জালাল উদ্দিন রুমি ছিলেন ১৩ শতকের একজন ফার্সি সুন্নি মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী এবং সুফী। তাঁর ৫টি কবিতার অনুবাদ করেছেন প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মনজুরুল ইসলাম।
অতিথিশালা
এই মানবজাতির অস্তিত্ব একটি অতিথিশালা।
প্রতিটি ভোরই এক ধরনের নতুন আগমন।
দুঃখ, আনন্দ, হীনমন্যতাসহ প্রতিটি ক্ষণস্থায়ী সচেতনতাই
উদ্ভুত হয় এক অপ্রত্যাশিত প্রদর্শক হয়ে।
সবকিছুকেই স্বাগত জানাও,
আতিথেয়তা কর স্বতস্ফূর্তভাবে,
এমনকি যদি তারা বিশাল
দুঃখের কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
যদি হিংস্রভাবে তোমার বাড়ির আসবাবপত্র সাবাড় করেও ফেলে।
তবুও তুমি তাদের সম্মানের সাথে আপ্যায়ন করো।
এমনকি কাউকে খুশি করানোর জন্য
তারা তোমাকে নির্দয়ভাবে তাড়িয়েও দিতে পারে।
তবুও অন্ধকারাচ্ছন্ন চিন্তা, লজ্জা, বিদ্বেষ
সবাইকে হাসতে হাসতে
তোমার দরোজার সামনে আসতে দাও,
এবং তাদেরকে ভেতরে প্রবেশের জন্য
আহ্বান জানাও।
যেই আসুক না কেন,
সবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো।
কেননা প্রত্যেকই তোমার কাছে আসে,
অনেক দূরের পথ থেকে
তোমাকেই পথ প্রদর্শন করাতে।
অনন্ত প্রহরের এপার-ওপার
সৌন্দর্য তার সমাঙ্গ অধিরূপকে রাখে অনস্তিত্বের অসীম নীরবতায়।
সততই সে তার মুখাবয়বের দিকে ধরে রাখে একটি আয়না,
এবং সেই আয়নার অন্তরে আগলে রাখে তার সৌন্দর্যকে।
সবকিছুই তার জানা এবং তিনিই সর্বজ্ঞ।
তিনি সবকিছুই জানেন এবং জানিয়ে দেন সবাইকে।
তিনি সবকিছুই দেখতে পান
এবং প্রদান করেন ভবিষ্যৎবাণী।
তার চোখ ব্যতিরেকে কোনো চোখই
আজ অবধি এই ব্রহ্মাণ্ডের দিকে তাকায়নি।
তার দক্ষতার প্রতিটি প্রকোষ্ঠেই অন্বেষিত থাকে একটি সুনিপূণ প্রকাশভঙ্গি।
অনন্তকাল, মূলত সময় ও স্বাধীনতার এক সবুজ শ্যামলিমা মাখা তৃণভূমি;
আর ভালোবাসা, সেটি মূলত এই পৃথিবীর নবজীবন দানকারী ফুলেল বাগান।
আর সে বাগানের প্রতিটি তরুশাখা, পত্রপল্লব এবং ফলমূল,
মানুষের দৃষ্টির দুয়ারে প্রজ্জ্বলিত করে রাখে তার প্রত্যাশার বিশুদ্ধতাকে।
তার রাজকীয় ক্ষমতার ইঙ্গিত প্রদান করে সাইপ্রেস বৃক্ষ,
এবং তার সৌন্দর্যকে সকল তথ্য প্রদান করে বৃক্ষের সুবাসিত গোলাপ।
সৌন্দর্য যখনই তাকায়,
ভালোবাসা তখনই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়।
যখনই সৌন্দর্য তার গোলাপী গণ্ডদেশ প্রদর্শন করে,
তখনই ভালোবাসা উদগীরণ করে আনে আলোকরশ্মি তার অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে।
যখনই সৌন্দর্য বাস করে ঘনঘোর রাত্রির ভাঁজে,
বিনুনীর মতো জট পাকিয়ে তখনই ভালোবাসা আসে
এবং খুঁজে নেয় একটি হৃদয়।
প্রকৃতপক্ষে, সৌন্দর্য এবং ভালোবাসা হলো দেহ ও আত্মার মতো।
সৌন্দর্য হলো খনি আর ভালোবাসা হলো এক টুকরো হীরে।
প্রাগৌতিহাসিক কাল থেকেই এরা একসাথে আছে
আছে পাশাপাশি, আছে নিবিড় অন্তরঙ্গতায়।
আর কত!!!
যন্ত্রণাদগ্ধ এই জীবন নিয়ে
আর কতদিন তুমি
চিন্তার জাল বিস্তৃত করবে?
আর কতদিন
অনিষ্টকর এই পৃথিবীকে নিয়ে
ভাবতে থাকবে তুমি?
এই ভাবনাগুলি
শুধু একটিই সমাধান দিতে পারে তোমায়,
আর সেটি হলো–
তোমার জীবনীশক্তির ক্ষয়।
তাই এসব অনুভূতিকে
আবর্জনা হিসেবে আর না ভেবে,
বরং বন্ধ করে দাও
তোমার চিন্তার দরোজা।
কোনো এক গোধূলীলগ্নে
কোনো এক গোধূলীলগ্নে
আকাশে হেসে উঠলো চাঁদ,
অতঃপর হাসতে হাসতেই
নেমে এলো পৃথিবীতে,
দেখতে থাকলো আমায়।
শিকারের সময় বাজপাখি যেভাবে
চুরি করে পাখিকে,
ঠিক সেভাবেই চাঁদ এসে
চুরি করে নিয়ে গেলো আমায়,
ধাবিত করলো প্রবল বেগে গগন পানে।
নিজেকে দেখতে থাকলাম আমি,
কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না আমি
আমার মাঝে।
নয় নয়টি গোলক অদৃশ্য হয়ে গেল সেই চাঁদে,
আর আমার অস্তিত্ব!
সমুদ্রের অতল গহীনে জাহাজ যেভাবে ডুবে যায়
ঠিক সেভাবেই ডুবে গেল।
আমার দুয়ারে কে?
কে আমার দুয়ারে দাঁড়িয়ে, কে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আপনার বিনীত ভৃত্য আমি, উত্তর দিলাম।
তুমি কী করো? তিনি জানতে চাইলেন।
আপনাকে অভিবাদন জানানোই আমার কাজ হে প্রভু,
আমি বললাম।
কিন্তু কতদিন চলবে তোমার এই কর্মযজ্ঞ?
উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন তিনি।
যতদিন আপনি চাইবেন,
এই বলে আমি আশ্বস্ত করলাম তাকে।
আর কতদিন নিজেকে এই আগুনে পোড়াবে?
যতদিন অবধি না খাঁটি হতে পারি
নিশ্চিত করলাম তাকে।
এটি আমার ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা
এবং এ ভালোবাসার জন্যই
আমি ত্যাগ করেছি আমার পদমর্যাদা।
তুমি শুধু তোমার নিজের পক্ষে
সাফাই গাইছো,
আসলে এর কোনো সত্যতা নেই।
তিনি আমার উপর জোর খাঁটিয়ে বললেন।
আমি অকুণ্ঠ চিত্তে বললাম,
এই যে দেখছেন আমার চোখের বিন্দু বিন্দু অশ্রু; এই অশ্রুই আমার স্বাক্ষী।
আমার ফ্যাকাশে মুখশ্রী;
এটিই আমার স্বাক্ষী।
কিন্তু তোমার প্রমাণাদির তো কোনো বিশ্বস্ততা নেই।
তোমার চোখ এতটাই আর্দ্র যে
সেখানে পৌঁছানোই দায়।
এবার প্রবল আস্থা নিয়ে আমি বলতে থাকলাম
আপনার ন্যয়বিচারের বহ্নিদীপ্ত প্রভাই
আমার ভেজা চোখকে সমুজ্জ্বল ও ত্রুটিবিহীন করে তুলবে।
তুমি আসলে কী খুঁজছো বলো-তো?
আপনাকে, আপনাকে প্রভু,
আপনাকে আমার স্থায়ী বন্ধু হিসেবে খুঁজছি।
কী চাও তুমি আমার কাছে,
বলো তো, বলে ফেলো।
আপনার দিগন্তবিস্তৃত অনুগ্রহ,
এক সমুদ্র অশ্রু নিয়ে বললাম আমি।
তোমার সাথে এ যাত্রায় আর কে কে ছিল বলতো দেখি?
কেউ না, শুধুই আপনার চিন্তার মগ্নতা, প্রভু, শুধুই আপনার চিন্তার মগ্নতা।
কিন্তু বিশেষ কি আকর্ষণ করলো তোমায় যে,
এখানে আসলে তুমি?
কেন! আপনার কোমল পানীয়ের সুঘ্রাণ,
সেইই তো আমায় ডেকে নিয়ে এলো এখানে।
কিসে তোমার পূর্ণতা আসে বলবে কি?
বলবো না কেন!
আমার পূর্ণতা আসে সম্রাটের সাহচর্যে।
কিন্তু, সেখানে কী পাও তুমি?
শত শত অলৌকিকতা।
আচ্ছা, এখানে এত নির্জনতা কেন, বলো-তো?
আমি বললাম, তারা সবাই চোরকে ভয় পায়।
কিন্তু কে সেই চোর? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
যে আমাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে
সেই-ই চোর,
আমি বললাম।
কিন্তু তাদের নিরাপত্তা?
কর্ম এবং ত্যাগের মাঝেই– আমি বললাম।
কিন্তু সেখানে ত্যাগ করবার মতো কিইবা আছে?
পরিত্রাণ প্রাপ্তির প্রত্যাশা, প্রভু, আত্মপরিত্রাণের প্রত্যাশা।
কিন্ত তাদের দুর্দশা কিংবা দুঃখটা কোথায় বলো দেখি?
আপনার প্রাণবান ভালোবাসার উপস্থিতিতে।
এই জীবন থেকে তুমি কীভাবে সুখ অণ্বেষণ করো?
নিজের কাছে নিজেই সৎ থাকবার মাঝেই– আমি বললাম।
এই মুহূর্তে প্রকৃতই সময় হলো নীরব থাকবার।
আমি যদি তাঁর প্রকৃত অস্তিত্ব নিয়ে তোমাদের বলি
তাহলে তোমরা তোমাদের সত্তা ছেড়ে আকাশে উড়বে, হারিয়ে যাবে সুদূর নীলিমায়।
কোনো পিছুটানই আর ধরে রাখতে পারবে না তোমাদের।