লাবণ্য কান্তার তিনটি কবিতা
স্মৃতি-অঞ্জলি
গেলো জুনে বাবা চিরটাকালের জন্য চলে গেলেন
যেতে হবেই; দুদিন আগে দুদিন পরে সবাইকে।
বাবা চলে যাবার পর দিনগুলো কেমন যেন
শূন্য লাগে মনে প্রচণ্ডরকম বেদনার মস্ত স্তূপ।
দিন যায় রাত আসে মাস ফুরায় বছর এলো
বাবার চলে যাওয়ার একটি বছর ফুরালো।
বাবার মুখ বাবার প্রতিচ্ছবি বাবার ছায়া
প্রতিটি মুহূর্ত দীর্ঘ ছায়ার মতো ঘিরে রাখে।
বাবা শেষবার যখন এসেছিলেন আমার কাছে
আমার সেলফ থেকে একটি বই নিয়ে গেলেন।
বাবা যে কতটা পাঠক ছিলেন সে কথা বলবো
কী আর? এখনো তার ড্রয়ারভর্তি বই রয়ে গেছে।
বাবা এমনি ছিলেন
বাবা শেষ এলেন যখন আমার কাছে
এক বিকেলে বললাম–
“চলো তোমাকে রামকৃষ্ণ মঠ ঘুরিয়ে আনি।”
বাবা বলামাত্রই তৈরি হলেন।
দুজনে মিলে গেলাম
প্রথমে বাবা ঘুরলেন ফুলের বাগানে,
তারপর লাইব্রেরি
এই বই সেই বই কত বই দেখলেন।
মন্দির খোলার পর মন্দিরে প্রবেশ করে
রামকৃষ্ণ-সারদা দেবী আর বিবেকানন্দের
দিকে কত সময় চেয়ে রইলেন।
মন্দিরের নৈঃশব্দতা বাবাকে এত
আচ্ছন্ন করলো যে–
সেই যে বসে পড়লেন উঠতে চাইছিলেন না।
মন্দিরের স্থাপনার দিকে তাকিয়ে
গল্প জুড়ে দিলেন মহাভারতের কাহিনি প্রসঙ্গে
ইন্দ্রপ্রস্থের কথা এবং দ্রৌপদীর দ্বারা
দুর্যোধনের উপহাসের কথা।
কিন্তু মন্দিরে কথা বলা নিষেধ বিধায়
বাবা স্বল্প কথায় গল্প সারলেন; তা না হলে
খাণ্ডবদাহন থেকে ইন্দ্রপ্রস্থের যাগ-যজ্ঞ এবং
শিশুপালে নিয়ে হয়তো ঠেকাতেন তাঁর গল্প।
বাবার বলে যাওয়া কথাগুলো
বাবা সাহিত্যিক ছিলেন না, কিন্তু একজন
মুগ্ধ পাঠক ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ-কাজী নজরুল সেভাবে পাঠ করেননি
কিন্তু নজরুল সঙ্গীত গাইতেন।
বাবা হারমোনিয়াম-তবলা- শ্রীখোল বাজাতেন
রামায়ণ গান গাইতে পারতেন।
বাবা সাহিত্যিক ছিলেন না; বুদ্ধদেব বসুকে চিনতেন না হয়তো;
কিন্তু কী আশ্চর্যরকমভাবে
বুদ্ধদেবের “চিল্কায় সকাল” কবিতার মতো করে
উড়িষ্যার চিল্কা হ্রদের কথা বলেছিলেন আমাকে।
চিল্কার অপরূপ রূপের কথা বলছিলেন যখন–
আমি অবাক হয়েছি তাঁর বর্ণিত কথা শুনে।
ভেবেছিলাম বাবা তো কবি নন,
কিন্তু কথাগুলো কবিতার মতো বলছেন যে!
পুরীতে গিয়েছিলেন তিনি–
“বিন্দু সরোবরের” কথা বলেছিলেন আমাকে।
বলেছিলেন উড়িষ্যার সমুদ্র সৈকতের কথা; আর
চিল্কার সমুদ্রের গভীরে মুক্তার কথা।
বলেছিলেন কোনার্কের কথা,
দিন যতই যায় বাবার বলে যাওয়া সেসব কথাগুলো
বাজে, শুধু বাজে …
মনে হয় বাবা এখনো সেসব কথা অনর্গল বলছেন।