শিমুল মাহমুদ একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং গবেষক। আশির দশক থেকে তিনি লেখালিখি করে আসছেন। “সুইসাইড নোট” তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস। উপন্যাসটি রচিত হয়েছে একজন নারীর ডায়েরি অবলম্বন করে। উপন্যাসটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর গদ্যে, এর গদ্যের স্বাদ ভিন্ন। গদ্যে এক ধরনের সুর ঝরে– যা মধুর; মোটেও ঝনঝনানি নয়। সুইসাইড নোটের একটি বিশেষ অংশ দর্পণে উপস্থাপন করা হলো। এই অংশে উপন্যাসে উল্লেখিত নারীর ডায়েরি ও নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে। এছাড়া আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি গদ্যের মাধ্যমে সুকৌশলে তিনি উপস্থাপন করেছেন। শব্দ ব্যবহারে আশ্রয় নিয়েছেন সমাজে প্রচলিত কিন্তু সাহিত্যে অব্যবহৃত অনেক শব্দ। সমাজ দর্শনে লেখকের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সুইসাইড নোটে ফুটে উঠেছে। এছাড়া সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, সুইসাইড নোটের গদ্য পরীক্ষামূলক কোনো গদ্য নয়, সুগঠিত গদ্য। আগ্রহী পাঠকেরা বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন রকমারি থেকে।
রমণীজীবন (?) সে এক বিশাল যাত্রাপালা!
মহিলা হতে পারতেন একজন নামিদামি লেখক; এবং আমরা এক আধটু তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত; অন্তত আমাদের মধ্যে যারা পেশাগত মর্যাদা ও সামাজিকতার প্রশ্নে, সমাজের অগ্রসরমান সুশীল সমাজে নিজেদের নাম সংযুক্ত করার আকাঙ্ক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ের শিল্প-সাহিত্যের খোঁজখবর রাখতে বাধ্য; সেইসব মানুষজনের মত আমিও মহিলার সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ-সম্পর্ক তৈরি করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তিনি এক সময় সমকাল আশ্রয়ী একজন জীবনঘনিষ্ঠ লেখক হয়ে উঠবেন; তাঁকে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম তিনি যেন তাঁর অন্তত ব্যক্তিগত জীবনকে প্রতিনিয়ত গদ্যভাষ্যে ধারণ করার অভ্যাস রপ্ত করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে ডায়রি লেখা শুরু করেছিলেন; যদিও সেই লেখার ভেতর ছিল না কোনও তারিখ অথবা ঘটনাপ্রবাহের সুনিয়ন্ত্রিত ধারাক্রম। এই নিয়ন্ত্রণহীন নীল ও খয়েরি রঙের নোটবুকগুলোর কয়েকটি এক সময় আমার হাতে আসে। কীভাবে নোটবুকগুলো আমার অধিকারে এলো; সে ঘটনার অবিকৃত রূপ উপস্থাপনের মত যথেষ্ট সৎসাহস আমার নেই। সাহস দেখাতে হলে পক্ষান্তরে নিজেকে নিয়েও খানিকটা লিখতে হবে। আমি স্পষ্টতই বলছি মহিলার সঙ্গে আমার জীবনের যতটুকু অংশই কাটুক না কেন তা আমি কখনওই প্রকাশ করবো না; তাঁর কাছে আমি কমিটেড।
যাই হোক, তাঁর নোটবুকের ভেতর তাঁর জীবন-অনুভূতি পাঠ করতে গিয়ে আমি আমার পুরুষজীবনের তাড়না থেকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি তাঁকে আশ্রয় করে অনেক কিছুই ভাবা যেতে পারে; যদিও সেই ভাবনাসমূহ হয়ে উঠতে পারে ট্র্যাডিশনাল; কেননা আমাদের মত মানুষদের অভিজ্ঞতা মোটা দাগে অনেকটা একই রকম আর চূড়ান্ত অর্থে বৈচিত্র্যহীন। তারপরও আমরা মানুষের বাচ্চারা নিজেদের পশ্চাৎদেশে বিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও অন্যের বিষ্ঠার গন্ধ খুঁচিয়ে তুলতে ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট তাড়না বোধ করি এবং অনিবার্যত প্রবেশ করি পুরীষমহলে। ফলে গোপন বলে সামাজিক জীবনে কিছু থাকে না। প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক জীবন মানে, স্টেডিয়ামের ডান পাশে সারি সারি পাবলিক টয়লেট। মূত্র ত্যাগ ৫টাকা, মল ত্যাগ ১০টাকা।
বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য নোটবুকে উপস্থাপিত ভদ্রমহিলার উপলব্ধিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে অর্থাৎ দলিত বিন্দুতে অবস্থানরত রমণীজীবনের সংকট, প্রতিবাদ ও দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উন্নয়নশীল সমাজ-কাঠামোর অনুভবগত (চেতনাগত?) যোগাযোগরেখা অনুসন্ধান। নারীজীবনের অন্তর্নিহিত সংকটসমূহ যা প্রাত্যহিকতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের ওপর বিবিধ সংবেদনশীলতার কারণে সংগঠিত হয়; নারীজীবনের সেই সংকটলব্ধ প্রাত্যহিক অনুভবের সঙ্গে সুধীজনের মানস যোগাযোগ তৈরির লক্ষ্যে আমি ভদ্রমহিলার ডায়রি উপস্থাপন করার যৌক্তিকতা নিয়ে ভেবেছি এবং সংগত কারণেই ভদ্রমহিলার নাম-পরিচয় গোপন রেখে একজন সমন্বয়কারী অনুসন্ধানকর্মী হিসেবে স্থান-কাল-পাত্রের নাম বদলিয়ে একখানা খণ্ডিত যাপনচিত্র তৈরি করতে চেষ্টা করেছি।
উল্লেখ্য যে, নীল রঙের নোটবুকের মলাটের ভাঁজে আমি ভাঁজ করা দুটি জীবনবৃত্তান্ত পেয়েছিলাম; একটি চাকুরিপ্রার্থী হিসেবে মহিলার নিজের লেখা আরেকটি সম্ভবত মহিলার পিতা প্রণয়ন করেছিলেন একাধিকবার একাধিক পাত্রপক্ষের কাছে উপস্থাপনের উদ্দেশে। এক্ষেত্রে আমি ‘সম্ভবত’ শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নই; কেননা প্রাপ্ত ডায়রি পাঠ ও বিশ্লেষণে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছি, ভদ্রমহিলা আত্মমর্যাদার কারণে পাত্রপক্ষের কাছে জীবনবৃত্তান্ত উপস্থাপনে রাজি ছিলেন না; ফলে তাঁর অজ্ঞাতেই তাঁর পিতা বায়োডাটা প্রস্তুত করেছিলেন; যার একটি কপি শেষ পর্যন্ত মহিলার হস্তগত হয়েছিল; এবং এ বিষয়ে তিনি নীল নোটবুকে তাঁর অনুভূতি লিখেছিলেন, ‘আমার যোগ্যতার প্রশ্নে আমার টাউট বাবা বায়োডাটাটিকে অতিরঞ্জিত করেছেন। অশ্লীল! বিয়ে যদি আমাকে করতেই হয় তাহলে আমার কোনও বায়োডাটা পাত্রপক্ষকে দেওয়া যাবে না বরং পাত্রপক্ষের বায়োডাটাই আমি বিবেচনা করে দেখব; একটা অসভ্য জীবন টেনে নিচ্ছি প্রতিদিন! নারীদেহ (?) একটা চূড়ান্ত সার্কাস!’
আমি জীবনবৃত্তান্তের তথ্যসমূহ ঠিক রেখে শুধু ব্যক্তিনাম ইচ্ছেমাফিক লিখেছি। এক্ষেত্রে নোটবুকে লিখিত যাবতীয় বিষয় উপস্থাপন করা যুক্তিসংগত মনে করিনি এ কারণে যে, নোটবুকগুলো ছিল দৈনিকতায় এলোমেলো; যেমন তিনি দিনে কতবার গোসল করেছেন, কী সাবান ব্যবহার করেছেন বা দিনে কত কাপ চা পান করেছেন অথবা এমন বিষয়ও পাঠ করেছি আমি, যেখানে লেখা ছিল সকালের ডিম ভাজিতে তিনি কয়টি পেঁয়াজ ব্যবহার করেছেন; ব্যবহারকৃত ডিমের খোসা তিনি কোথায় ফেলেছিলেন; তাঁর ধারণায় তাঁর নিজের মাসিকচক্রের তারিখ কীভাবে কেন পিছিয়ে গিয়েছে? এই ধরনের বিবিধ বিষয়াদিকে আমি সরাসরি উপস্থাপন না-করে রমিতাজীবন নির্মাণের কাঁচামশলা হিসেবে সযত্নে নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছি।
শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে, মহিলার জীবনে সংঘটিত ঘটনা ও সময়ের প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে বিবেক-তাড়িত, বিবেচনাগত ও বিশ্লেষণধর্মী জীবনকাহিনি প্রণয়নের চেষ্টা করেছি; যা প্রাসঙ্গিক টিকা-টিপ্পনি ও মতামতসহ উপস্থাপিত হয়েছে। এক্ষেত্রে যদিও আমরা জানি মানবজীবনের সার্বিকতার প্রশ্ন একটি অসম্ভব ধারণা; সার্বিক অর্থে কারও জীবনকাহিনি প্রণয়ন অসম্ভব। জীবন মূলত চলমান অথচ খণ্ডিত উপলব্ধির সংকটবিন্দু; যাকে কোনও অবস্থাতেই লিখিত রূপ দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা যা লিখে থাকি বা লেখার চেষ্টা করি তা আসলে বিভিন্ন অকেশানে বা পূজা পার্বণে মাটি দিয়ে তৈরি নিষ্প্রাণ খণ্ডিত ও কৃত্রিম মূর্তি মাত্র; যার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে প্রাত্যহিকতার পাশাপাশি রূপকথা, স্বপ্ন এবং কখনও-বা মিথ। এই অপ্রিয় সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে আমাদের পাঠ করতে হচ্ছে, রমণীজীবন (?) সে এক বিশাল যাত্রাপালা!
বক্ষবন্ধনীতে বেঁধেছি জীবন
সত্যিকার অর্থেই আমার তেমন কেউ মেয়ে বন্ধু ছিল না। বাড়িতে আমরা তিন বোন। মা-কে বয়েস হবার পর থেকে লেংড়াদের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছি। অর্থাৎ জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাত যে কোনও পাপেই হোক না কেন তাকে প্যারালাইসিস দেহ বহন করতে হচ্ছে; প্যারালাইসিস বোধ বহন করতে হচ্ছে; এবং আমরা প্যারালাইসিস পরিবেশে ক্রমাগত ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে শেষাবধি একখানা প্যারালাইসিস পরিবার।
রাতে অথবা দিনে, লোকাল ট্রেনে অথবা মেইল ট্রেনে, হাড়কিপটে বজ্জাত আর ছেবলা ধারী পুরুষের মত অসভ্য রকম ফন্দি-ফিকিরে ট্রেনের অভাবি পেসেঞ্জারদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা হাতিয়ে আমাদের যিনি বাবা তিনি রেল কলোনির নোংরা গলিতে তিন চারদিন পরপর লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসেন। তাকে দেখে আমার ভেতর কোনওকালে কোনও মহব্বত জেগে ওঠেনি; বরং এক ধরনের বিতৃষ্ণা জেগে উঠেছিল সেই বালিকা বয়েস থেকে। আর যখন আমাদের বাবার খাটের ছেড়া তোশকের নিচ থেকে নিউজপ্রিন্টে ছাপা চটি পত্রিকায় নেংটা মেয়েদের সাদাকালো ভারী পাছার ছবি দেখে বুঝতে পারলাম পুরুষের লালসার গায়েবি রূপ তখন আমার ভেতর একটা শকুনি কেবলই উঁকি দিতে থাকলে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় নারী-পুরুষের সম্পর্কটা আসলে কেমন; আর কেনই-বা রেল কলোনির পেছনের বস্তিতে ডজন ডজন মাতারিদের হইহুল্লোড়ের ভেতর পুরুষ মানুষের এত যাওয়া-আসা।
আমি প্রথম যেদিন আমার বাবাকে পাড়াটার দিকে রাতের রকেট ট্রেনের শব্দের আড়ালে হারিয়ে যেতে দেখেছি সেদিন ঠিক বুঝতে পারিনি হারিয়ে যাওয়ার আসল মোজেজা। যেদিন রাতে, আমাদের তিন বোনের জন্য নির্ধারিত পাঁচ হাত বাই সাত হাত খুপরির ভেতর, ঘামে জবজবে অবস্থায় অন্ধকার তেলচিটে পুরোনো বদগন্ধে মাখামাখি বিছানার ওপর ঘুম ভেঙে গেল, সেদিন বাবা-মার ঝগড়া শুনে বুঝতে পারলাম মোজেজার প্রকৃত রহস্য। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্যাকিং বাক্সের তক্তা জোড়া দিয়ে বারান্দায় যে আড়াল তৈরি করা হয়েছে সেই আড়ালের ভেতর পোয়াতি বেড়ালের মত আমাদের মা মাগির মিউ মিউ অথবা অনেকটা মাদি কুকুরের মত কুঁইকুঁই চিৎকার আমাদের তাদের অসভ্য বাক্যবিলাসের প্রতি যত্নশীল করে তুললো।
বাবা-মার মুখ খারাপের সঙ্গে পরিচয় অবশ্য এই প্রথম নয়; তারপরও আমার কাছে এই অর্থে প্রথম যখন তাদের কথোপকথনে আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম তাদের ঝগড়ার মূল বিষয় আমাদের বাবার মাগিপাড়ায় যাতায়াত। এই মাগিপাড়ার বিষয়টি নিয়েই আমাদের অসভ্য মায়ের হাউকাউ। অবশ্য এই হাউকাউয়ের ভেতর একটা মোটা অংশ জুড়ে ছিল, মেয়েরা দিন দিন ধামড়ি হচ্ছে আর বুড়োধাড়ি এখনও তার অভ্যেস পালটাতে পারেনি; আল্লাহ তার কপালে; ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় ছিল আমাদের তিন বোনকে নিয়ে আমাদের মায়ের দুশ্চিন্তা। অর্থাৎ মেয়েগুলোও বাপের মত শেষ পর্যন্ত মাগিপাড়ায় গিয়ে ঠাঁই নেবে।
এ অবস্থায় আমরা তিন বোন পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে যখন নারী-পুরুষের কাপড়ের নিচে লুকিয়ে রাখা নোংরামিগুলো খোলসা করে নিচ্ছিলাম তখন আমাদের ভেতর ভয় অথবা ঘৃণা নামক অনুভূতি জেগে ওঠার পরিবর্তে এক ধরনের অসভ্য হাসি কাজ করতে শুরু করল। হয়ত আসলেই আমরা অসভ্য; মাগিপাড়ার মাগিদের সঙ্গে হয়ত আমাদের তেমন কোনও গড়মিল নেই। যদিও আমরা তখন প্রতিনিয়ত সভ্য হয়ে ওঠার ইচ্ছায় স্কুল এবং কলেজ পর্যন্ত যাতায়াত শুরু করেছি। এবং মসজিদের আজান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দ্রুত সভ্য হয়ে ওঠা উচিত; অন্তত ইনটার-সিটি ট্রেনে ভ্রমণরত অহংকারী মহিলাদের মত; অথবা রেল ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীর মত; যিনি গত বছর হজ থেকে ফেরার পর একবারও বোরখা ছাড়া বাইরে বের হননি। এবং যখন আমার বড়ো বোন আয়েশা বোরখা পরিধানের ঘোষণা দিল তখন আমাদের মা মিনমিনে গলায় যেসব কথা বলল সেগুলো আমাদের জন্য সভ্য হয়ে ওঠার পক্ষে মোটেই কার্যকর ছিল না। বরং মা মাগি ভেতরে ভেতরে অবশ্যই চিন্তা করত ছুঁড়িগুলো যার যেমন ইচ্ছে তেমন এক একজন নাঙ জোগাড় করে দূরে কোথাও গিয়ে সংসার করছে না কেন; কী ঢঙের লেখাপড়া; এক একজন যেন রেলের বড়োবাবু হবেন। এতসব বিষয় আমাকে বুঝতে হয়েছিল সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়া অবস্থায়; যখন মা-র মুখখানা আরও জ্বলজ্বলে ছিল; তখনও মা ল্যাংড়া হয় নাই।
একদিন মা, শায়লা খালা আর কুটনি খালা; কুটনি খালার নাম তাহেরা বানু; চেহারা অনেকটা ছেলেদের মত, কিন্তু বেকায়দা রকমের ফরসা; আমাদের মা-র নাকি এই কুটনি খালার মত সেই পিচ্চি বয়সেই ডজন খানেক নাঙ ছিল; আমাদের বাপও নাকি সেই নাঙদের একজন। যাই হোক একদিন রাতে মা, শায়লা খালা আর কুটনি খালা, কুটনি খালার এখনও বিয়ে হয় নাই; শায়লা খালার বিয়ের পর আড়াই বছরের মাথায় একটা মেয়ে বাচ্চা কোলে আমার নানার বাড়িতে এসে ঠেসে বসার পর মায়ের সঙ্গে বনিবনা নাই; অবশ্য মা মাগি সেই পিচ্চিকাল থেকেই হিংসুটে মেজাজের; তার বদস্বভাবের বেশির ভাগই পেয়েছে বড়ো আপা আয়েশা।
একদিন মা, শায়লা খালা আর কুটনি খালা, তখনও শায়লা খালার বিয়ে হয় নাই, কুটনি খালাও তখন নাঙের হাত ধরে পালিয়ে যায় নাই, মা তিন বোনের মধ্যে ছোটো; ছোটো হলে কী হবে হাতে পায়ে ধাঙড়, পাকা ঝানু, হিংসাতেও পাকা, দেমাগেও পাকা; তা না হলে তিন বোনের মধ্যে ছোটো হয়েও মায়ের বিয়ে হয়ে গেল সবার আগে; এক্কেবারে চাকরিওয়ালা, উঁচা-লম্বা-কালো দামড়ার সঙ্গে।
একদিন রাতে মা-রা তিন বোন যখন কালো দামড়ার সঙ্গে সেকেন্ড শো ছবি দেখে ফিরছিল তখনকার ঘটনা; তারপর সেই ঘটনা লম্বা হতে হতে এতদূর। সম্পর্কটা নাকি ছিল শায়লা খালার সঙ্গে; কুটনি খালা সেই কথা লাগিয়েছিল আমার নানির কাছে; আমার নানি ফুলবানু ছিল বলা চলে ভাতাইরে মাগি; আমার নানি ফুলবানু সেই ঘটনা গোপন রাখতে পারে নাই; যার জন্য এত ঘটনা; নানি ছিল বিহারি ঘরের মেয়ে; রেল কলোনির ভেতর বিহারি পাড়ার সঙ্গে আমাদের তখনও বাতচিত বেশ ভালো।
নজরুল টিটির তখনও চাকরি হয়নি। নজরুল টিটির চাকরি না-হলেও টিটি-র কাজ করে; ওর বাপের পরিবর্তে। ওর বাপের বাম পা রেলে কাটা পড়লে রেলের বাবুরা মুখে মুখে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এখনও নজরুল টিটি ওর বাপের বদলি চাকরি করে কি না তা পরিষ্কার না। এই কথায় নজরুল টিটি রহস্য করে; যদিও নজরুল টিটির বাপ মারা গেছে তাও অনেকদিন হল। এখন নজরুল টিটি-র আমাকে নিয়ে তিন মেয়ে। নজরুল টিটির বউ অর্থাৎ আমাদের বদস্বভাবের মা এখন ল্যাংড়া। কুটনি খালা এখনও প্রতি সপ্তাতেই আসে আমাদের এখানে; মায়ের সঙ্গে নিয়মিত ঝগড়া করে; বাপের সঙ্গে ইয়ার্কি করে, দুচার টাকা বাগিয়ে নিয়ে চলে যায়; আবার আসে। আমার দুই খালাকে আমি প্রাণভরে গালিগালাজ করি। আমার মাকে আমি মনে মনে অভিশাপ দিই; প্রকাশ্যে গালি দিই; বাপকে সিফিলিস রোগী হিসেবে কল্পনা করি। আমি আমার বাপকে প্রকাশ্যে রেল স্টেশনে বসে থাকা মগা পাগলার মত কুষ্ঠ রোগী হিসেবে দেখতে চাই; এবং নিজেকে দেখতে চাই সিনেমার নায়িকা হিসেবে। ববিতা আমার প্রিয় নায়িকা। অবশ্য আমি যখন স্কুলে তখন নায়িকা হিসেবে ববিতা এক নম্বরের হিট ছিল। আর তখন আমাদের পাড়ায় ‘বিবি কুলসুম’ যাত্রাপালা এবং ওপেরা সার্কাস বেশ শোরগোল তুললে আমি যাত্রার নায়িকা হিসেবে নিজের ভবিষ্যৎ স্থির করে নিই; কিন্তু আমার এই কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আর যখন অপেরা সার্কাসের উঁচুতে একেবারে শূন্যে ঝুলতে থাকা আট বছরের একটা ছুঁড়িকে ডিগবাজি খেতে দেখলাম তখন আমি নিজেকে ক্রমাগত ডিগবাজি খাওয়াতে খাওয়াতে সার্কাসের কুইন হিসেবে ভাবতে শিখলাম এবং এত বছর পর আজ আমি বুঝতে পারছি নারীদেহ (?) সে এক বিশাল সার্কাস!
আমাদের বাবা, এমনকী আমাদের ল্যাংড়া মা পর্যন্ত তাদের পয়দাকৃত তিন মেয়ের পোশাক আশাক নিয়ে মাথা ঘামাত না। আমরা তিনবোন আমাদের অন্তর্বাস শেয়ার করতাম। যেগুলো দিয়ে টিকটিকির শরীরে ফুটে ওঠা ঘামের গন্ধের মত এক ধরনের মরা মানুষের গন্ধ প্রকাশ পেতো; যেগুলোর স্ট্রিপগুলো প্রায়ই ছেড়া থাকত; যেগুলো আমাদের বুকের শুকনো চর্বির নিচে এক ধরনের চুলকানির সৃষ্টি করত; আর আমাদের বিভিন্ন মাপের বুকের নরম অংশের ভেতর যখন এগুলো এক ধরনের জৈবিক অনুভূতির জাগরণ ঘটাতো তখন আমরা টিভি পর্দায় দেখা সাদাকালো ছায়াছবির কোনও সুখী অথবা দুখি নায়িকার উন্নত বুকের মত আমাদের নিজেদের বুকগুলো কল্পনায় এনে যে যার ইচ্ছেমতো কল্পিত অথবা বাস্তবে রেলস্টেশনে দেখা অথবা ট্রেনের কামরায় দেখা কোনও ভদ্রলোকের পুত্রের বুকে নিজেদের ছেড়ে দিতাম। অন্তত আমার ভেতর এমনটি ঘটতো; এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত এবং আমার বোনদের ভেতরেও যে এমনটি ঘটেছিল এ বিষয়েও আমি নিশ্চিত। কেননা তারা আমার অনেক আগেই পুরুষ শরীরের ওম লাভ করেছিল; আমাদের রেলবস্তির বিশাল নোংরা জীবনের অনেক বিষয়ের মত এ বিষয়েও আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
আমরা দীর্ঘদিন ধরে নির্দিষ্ট একজন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আমাদের প্রসাধন সামগ্রী, আমাদের অন্তর্বাসসমূহ কিনতাম। সাধারণত সেগুলোর মূল্য তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করা হত না। আমাদের কাছে টাকা থাকলেও আমরা তা করতাম না; যেন-বা তাৎক্ষণিকভাবে মূল্য পরিশোধ করার ভেতর রয়েছে হেরে যাওয়ার মত এক ধরনের গ্লানি। অথবা ফেরিওয়ালা অপেক্ষা আমরা অধিক গুরুত্বপূর্ণ অথবা অধিক পয়সাওয়ালা এমন একটি চেতনা প্রমাণ করতেই আমাদের এমনটি করতে হত। ফেরিওয়ালা দিনের পর দিন পয়সার জন্য ঘুরে যাবে; আকুতি মিনতি জানাবে; আর এই ফাঁকে আমাদের পছন্দসই আরও কিছু জিনিস আমাদের গছিয়ে দিয়ে যাবে; আর এভাবে দিনের পর দিন মেয়েলি শ্লীল-অশ্লীল দ্রব্যাদি বিক্রয়ের সূত্র ধরে কুড়িগ্রামের ফেরিওয়ালা কবিরের সঙ্গে আয়েশা আপার একটা হেংলামির সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাওয়া দোষের কিছু নয়; বরং আমাদের রেলবস্তিতে এটাই ছিল স্বাভাবিক।
আর এতে আমরা কম বেশি সবাই কাঙ্ক্ষিত দ্রব্য ক্রয়ে কিছুটা ফ্যাসালিটি পেতাম। বেশি পেতাম আমি; কেননা তখন অলরেডি ফেরিওয়ালা বড়ো আপাকে বাগে আনার পর আমার মাত্র-ওঠা বুক জোড়ার ওপর নজর। অবশ্য এ বিষয়ে রেলবস্তির মত পরিবেশে আমার সতর্ক হবার কথা নয়; অন্তত আমি আমাদের পাড়ার কোনও মেয়ে অথবা আধা বয়েসি অথবা বয়েসি মাগিকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে দেখিনি। অথচ কী এক অজ্ঞাত কারণে আমার ভেতর সতর্ক হবার মত চেতনা কাজ করতে শুরু করেছে; যার জন্য আমার কাছে ফেরিওয়ালা কবির মিয়া আর বড়ো আপা ধরা পড়ে গিয়েছিল। ফলে প্রসাধন সামগ্রীর বিশেষ কিছু অংশ এবং আমাদের উভয়ের দৃষ্টিতে মূল্যবান একটা বডিস ঘুস হিসেবে বড়ো আপা আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল; যদিও তখন পর্যন্ত আমার অন্তর্বাস পরিধানের তেমন কোনও প্রয়োজন দেখা দেয়নি; অথচ এই ঘুস গ্রহণই আমাকে প্রথমবারের মত অশ্লীল করে তুলতে সাহায্য করল।
আমি মূল্যবান কাঁচুলি বুকে সেট করে তা আয়নায় বার বার দেখার উত্তেজনায় আটকে গেলাম এবং স্বপ্নে মিলিত হলাম ফেরিওয়ালা কবিরের সঙ্গে; যে স্বপ্নটি ছিল বিশ্রী রকমের এলোমেলো ভাঙাচোরা এবং আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে স্বপ্নের শেষ সিকোয়েন্সটি ছিল একটা কিম্ভূত আকারের অচেনা জাহাজ আকৃতির লাল রেলগাড়ির এলোমেলোভাবে ভেঙে যাওয়া; অনেকটা বিশাল চাকাওয়ালা হলুদ ফেরি আর ট্রেনের মাঝামাঝি এমন কিছু একটা যানবাহনের শারীরিক ও যান্ত্রিক অ্যাক্সিডেন্ট; যে অ্যাক্সিডেন্টটি স্বপ্নের ভেতর আমাকে আমার শারীরিক ভাঙনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম।
স্বপ্নে ট্রেন জাতীয় কোনও যান্ত্রিক দানবের অ্যাক্সিডেন্ট অপেক্ষা অসভ্য রকম তাৎপর্যে ঠাসা ছিল ফেরিওয়ালা কবিরের দেহের স্পর্শ। আমি নিশ্চিত, ফেরিওয়ালা কবিরের দেহের স্পর্শের কারণেই আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। স্পষ্টতই ওকে আমি ঘৃণা করি; আমি কখনোই এমন নোংরা অসভ্য গরিবের বাচ্চাদের থেকে নিজের জন্য প্রেমিক নির্বাচনে আগ্রহী নই। সুতরাং স্বপ্নে প্রথমবারের মত কোনও পুরুষের সঙ্গে মিলিত হবার অভিজ্ঞতাটি ছিল আমার জন্য জঘন্য রকমের শাস্তিতুল্য একটি দুর্ঘটনা; যেখানে আমার আসলে কিছুই করার ছিল না। অথচ আমার মত একজন নির্বোধ কিশোরীর পক্ষে কোনওক্রমেই জানা সম্ভব ছিল না, এই যান্ত্রিক দুর্ঘটনার সঙ্গে আমার মত কিশোরীদেহের শাস্তিগ্রহণ প্রক্রিয়ার রহস্য; বিষয়টি নিহায়েত স্বপ্নমাত্র নয় বরং স্বপ্নটি ছিল ভয়ানক রকম এক নোংরা ভবিষ্যতের ইশারা; যে ভয়ানক ভবিষ্যৎ ভয়ানক ইশারায় প্রতিনিয়ত শারীরবৃত্তীয় আবেশে ক্রমাগত আমাকে কাছে টানছে।
অপ্রাপ্তিজনিত হঠকারিতায় আমি আমার গোটা জীবনকেই ঘৃণা করি এবং যত্নের সঙ্গে ঘৃণা করি; প্রযত্নের সঙ্গে ঘৃণা করি; সতর্কতার সঙ্গে ঘৃণা করি। অথচ আমি আরও দৌড়াতে চাই; আরও, আরও; এবং অবশেষে প্রথম স্থান অধিকার করতে চাই; যেভাবে স্কুলে অথবা কলেজে প্রতি বছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অথবা জেলা পর্যায়ের এথলেটে অথবা বিভাগীয় পর্যায়ে একশ মিটার অথবা পাঁচশ মিটারে বরাবরই প্রথম হয়েছি। প্রতিজন দামি, অধিক দামি অথবা কমদামি দর্শক অথবা জেলাপ্রশাসক অথবা সাংবাদিকদের চোখের ওপর অথবা পুলিশের চোখের ওপর দৌড়ে গিয়ে আমার অধিকার আমি ছিনিয়ে নিয়েছি। যদিও অধিকাংশ পুরুষ দর্শকের চোখে আমার স্বল্প পোশাকের পাশাপাশি ফুটে উঠত আমার প্রকৃত ফিগার; যেখানে যৌনতা অপেক্ষা অধিক বিরাজ করত পুরুষালি ইমেজ। অথচ আমি নিশ্চিত, আমার এই পুরুষালি ইমেজ প্রতিটি পুরুষ দর্শকের ভেতর এমন এক ধরনের সেক্সি ইমেজের উদ্ভব ঘটাতো; যা আমার অবচেতনে আমাকে নিজের কাছে ক্রমাগত মূল্যবান পণ্যে পালটে দিতে শুরু করেছিল; আমি বুঝতে পারছিলাম সমাজে পণ্য হিসেবে আমার কিছুটা হলেও মূল্য আছে; আর পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে তোলার অনিবার্য আকাঙ্ক্ষায় আমার ভেতরে এক ধরনের ন্যাকামিপনা জেগে উঠতে থাকলে আমি স্বভাবতই সেয়ানা হয়ে উঠলাম।
শুধু খেলার মাঠে নয়; বরং সমগ্র জীবনটাকে আমি দৌড়ের মাঠে ছেড়ে দিয়ে নির্মম চাবুকে চাবকিয়ে নির্মম গরিবিপনা থেকে বের করে নিয়ে আসতে চেয়েছি। উঠতে চেয়েছি ওপরতলার মানুষের সারিতে অথবা সাদা চামড়ার নারীদের সারিতে। আমি আমার দৈবকে অভিশাপ দিই; অভিশাপ দিই এই কারণে, আমি একজন নারী এবং অবস্থানগত দিক থেকে আমি বিপজ্জনক পজিশনে অবস্থান করছি। এর ফলে আমাদের কলেজের জনপ্রিয় টিচার আমার কাছ থেকে সুযোগ আদায় করে নিয়েছে; আমাকে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছে উপরে ওঠার এবং আমাকে পুস্তকের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমাকে কবিতার জগতে অনুপ্রবেশ করিয়েছে এবং আমাকে শিখিয়েছে এই দেহের আদতে কোনও পাপ নেই; এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থাকে ভাঙতে পারলেই আমাদের মুক্তি এবং মুক্তির প্রকৃত পথ অনুসন্ধান করতে হলে নারীবাদ চেতনার সঙ্গে পরিচয় থাকা জরুরি। এবং আমি মোহগ্রস্ত হয়েছি এবং অবশ্যই আমার মত একজন নিম্নবিত্ত মেয়ের জন্য এই মোহগ্রস্ততার বিষয়টি ছিল ভীষণ রকমের অন্যায়। সুতরাং আমার টিচারের সঙ্গে সহমর্মিতা ভাগ করে নিতে গিয়ে তার কাছে নিজেকে ছোটো করেছি; একটা কালো কুকুরির মত নিজেকে ছোটো করেছি; এবং তার উপহারকৃত মার্কোজের গণিকা বিষয়ক উপন্যাসগুলোর বাংলা ভার্সন যখন পাঠ করলাম তখন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম দুনিয়ার চাকচিক্যে অন্ধ একজন উচ্চাভিলাষী রমণীর সঙ্গে আমার তেমন কোনও পার্থক্য নেই; যার অন্তরে গোপন রয়েছে পুরুষশিকারি স্বভাব। (…)