মৌমিতা তাসরিন প্রত্যয়ের তিনটি কবিতা: ‘এইখানে এক শহর আছে’, ‘বৈশাখী’, ‘আপোস’
এই শহরের প্রতিটা সরু গোলির চিপায় গাঁজা-ভাং খেয়ে পড়ে থাকে শতাব্দীর শুদ্ধতম প্রেম।
এ শহর আমাদের টালির চাল বেয়ে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা আর
মেঘেদের ইয়ার্কি,
এ শহর বোনের চোখে জন্ম নেয়া টিনেজ নদী।
হদিস না পাওয়া ঠিকানায় নিদারুণ একা হাঁটা।
এ শহর পলিথিনে মোড়ানো ভুলভাল কৈশোর,
বয়োবৃদ্ধ গাছের কোটরে লুকোনো সরীসৃপের বায়োডাটা।
এ শহর ডাস্টবিনে পড়ে থাকা নাগরিক ফুল
ভুল হাতে পরিয়ে দেয়া আবেগের হাতকড়া।
এ শহর পাঁচটার বাসে উঠে পড়া পুরো অফিসপাড়া
কনভেয়র বেল্টে ফেঁসে যাওয়া টুকরো দুপুর,
মেকি হাসির আড়তঘর।
এ শহর কার্তুজ আঁকা ক্লিপে আটকে রাখা
অবরোধের অবাধ্য চুল।
এ শহর শাটল ট্রেন হয়ে ঢুকে পড়ে আমাদের রাত-ঘুমে।
সাত সাতটা বর্ষা পার করে মানুষও শিখে যায় সাপেদের স্বরলিপি।
মই নিয়ে বহু আগেই চলে গেছে সিটি কর্পোরেশন ভ্যান।
এ শহর যানজট, বাবার টুপি, আজান শোনা কাকভোর
এ শহর জ্যাকপট, বান্ধবীর ওড়না টাঙানো রঙিন করিডর।
এ শহর মায়ের হাতের শাঁখা-পলা, সন্ধ্যারতি, উলুধ্বনির বিকেল
এ শহর শিশুর মতই নিষ্পাপ, তাকে সাজিয়ে রাখা স্নিগ্ধ বাইবেল।
এ শহর শবনমের নীল শাড়ি, মেয়ে খেকো চোখ দালালের
গালের আঁচিলে জেঁকে বসা মাধ্যাকর্ষণ।
এ শহর ক্ষুধার্ত-মাংসাশী চোখ,
লোকলজ্জার ভয়ে ফ্যানে ঝুলে যাওয়া হাজারো ধর্ষণ।
এ শহর রাতপাখিদের লাল লাল ঠোঁটে জ্বলজ্বল করা দুরন্ত সায়ানাইড,
কচকচে একশো টাকার নোট।
এ শহর রোজ বৃষ্টি নামায়, খুলে দিয়ে দু’চোখের রেইনকোট।
এ শহর ঋণখেলাপি ‘ঋ’ হয়ে বসে থাকা
মহাজনের নাগরার তলা।
প্রত্নতাত্ত্বিক হাতের ইশারায় অনর্গল ছলাকলা।
এ শহর ম্যানহলে ঢাকা যুদ্ধজয়ের চোরাপথ
মুঠো খুলে দেয়া সুদীর্ঘ প্রাবন্ধিক রজনী
জমিয়ে রাখা সংযত ক্লিটোরিস,
বহুলব্যবহৃত যোনি।
এ শহরের অলিতে প্রেম, গলিতে প্রেম, প্রেম প্রেম গন্ধ সারা গায়,
আজীবন কমিটেড বলে আসা এ শহর, তবু রোজ রাতে বিছানা বদলায়।
একটা বিচ্ছেদসম্ভবা বিকেল
আর একটা লোকাল ট্রেনের কামরা,
মেঘ নিয়েছে অন্ধকারের ঠিকে
আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি আমরা।
পাড়ার যে কুকুরটা পলকা, কঙ্কালসার
সে-ই সাজাচ্ছে কিটো ডায়েটের চার্ট।
পাশে পড়ে থাকা ভাঙা টেপরেকর্ডার-
প্যাঁচানো ফিতের গেরোয় প্রমাণ লোপাট।
একটা একুশ পেরোনো ডাস্টার আজও
মুছে চলেছে ভুলভ্রান্তির অংশ
দিনের আলোয় তুমিও ভণ্ড সাজো,
রাত্রি এলেই ব্যক্তিগত জংশন!
সকাল সকাল কোথাও একটা জটলা;
কাঁটাতারে একটা ঝুলন্ত গোলাপি কামিজ
ভীষণ আতঙ্কে তোমারও যদি এঁটে আসে গলা
জানবে, লভ্যাংশের লকারে সবাই সমকামী!
কোন লিপ ইয়ারের তর্কে বাজেভাবে হেরে
বের হয়ে যায় সুইসাইড নোট আঁকা সুটকেস।
যে মেয়েটি আজ রাতে ঘরে ফেরেনি
তার নাম বৈশাখী– টিনেজ।
হতাশায় ডুবে থাকা পুরো ঢাকা শহরটাকে ঝোলায় পুরে দূরে সরে যাচ্ছে একটা আইবুড়ো সন্ধ্যে।
তির্যক গোলির শেষ বাঁকে, যেখানে গতকাল দু’জন যুবক যুবতি ছাড়াছাড়ি করেছিল
সেখানে আজ চার চারটে বাচ্চা প্রসব করেছে একটা মাদি কুকুর।
পাশেই, গোরস্তানে কড়া পাহারা এড়িয়ে ঢুকে পড়া অবাধ্য হাওয়া
হিসেব কষছে মাটি ও মানুষের জটিল ধারাপাতের।
আমি হাঁটছি।
উদ্ভ্রান্ত মনে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা একলা রাতে, শূন্য হাতে- রক্তপাতে।
বোধের সাথে টকশোতে বসেনি সমঅধিকারের কোন অ্যামিকেবল চেয়ার,
শুধু বিলবোর্ডে বড় করে লিখে দেয়া হলো–”পৃথিবীর একটা ভ্রুণও নষ্ট না হোক।”
কনে দেখা আলোয় হাসনাহেনা গাছ থেকে ঝরে পড়া সমস্ত মেয়েলি ফুলের গন্ধ গায়ে মেখে
গর্ভচ্যুত হয়ে যায় তিস্তা নদীর পার।
অনির্বাণ আগুনে পুড়তে থাকা হাড়ির মাছ, যার একটা জলজ অতীত রয়েছে; সে মা-সুলভ
বড়শির এঁড়ে টোপে রোজ গিলে খায় আপোসের অ্যানেস্থেশিয়া।
যেদিন মা-কে আপোস করতে করতে বাবার পাপোষ হতে দেখেছি, সেদিন থেকে আমি আর কখনোই সংসারী হতে চাইনি।