দ্রোহের কবিতা নিয়ে দর্পণের একটি বিশেষ সংখ্যা ‘অগ্নিফুল’, সংখ্যাটিতে প্রকাশিত রিগ্যান এসকান্দারের পাঁচটি কবিতা—
হঠাৎ শহরের তেমাথায় অজ্ঞাতনামা এক লাশ পেল নগরবাসী।
কার লাশ? কীভাবে এল? কেনো এল?
এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা পৌরবাসীর।
লাশের মাথায় টুপি। লাশের পরনে পাঞ্জাবি।
শহরের এক তুখোড় বামপন্থী নেতা ভিড় ঠেলে এসে বলে–
‘এ হেফাজতে। নির্ঘাত হেফাজতে ইসলাম।’
লাশের হাতে ব্রেসলেট। লাশের পরনে জিনস।
শহরের এক শরিয়তি ইমাম ভিড় ঠেলে এসে বলে–
‘এ কমিউনিস্ট। নির্ঘাত নাস্তিক।’
লাশ কাটা ঘরে গেল লাশ
খুলে নেওয়া হলো পাঞ্জাবি, টুপি, জিনস, ব্রেসলেট।
লাশ কাটা ঘরে গেল লাশ
তার পাঞ্জাবির পকেটে পাওয়া গেল
চুল বাঁধার এক জোড়া রঙিন ফিতা।
কালো মাতাল ডোম
জনহীন অন্ধকার লাশ কাটা ঘরে চিৎকার করে বলে-
‘এ প্রেমিক। নির্ঘাত এ প্রেমিক।’
একটি মাটির ব্যাংক কিনে এনে খোকাকে দিলাম
বললাম, ‘ এক টাকা, দুই টাকা– খুচরা পয়সাগুলো
জমিয়ে রাখিস বাবা।
অভাবের সংসারে কাজে দেবে আমাদের।’
একদিন দুর্দিনে পরিবারসুদ্ধ আমরা
সে ব্যাংকটা ভেঙে দেখি,
ভেতর থেকে বেরিয়ে এল–
বায়ান্নটি মিছিল
উনসত্তরটি স্লোগান
একাত্তরটি স্বাধীনতা।
এসব দেখে আমরা তো থ।
আমাদের চুপ থাকা দেখে খোকা বলে উঠল–
‘বাবা, এ দেশে এসব এখন অচল বুঝি।’
রানি যেই তার প্রসাধনীর শৌখিন বক্সটা খুললো
ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো পঞ্চাশ সৈন্য।
মাথায় তাদের কালো হেলমেট, মস্তিষ্কে আগুনের চিন্তা।
পঞ্চাশ সৈনের অতর্কিত আক্রমণে
রাজপ্রাসাদ পুড়ে গেল, দাউ দাউ করে জ্বললো নগর।
আর বক্সটির দুই পাশে দেখা দিল সরু দুটি বারুদের পথ।
এক পথ দিয়ে রাজার মৃতদেহ নিয়ে গেল শত্রুর দল
আরেক পথ দিয়ে রানি হেঁটে যেয়ে পুড়ে মরলো বিরহের আগুনে।
সেই থেকে রানির সেই শৌখিন বক্সটির নাম হলো ফায়ারবক্স,
রূপবতী রানীর বিরহে আজো আমরা যা পকেটে নিয়ে ঘুরি।
চাঁদ সূর্যের কাছে ধার করে খায়।
চাঁদ যে কদিন ধার করে খায়
সে কদিন পূর্ণিমা।
চাঁদ যে কদিন ধার শোধ দেয়
সে কদিন অমাবস্যা।
আমরা পূর্ণিমা ভালোবাসি।
মূলত আমরা অভাবি বলেই—
আমরা আরেক ঋণগ্রস্ত চাঁদের প্রশংসা করি।
আমাদের অভাবের আরেক নাম পূর্ণিমা।
ওয়ালস্ট্রিট থেকে একটি নোট উড়াল দিয়ে
শহর পেড়িয়ে, গ্রাম পেড়িয়ে, কাঁটা তার পেড়িয়ে
ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতবর্ষে পৌঁছে গেল।
আমেরিকানরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল
আকাশে পায়রার মতো পুঁজিবাদ উড়ছে।
এরপর নোটটি উড়ে উড়ে রাশিয়া হয়ে চীনে ঢুকল।
মাওয়ের ছাত্ররা দেখল– একটি সমাজতান্ত্রিক পায়রা চায়নার আকাশে উড়ছে।
এরপর উড়ে উড়ে নোটের পায়রাটি বাংলাদেশের আকাশে পৌঁছে গেল।
তামাম পৃথিবীর আকাশে উড়ে উড়ে ক্লান্ত নোটের পায়রা
হঠাৎ এসে পড়ে গেল বাংলাদেশের এক ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকের শুন্য থালায়।
পৃথিবীর সমস্ত পূঁজিপতিরা এগিয়ে এল– এ নোটের পায়রা রাষ্ট্রের।
পৃথিবীর সমস্ত সমাজতান্ত্রিকরা এগিয়ে এল– এ নোটের পায়রা সকলের।
পৃথিবীর সমস্ত খিলাফতিরা এগিয়ে এল– এ নোটের পায়রা ঈশ্বরের।
তারপর সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল–
এ নোটের পায়রাটি ঈশ্বরের ঘরে দান করো– প্রভুর নামে শান্তি বর্ষিত হোক।
এ নোটের পায়রাটি জনতার মালিকানায় আনো– এসো সকলে মিলে পুষি।
এ নোটের পায়রাটি রাষ্ট্রকে দিয়ে দাও– সেমিনারে পায়রা উড়াবেন রাষ্ট্রপতি।
অথচ কারো কথা না শুনে ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক নোটের পায়রাটি হঠাৎ গিলে নিয়ে বলল–
গরিবের পেটের চেয়ে বড় তন্ত্র, রাষ্ট্র অথবা ধর্মশালা
কোনো শালা দেখিনি আজো।
এ ঘটনার পর থেকে জাতিসংঘের চোখে ঘুম নেই।