কান্তি ভূষণ তরফদারের ৫টি কবিতা
নিরব উপস্থিতি
শহরে হঠাৎ বেড়েছে হত্যা-গুম।
জনমনজুড়ে শংকা ভীষণ, নাগরিক নির্ঘুম।
যেন রূপকথা ফিরে ফিরে আসে অবাক সত্য হয়ে।
দৈত্য-দানোর ভয়ে কাটে রাত ঘুমহীন, সংশয়ে।
পিতাহারা শিশুকন্যা এখন একাকী ঘুমায় খাটে–
অশ্রুতে ভেজে বালিশ-বিছানা, বিনিদ্র রাত কাটে।
ঘুম পাড়ানোর ছল করে মাতা দেখায় কাদের ভয়?
আসছে… ওরা আসছে আবার, নেই নাম-পরিচয়!
ওরা আসে অতি সাধারণ বেশে, মানুষের মতো ঠিক।
নয় ওরা কোনো দৈত্য-দানব, পিশাচ কাল্পনিক।
তবে কেন হায় ওদেরই ভয়ে নাগরিক মনে ভীতি?
নিউজপেপার খুললেই দেখি ওদের উপস্থিতি!
ধর্ম
কেউবা প্রণাম ঠোকে বেদীমূলে, কেউবা পাথরে করিতেছে চুম্বন।
কারোবা গলায় ঝুলছে ক্রুশ, কারো মাথা মুন্ডন।
কেউবা পরিছে ধূতি-পাঞ্জাবি, কেউ রাখে দাড়ি-টুপি।
ঈশ্বর হেথা বিচিত্র বেশে বিরাজিত, বহুরূপী।
কেউবা তাহারে সন্ধ্যার শেষ আজানের সুরে খোঁজে,
কেউবা ঘন্টা, শঙ্খধ্বনিতে বিনম্রে চোখ বোজে।
বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক আর কোরানের পাতা জুড়ে,
একই সে সত্তা, পবিত্রবাণী আসিয়াছে ঘুরে ঘুরে।
ধর্মে এখানে ভিন্নতা তবু, ঈশ্বর সবাকার।
বিশ্বজগত জুড়ে একজনই, সবই এক সত্তার।
ঈশ্বর কভু বিভেদ আনেনি ধর্মে ধর্মে কোনো।
বিভেদ আনেনি কোনো অবতার, শেষ নবীর আগমনও।
ধর্মান্ধরা প্রভেদ এনেছে বিতর্কে, বিগ্রহে।
ধর্মকে ওরা ধারণ করেনি, পড়েছে অন্ধমোহে।
ওরা মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছে স্রষ্টার নামে, হায়!
ওরাই আবার বিভোর হয়েছে প্রভুর বন্দনায়।
ওরা মন্দিরে লুন্ঠন করে রাতের অন্ধকারে।
ওরাই আবার নম্রচিত্তে ডেকে যায় বিধাতারে!
ওরা গীর্জায় রক্তবন্যা বইয়ে দিচ্ছে আজ।
ওদের স্পর্শে অপবিত্র হয় শুদ্ধ জায়নামাজ!
ওরা গো-রক্ষা করার নামে মানুষ মেরেছে কাল।
ওরাই এনেছে শান্তির পথে ধ্বংসের জঞ্জাল।
ওরা বুদ্ধের অনুসারী তবু মানুষেরে করে ঘৃণা।
ওরাই আবার নিজহাতে করে জীবে দয়া-দক্ষিণা!
যারা প্রত্যহ পাপাচারে আনে মানুষের চোখে জল,
তারা হারিয়েছে বিধাতার কৃপা, মুক্তির সম্বল।
মানুষের খুনে রঞ্জিত হাত উর্ধ্বে তুলেছে যারা,
ওরাই করেছে ধর্মকে রোজ ধ্বংসের পায়তারা।
প্রত্যাবর্তন প্রশ্নে
মুজিব! মুজিব! শুনতে কি পাও আর
করুণ আকুতি, মৌন রোদন, মুমূর্ষ বাংলার?
তোমার ছেলেরা আজও মরছে মিছিলের শিরোভাগে।
শাসকেরা আজও জনতার বুকে লোহার কামান দাগে!
আজও দিকে দিকে লাঞ্ছিত হয় তোমার মা ও বোন।
পীড়িতেরা আজও বিরহ-অশ্রু করছে সংগোপন।
হয়েছিলে তুমি নিঃসংকোচে যুদ্ধশিশুর পিতা।
কার বলে আজ সান্ত্বনা পাবে শত শত ধর্ষিতা?
কার ইন্ধনে উদ্ধত হবে দলিত-পেষিত লোক?
হেথা সন্ত্রাস প্রকাশ্য পথে– শান্তিরা পলাতক।
শেকল ভেঙেছো– হাজার শেকল আমাদের হাতে-পায়
জানান দিচ্ছে পরাধীনতার, নানান ব্যর্থতায়।
দুর্বৃত্তের মুখে মুখে শুনি তোমার প্রিয় নাম।
সংগ্রাম তুমি শেখালে আমরা সন্ত্রাস শিখলাম!
তুমি শুয়ে আছো বাংলা মায়ের আঁচলের ছায়াতলে।
আমরা ভাসছি দুখিনী মাতার করুণ অশ্রুজলে।
মুজিব! মুজিব! আরেকটাবার আসবে কি বাংলায়?
আরেকটাবার দীক্ষিত হবো সত্যে, স্বাধীনতায়।
ঘ্রাণ
তোমার চোখের কাজলরেখায় আমার মৃত্যুফাঁদ।
তবুও করেছি উষর হৃদয়ে প্রণয়ের চাষাবাদ।
তোমাকে ভেবেছি বাদলপ্রহরে নির্জন পথ হেঁটে।
তোমার হাসির সম্মোহনে সময় গিয়েছে কেটে।
তুমি কি ভিজেছ এমন শ্রাবণে? শরীরে মেখেছ জল?
সলিলে সলিলে শুনেছি তোমার নূপুরের কোলাহল।
আষাঢ়ে প্লাবন ভিজিয়েছে তব মেঘ-মোলায়েম চুল
শুদ্ধ সুবাসে ভরিয়ে দিয়েছ হৃদয়ের উপকূল।
মাঝরাতে বৃষ্টি
শহরে মধ্যরাত– রাস্তায় জ্বলে আলো।
মেঘে মেঘে বাজে তুমুল দামামা, বিদ্যুৎ চমকালো।
রেলিংয়ের পরে উদ্বাস্তু পাখি, ভিজছে ফুলের টব।
ইলিকট্রিকের খুঁটির উপর মৌন জলোৎসব।
এমন বৃষ্টিমুখর নির্জন কোনো রাতে
ইচ্ছে শুধুই হাঁটবো তোমার সাথে।
গল্প না হোক, জল্পনা হবে সঙ্গী।
বৃষ্টির ছাঁটে বদলাবে মুখভঙ্গি।
ফিসফিস হাওয়া– নিসপিস হাত মুঠোয়,
লুটোবে এমন যতখুশি জল লুটোয়।
শুধু শান্ত সলিলে ভিজবো তোমার সাথে
এমন কোনো শ্রাবণের বর্ষাতে!