দ্রোহের কবিতা নিয়ে দর্পণের একটি বিশেষ সংখ্যা ‘অগ্নিফুল’, সংখ্যাটিতে প্রকাশিত হাসনাত নাগাসাকির পাঁচটি কবিতা—
তাহলে তুমি বলছো– কোথাও আগুন লাগেনি?
মিছেমিছি আঁচল পোড়ার গন্ধ পাচ্ছে আমার নাসিকা?
অকারণে আহাজারি করছে মানুষ?
বলছো– চাএ দুধ-চিনি বাড়িয়ে দিয়েছ?
আমার উচিত হবে– আরামসে চা উপভোগ করে প্রশংসা করা?
টিভি দেখোনি আজ?
দেখেছো?
জিতেছে? তিন উইকেটে? সেঞ্চুরি আছে?
তুমি কেবল দেখেছিলে ব্যাটের আগুন?
কে কার প্রেমিকার
আঁচল ধরে টান মেরেছে– তাও জেনেছো?
আর কোথাও? কোনোখানে?
মায়ানমার, প্যালেস্টাইন, কাতার, ইয়েমেন?
বাংলাদেশ?
কোথাও আগুন লাগেনি বলছো?
তবে কি এ আগুন কেবল দাউদাউ জ্বলছে বোধে?
তুলির আঁচড়ও তবে রাষ্ট্রীয় আইনকে চোদে?
দৃশ্যটা মজার ছিলো।
গ্রেফতার করা হলো আমাকে আর আমার বন্ধুকে।
মারাত্মক ও বিপজ্জনক অস্ত্র বহনের দায়ে
ঘাড় ধরে রাস্তা থেকে তুলে নেয়া হলো
আমাকে আর জনৈক বন্ধুকে।
বলা হলো– ধারালো অস্ত্র রক্তক্ষয়ী হয়।
আমাকে আর জনৈক বন্ধুকে
ব্যস্ত সড়কের মোড় থেকে
কলার ধরে টেনে হিচড়ে তোলা হলো জলপাই রঙা গাড়ির খাঁচায় ।
সে এক মনোরম দৃশ্য ছিলো!
নাটকীয় সেই দৃশ্য অবলোকন করে
মানুষজন বেশ মজা পাচ্ছিল!
আমরা
হলুদ বিকেলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম–
পৃথিবী
নিশ্চিতভাবে একদিন মানুষের হবে।
পরদিন জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চাওয়া হলো–
কার নেপথ্য সাহসে দুঃসাহসী হয়েছি আমি?
আমার বন্ধুকেও জিজ্ঞেস করা হলো।
আমরা কান্নার বদলে হেসে উঠলাম।
আমাদের চিবুক হতে খানিকটা রক্ত ঝরে পড়লো
সাদা মেঝেতে।
বাম চোখে ঝাপসা দেখছিলাম– মনে হলো
সম্মুখে দু’জন পোষা হায়েনা বসে আছে।
তারা বললো–
বিপজ্জনক অস্ত্র বহনে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা আছে।
রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গে আমরা আবারও হাসলাম।
ওরা আমাদের সমস্ত শরীর তল্লাশি করে
বলে উঠলো– ইউরেকা!
লিখা হলো– আমাদের কলমের মাথা
সূচালো ধারালো আর– বিপজ্জনক!
একদিন ভরদুপুরে
বরুণের বউয়ের খুব কাছে যাবো।
বলবো– বড় তেষ্টা পেয়েছে বৌঠান, একটু জল দাও।
বলি বলি করেও বলা হয়নি।
বিস্তীর্ণ নগ্ন মাঠের ঘামে ভেজা হলুদ দুপুর
পেরিয়ে যাবো; বাড়ির পিছনদিকে
আম আর বাতাবির ঝোপ নুয়ে পার হবো।
লাফিয়ে যাবো পুকুরপাড়ের সরু নালার নির্জনতা।
বলবো– তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে ছাতি,
বৌঠান, শীতল করো জলে।
বলি বলি করেও বলা হয়নি।
আজ, এতোটা বছর পর
কতো কতো পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসি–
সেই মাঠ, সেই বাড়ির পিছনে।
ফিরে আসি ছাইরঙা সন্ধ্যার বুকে।
ফিরে আসি বরুণের বাড়ির বিরাণ প্রাচীরে।
বরুণের বউয়ের খুব কাছে গিয়ে বলবো–
বড় তেষ্টা পেয়েছে বৌঠান– একটু জল দাও।
ক্ষয়রোগে বরুণের মৃত্যু হয়েছিল।
চিতায় তার ফণীমনসা দোলে সন্ধ্যার বাতাসে।
সেখানে পাল্টে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসে অগুনিত ক্ষণিক-মরণ।
বরুণের মেয়েটাও ডাঙর হয়েছে।
‘জল খাবে, কাকা?
চেষ্টা পেয়েছে? ‘
কোথাও ফুল ফুটছে না,
প্রেমে ও ঘৃণায় পুড়ছে চাতকের চোখ–
ঈশ্বরের কাছে আমি পৌঁছে দেবো এই বার্তা।
ঈশ্বর– বিচার করুন।
দুর্বিনীত বাহাসে আমরা
আর কতো বিপ্রতীপ ফাঁদে বন্দী হবো?
কেন আমরা হৃদয়ের চোখে
ছুঁতে পারবো না– পরস্পর উড়াল ডানা?
চোখে কেন বিদ্ধ থাকবে রক্তাক্ত তীরের ফলা?
আপনি বলেছেন–
ঋতু শেষে পরিযায়ী পাখি
পার্ভার্টেড হয়।
কার দুরভিসন্ধিতে খিল যায় বিস্তীর্ণ বাগিচা?
ভোরে সেই বাগানের পথে
একটা হৃদয় মরে পড়ে আছে, ধরুন।
ঈশ্বর, আপনার বিচার করুন।
এইমাত্র একটা পিঁপড়াকে হত্যা করলাম।
আঙুলে টিপে ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দিলাম নিরপরাধ পিপিলিকার।
নিরপরাধ?
সে আমার চিনির দানা টেনে নিচ্ছিল– এত্তো সাহস!
মাননীয় আদালত–
আপনার আইন কি বলে?
মানবতাবাদী– আপনার যুক্তি কি বলে?
যেমন গতমাসে এক কোপে কেটে ফেলেছি দুশ্চরিত্র বিড়ালের কান। তারপর কিছুদিন পচাগলা কান নিয়ে ঘুরঘুর করে মরে গিয়েছিল।
সে আমার সাধের চিংড়ির ঝোলে মুখ দিয়েছিল– এত্তো সাহস!
মাননীয় আদালত– আমার সম্পদে মুখ দেয়ার অধিকার কেউ রাখে?
মানবতাবাদী– পৃথিবীতে একটা বিড়ালের বেঁচে থাকার কী এমন আবশ্যকতা?
আপনাদের আইন ও নিয়ম অনুসারে
আমার সম্পদের একমাত্র ভাগিদার আমি।
যদিও পিঁপড়াটি জানতো না– এ সম্পদে আমি
একচ্ছত্র ভাগ বসিয়েছি।
যদিও বিড়ালটি কদাচিৎ বুঝতো–
পৃথিবীটা প্রাকৃতিক নেই।
বাটোয়ারা হয়ে গেছে কখন– কবেই!