সোহানা খাতুনের কবিতা
ঝুমবৃষ্টি হলেই বদ্ধ কপাটের আগল খুলে বেরিয়ে পড়ে মন।
হয়তোবা দূর গাঁয়ের সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে,
ওইতো, ওখানে, ক্ষীয়মাণ কেরোসিন কুপির ক্ষীণ আলো
ঘিরে বসে আছে তিনটে শীর্ণ অবয়ব;
ঝুপ করেই আলো নিভে যায়, আঁধার জমাট হয়ে রাতকে করে আরও দীর্ঘ।
আর উঠোনে ছোট্ট চালার নিচে
সিক্ত উনুনে নির্জীব আগুনখানা উস্কে দিতে দিতে
দীর্ঘশ্বাসে মা ভাবে, “এ বর্ষা কাটবে তো!”
অথবা, ওই যে সেই বাঁধনহারা বিকেলে
হঠাৎ দুর্দান্ত মেঘ ঝরঝরিয়ে নেমে এলো;
খেলা ফেলে ছোট্ট বালক দিল ছুট তার বিন্নির কাছে,
তাবিজ ঝোলা উদোম বুক মায়ের বকুনির শঙ্কায় ধুকপুক
উদ্ভ্রান্ত বিন্নির লেজ মুড়িয়ে দেয় তাড়া,
চকিত ধেনু রুদ্ধশ্বাসে পেড়িয়ে যায়
বৃষ্টির জলে ধুয়ে টকটকে লাল সুরকির সড়ক।
কিংবা কোনো একদিনের সেই ট্রেন মিস করা দুপুরে
নির্জন স্টেশনের ঘুমটি ঘরে
হুটোপুটি করে তিনটে মানুষ আর দুটো ছাগল;
এখানে ওখানে ঘরময় ফুটো চালার জল, ছাগলে মানুষে ঠেলাঠেলি,
আজন্ম এইখানে ঠাঁই নেয়া ছাগলের সাথে অনাহূতের অস্তিত্বের লড়াই।
নয়তো কোনো এক জাফরগঞ্জের মেলায়
নিতান্তই সাধারণ একটা মাটির পুতুল
অবুঝ বালিকার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
হঠাৎ আলোর ঝলকানি, নামে ঝুমবৃষ্টি,
মাঠজুড়ে মেলাকরদের ছুটোছুটি, মুহূর্তে শূন্য সব,
শুধু পড়ে থাকে দু’আনায় কেনা মাটির পুতুলখানা,
কাঁচারঙ গড়িয়ে চলে জলের তোড়ে।
হয়তোবা কখনও সেই পুরনো হাইস্কুলের বারান্দায়
ঝুমবৃষ্টি ঝমঝমিয়ে পড়ে টিনের চালার ‘পরে,
হঠাৎ ছুটি পাওয়া, খিলখিলিয়ে হেসে
জল ছিটানোর ছলে আড়চাহনি কিশোরবেলার প্রথম প্রেমের পানে।
নয়তোবা কোনো কোলাহলমুখর সন্ধ্যায় টি,এস,সি চত্বরে
তরুণ-তরুণীর অব্যক্ত প্রেম আচমকা ঝলসে ওঠা আলোয়
বিচ্ছুরিত হয়ে ঝরে বৃষ্টিবিন্দু হয়ে;
চকিতে ঘরে ফেরার তাড়া, খানিক বাদেই জুতো ছেঁড়ার ছলে
ভিড়ের থেকে পিছিয়ে পড়া, হাত বাড়িয়ে ধরতে যাওয়া,
অস্পৃশ্য মোহের টানে দ্বিধাগ্রস্ত বৃষ্টিস্নান।
আবার মুহূর্তেই দ্যাখো এই যে, এখানে, নির্জন ছাদে
শুধু তুমি আর আমি, বৃষ্টিস্নাত পাশাপাশি,
জলের মায়া ছড়িয়ে পড়ে চোখেমুখে।
অদ্ভুতভাবে বাড়িতে আজ কেউ নেই,
অদ্ভুতভাবেই পাশের ছাদে নেই কোনো উৎসুক দৃষ্টি।
এমনই মধুর স্বপ্নে বিভোর হয়ে ফেরারি মন
আবার বাঁধা পড়ে সেই ক্ষণে
যেখানে ঝুমবৃষ্টি অঝোর ধারায় গড়িয়ে চলে চোখের জলে।