুকু দূরত্বে যখন এত সুখ পেয়েছি, না জানি ওর মধ্যে কত সুখ আছে। তাই টুনটুনি পাখিটা লাল ও হলুদবর্ণ মিশানো আগুনে অতিসুখ নিতে গেলো। আমরাও দেখতে পারলাম আমাদের আশা আর স্বপ্ন কিভাবে আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গেলো।
দুই জনের মধ্যে কী যে খারাপ লাগা কাজ করছিল! সেই স্মৃতিটা মনে হলে এখনও অতিসুখের দৃশ্যটা স্পষ্ট চোখে ভেসে ওঠে।