মজুমদার নোভেল
জন্ম- ১০ডিসেম্বর, ১৯৯৬। যাপন- চট্টগ্রাম। পড়াশোনা- ভেষজ বিদ্যায় দ্বিতীয় বর্ষ অব্দি। এখন স্থগিত।
মজুমদার নোভেল

ক্রাইসিস

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

০১।

প্রিয় খণ্ডকালীন চিরকুট–

আশা না করলেও আশাবাদী হতে এই যে রাস্তাটা, প্রচণ্ড করাতিরূপ আত্মব্যবধানে হেঁটে গিয়ে দেখি–
‘আমার মতোই ক্ষণজন্মা রোগ্নাত্বক বৈরাগী বৃক্ষ দুপুর’
সন্ধ্যাকালীন ধুলো আর আহতকালিন ঘুমের সকাল।

মার্ডার রাতের খড়সা কার্তুজ।


০২।

পুড়েছি পাতার শোকে অনাব্রত রাত–
ছাতিমের গন্ধে ভেসে তাড়ায় হিজলের রোদ।

শহরে তখনও ত্রিভুজাকৃতি রোদ– ফুটপাতে ছায়া মেলে দিল শতবর্ষী রমনা।
মেঘ কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনে জ্যাম; লেগে থাকে তোমার আমার মধ্যিকার যেমন বিভেদ–
শুকতারা কখনও কখনও চন্দ্রগ্রস্ত বিষাদ হয়? তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি এটাও, এমন অনেক অজিজ্ঞাসার ভীড়ে
চাঁচের চুন খসতে খসতে কখন তোমার ফেরার তাড়া নিকট চলে এলো, ভাবিনি তেমন নাভাবার মতোই

নয়তো–
তোমাকে দিয়েই হতো আমার বিটলস লিকার চা, আর ঘোড়াদের কার্তিক খাওয়া পূর্ণিমা।


০৩।

জানতে জানতে ভুলতে শুরু করলাম ইহ-নাগরিক দু’বেলা ক’মুঠো ক্ষুধা–
কখনও রোদ্রের, কখনও দুপুরের; কখনও কালের, বা কখনও বুকের।

খরা– আমার প্রিয়, যদ্দুর প্রিয় উপোষী কবুতর তার ডানার– মেঘের সমেত স্বাধীন–
পাঠ্যচক্রে হিমাঙ্ক গলনাঙ্ক বুঝতে বুঝতে ভাবছিলাম– ধুতুরার চাইতেও কি? হেমলক?

আফ্রিকার কোনো বনদিঘীর কথা মনে পরে হঠাৎ হঠাৎ-বা চেনা অজানা শৈবাল
পুরোনো দীর্ঘশ্বাসের মতন সময়ে অসময়ে নাপ্রেরিত কোনো বার্তায় হুটহাট চলে আসে– প্রেতাত্মা,
অভিশাপ পাপ অবহেলা অবজ্ঞা অনাচার বেদন স্বপ্ন অথবা দীর্ঘ শূন্যতা বহমান
মাকড়সার জালের মতন জড়িয়ে থাকা অভ্যাসে নিয়মিত অনুরাগ, আগ্নেয়মালা।

হাটতে ভাবতে এইসব–
ছুটে যাওয়া বাইপাস, বাতাসে জরাগ্রস্ত চিল, ডিজেল পোড়া শহর, আর ফুসফুস পোড়া গন্ধ।


০৪।

শহরের যাবতীয় ঘামের গন্ধগুলায় লুকিয়ে থাকে প্রত্নতাত্ত্বিক নাগরিক চিহ্ন যত–
হঠাৎ পায়ের ছাপ, অথবা নিরলস চুম্বনের দাগ– সন্ধানী জাহাজের আরও কিছু।
কাঁঠালের ঘামে জবজবে যে সবুজের রঙ, চলতি দেখা দু’চারটে নারীর আধুনিকা চমড়া
ঘুম থেকে বেরিয়ে এসে চোখ ভর করে কর্পোরেশনের স্থাপত্যে নির্মিত পাখিদের মলচিত্র
সাথে সাথে রংরুট–
ফইল্লাতলির ইলিশবাজার, বাংলাভাষার চাল, সভ্যতার দুর্ভিক্ষ হাহাকার।
মঠের দিকে জিউস নাকি ইবলিশ?

কবিতা আর লিখবো না ভেবে ভেবেও, নেশাদ্রব্য– সিগারেটের মতন নাছোড়শালা

ভালোবাসা প্রেম প্রণয়–
রবীন্দ্রাঞ্জন রুদ্র বিনয়
জীবনের ডাকে সাড়া দিয়ে
শক্তি মহাদেবের একছিটে উল্লাস
ঋত্বিক চোখ ভরা স্বাধীনতার ক্রোধ!

অবশিষ্ট বলতে আমার কেবল আছে বলতে ছাপোষা অহেতুক চিন্তা আর টুকটাক খুচরো শব্দ–
অভাবের চাইতেও দিগুণ শক্তিশালী, আগুন, এটেল মটির পিঞ্জর।

[আমাকে বুলেটাঘাত করলেও ক্ষতি নেই, ক্ষতি নেই ভালো না বাসলেও– তথাকথিত ইতর-ভদ্র বেওয়ারিশ কুকুর]


০৫।

কখন জানি সেই ঘাসপোড়া রোদের আলোয় মাথা রেখে পাহাড় মতন বুক নিয়ে বিগত জন্মদিন এসে চৌকাঠ’ পরে বলেছিলো একটা ছায়ার গানের নিত্য সরঞ্জাম।

শব বিধাতার মনের মতনই– উপেক্ষায় আর অপেক্ষায়
নিকট চলে যেতে যেতে আরও দূর নিবাসী বিপ্রসন্তান

এইটুকু বেলা দয়া করে বসো ঘ্রাণের মতন লেগে, দুপুর ছায়ার মতন নিরবতা ছড়িয়ে, ফুসফুসের ভিতর হৃদান্দোলনে হিমোগ্লোবিনে, চায়ের রেখায় রাখা শেষ চুমুকে আরও চাহিদার টানপোড়নে–


০৭।

রাজপথে একদল রক্তজবা– থ্যাঁতলে যাওয়া একটা বেগুনিমুন্ড; স্মৃতির ডানায় বিষাক্ত ফেনা
হাফাতে হাফাতে হৃদপিণ্ডটা শতাব্দীর দাসত্বের ভারে কাঁপতে কাঁপতে থুবড়ে পরে আমার চোখের সামনেই–
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখা একজাত অন্ধকার আকাশ কেবল, প্রিয়তমার শেষ চোখে আমি দেখেছিলাম অ্যামিবা
পিছুটান শৈশব, ছেঁড়া আঁচলে মায়ের মুখে ভ্যাঁপসা কান্নার প্রকোপ– নিতান্তই মধ্যবিত্ত দৈনন্দিন অভ্যেস
এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আমি এক পিতৃহীন টলোমলো মাস্তুল জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি রোজ–
অভাবে অনটনে অর্থহীন দুপুরের ক্ষুধায়– আরও কিছু বাকি করতে করতে– হে বোকাচোদা জীবন; আর ঋণাদগ্ধ সময়–

একটা কড়কড়ে নোট; আমায় ভালেবাসতে পারো? মৃত্যুর সীমানা অব্দি কেবল?


০৮।

সববাক্য তুলে নাও– মুক্ত করো তীরদের রণক্ষেত্র মুখি; মুখিতে আজন্ম আবদ্ধ!
সব ঘেন্নাদের রঙের পটে লিখে দাও তোমার শহুরে দেয়ালে দেয়ালে

দেখো, মুক্তির পরও কিন্তু মুক্তিটা আবদ্ধ দ্বৈত বন্ধে– পক্ষাপক্ষির হিসেব কাটতে কাটতে কখন যে ঘুড়ির সুতো কেটে গেলো– হায় ফানুস!

এখন আর আগের মতন নেই, বুঝলে–

চিহ্নিত টঙটাও এখন বিকেল চারটের পর চা কেৎলি শেষ লিকার কাপের চাওয়া মুহুর্ত, ছুটে ফিরা পিয়ানোর সুর আর পোড়া বিকেলের কার্তুজ কখনওই ফিরবে না একসাথে শহরে;-

হালাল বলছি, ফিরবে না।
আমার মৃত্যুস্তবকে পড়তে পারো ইচ্ছে হলে।


০৯।

তোমারে যেদিন কই–
কাছে আইয়া বহো, দুইখানা হিতানরে একত্রে নিয়া রাইতের কাহন কও
তুমি হেদিন কও না, পিঠ মোড়াইয়া ওইপাশ কইরা চোখ খুইলা রাখো–
মক্কা-মদিনারে ডাকো, আমারে ডাকো না?

তোমারে যেদিন চাই–
ঠোঁটের ঘ্রাণে ফিরাইয়া আনতে কাশ্মীরি শীত
চোক্ষের কেতুর ঘুম ছিড়া দিতে তোমার কাপড়ের আচলের মতন
তোমারে উদোম হাওয়ার মতন দেখতে কেমন, কও তো?
হেমন্তরসিক চাও, আমারে চাও না?


১০।

তুমি সম্ভবত আমাকে নিয়ে লেখনি দৈবাৎ কিছু–
চেননি আয়োজিত নক্ষত্র বিস্তৃত মধ্যাহ্নপথ।

আমি লিখেছি–

কাড়াঘাতের ভিতর খুপরিজানালার আলোর চোখে দেখে হিটলারিয় রক্তদানা পান করতে করতে রাত ভিজে বৃষ্টির জানালায় অবশিষ্ট মুখের উপর।

মুক্ত শ্যাওলাচরের দেয়ালে যে মিথ্যে ইতিহাস সঞ্চালিত মগজ খুলে লবণ ছোকার মতন টেস্ট নিয়ে ফেলে আসা লোকারণ্য মেট্রোতে বাসে সিটে ফুটেপাতে ভীড়ে আড্ডায় মল পানশালায়, উল্লাসে নুইয়ে পরা কেদারার টেবিলে।

এগুলা যা দেখছো পড়ছো অথবা অযথা বলে হাসছো, কিংবা ভূজগুড়ি ফালতু লাগলেও শুনতে– অবশ্যই আমি নেহাৎ কেউনা বিধায়–


১১।

কেন এই রুক্ষতা?

নার্সিসাস মগজে নিয়ে ছাড়পোকা ভরা ছাড়পত্র–
হেনরি হাইকু কিংবা দান্তে, ভিঞ্চি দ্যা কোড শিথানে চোখমেলে আমি শুয়ে পরি পরিবর্তনের বিছানায়।
প্রিয়তমার অবজ্ঞা অবহেলাও আমায় আড়ষ্ট ক’রে রাখে, যেমন–
শ্রমিকের দৈন্যতা; ক্ষুধার্ত মগজ; শহুরে জীর্ণতা; ভিখিরির ভিক্ষা।

আমি ছেড়ে যেতে পারি, আমি ছেড়ে যেতে পারি– তুমি কান পেতে শুনো প্রিয়তমা–

এই পবিত্র শিশুভোর, শহুরে বৃষ্টি ভেজা কাকও– চেনা রাস্তা, রেলিঙে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশিরজল, সময়ের গতিতে বাইপাস, অথবা আরও কিছু–

পবিত্র ভোরের নেশাটা কাটলেই আমি ছুটে যাবো হয়তো ভ্রাম্যমান কবরে; কিংবা সিএমসি’র চিরন্তন মর্গে!


১২।

তোমাকে ভাবতে গিয়ে লিখেফেলি যত অকথা-একথা অযথা,
তোমাকে দেখতে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলি শঙ্খ-শামুকের কোমলতা।
তোমাকে চাইতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি আমার সব চাহিদার মতন সময়গুলো–
তোমাকে বাসতে গিয়ে বেসে ফেলি খুন-রক্ত-বুলেট ও কবিতাগুলো।।

‘প্রিয়তমা তোমাকে লিখা ছাঁইপাশ’


১৩।

মেট্রোগ্রামের এই আভিজাত্যারণ্য বিপণী বিতানে রোজ শহুরে মন্দিরারা আসে–

হিলজুতো পরে আসে– আয়নায় লাল টিপ পরে আসে– হাতের কব্জিতে চাঁচের চুড়ি পরে আসে– শাদা ওড়নায় বুক ঢেকে আসে– সোনালী খোলাচুল বাতাসে উড়ায়ে আসে– শাড়ি-কাপড়-ঘড়ির দোকানে আসে– কফি-চা-ফুচকার আড্ডায় আসে– হাটতে ঘুরতে প্রেমাদকের তৃষ্ণায় আসে–

কই, তোমারে তো দেখি না!

তুমি আসো না?


১৪।

তোমারে ক্রাইসিসে পায় না? আমারে পায়–

সকাল বিকাল পায়, অন্তরে বন্দরে পায়, শুইতে ঘুমাইতে খাইতে পায়
অকারণে ভাবনে জাগরণে পায়– দুঃখে সুখে সকলে পায়
নিশীথে নেশাতে শিথানে, ভুলে ভালে কর্ম বিরতিতে, রোজ চায়ের কাপে আগুনে পুড়তে পুড়তে, ক্ষুধার টাইমে টাকার কস্টিং-এ
আমারে পায়, তোমারে পায় না?

কলতলার স্নান ঘরে, টঙের দোকানে ধোয়ার মিছিলে, নাগরিক মেট্রোবাসে ঝুলতে ঝুলতে, ট্রাফিকের গুতা খাইতে খাইতে যন্ত্র জ্যামে কোলাহলে, শহুরে জীবনযাপনে–

কবিতা অ-কবিতা বইয়ের ভাঁজে, একরোখা পাগলের নিজস্ব ক্যানভাসে, অতীতের ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পাখির পালকে, কবি জীবনানন্দে–

আমারে পায়, তোমারে পায় না?

ফুটপাতের উচ্ছিষ্ট জীবনে, ক্ষুধা আর অনাহারের কষ্টের সংমিশ্রণে, গাঞ্জা সিগারেট হিরোইনের মাদকে, তোমার অবহেলিত উপেক্ষিত প্রেমের বাহুডোরে, কবীরের গিটারে অঞ্জনগীত শুনতে শুনতে, সুরে শব্দে পিয়ানো বাঁশিতে, কবিতা শব্দ প্রেমের কাছে–

আমারে পায়, তোমারে পায় না?

তোমারে ক্রাইসিসে পায় না? আমারে পায়।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu