পিন্টু রহমান
১৩ অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রি: চুয়াডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জন্ম, পৈত্রিক ঘরবসতি কুষ্টিয়া জেলার বাজিতপুর গ্রামে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল-জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: পাললিক ঘ্রাণ (গল্পগ্রন্থ), পূরাণভূমি (উপন্যাস), কমরেড (উপন্যাস), পরাণ পাখি (গল্পগ্রন্থ)
পিন্টু রহমান

উপন্যাসাংশ: “পুরাণভূমি” // পিন্টু রহমান

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

পিন্টু রহমান সমকালীন একজন কথাসাহিত্যিক। নিজেকে গল্পকার হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। উপন্যাস লেখা শুরু “কমরেড” দিয়ে। তাঁর ২য় উপন্যাস “পুরাণভূমি”। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসের সময়কাল ১৯৪৭ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে আব্দুল ওহাবের জীবনসংগ্রাম উঠে এসেছে পুরাণভূমিতে। দেশভাগ কত গভীরভাবে একজন মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলতে পারে সেটাও পুরাণভূমির বিষয় হয়ে উঠেছে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের সমাজের পরিবর্তন কীভাবে ঘটেছে তাও এই উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যায়। পুরাণভূমির ১ম পর্ব দর্পণের পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। এই অংশে আব্দুল ওহাবের জন্মসময়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। উপন্যাসটি আপনারা রকমারি থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।


পর্ব: এক


চুন-সুরকির পথ ধরে নীলকুঠি অভিমুখে ইংরেজ সাহেবদের যাতায়াত; কখনো পায়ে হেঁটে, টমটমে, জিপগাড়িতে কখনো-বা ঘোড়ার পিঠে শপাং শপাং চাবুক হেনে ধুলো উড়িয়ে কুঠি অভিমুখে রওনা হয়। তাদের যাতায়াতের জন্যই মুর্শিদাবাদের নির্জন লোকালয়ে রাজকীয় সব আয়োজন। ফলে প্রজাদের মধ্যে রাজানুভূতি! ঘনীভূত সন্ধ্যার বিশুদ্ধ তন্ময়তায় অনুভূতির দুয়ার আরো বেশি প্রশস্ত! থামের অগ্রভাগে কর্মচারীরা প্রদীপ ঝুলিয়ে দেয়। সারিবদ্ধ আলোর ফোয়ারা! আলোয় আলোয় চর্তুদিক উদ্ভাসিত! ওই আলোর পানে তাকিয়ে সাধারণের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, একটু একটু করে ঘোরের আবর্তে নিমজ্জিত হয়। আনমনে পথ হাঁটে; গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঠ পেরিয়ে, নদীর ওপারে– যেখানে আকাশ ও মাটি একত্রিত হয়েছে সেখানে পৌঁছানোর আগেই আলোকরশ্মি হারিয়ে যায়; আঁধারের অস্তিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে; মনে মনে ভাবে, আলো নয় অন্ধকারই জীবনের চরম ও পরম সত্য!

তথাপি আলো বিষয়ে অন্তহীন জল্পনা-কল্পনা!

বাংলামুলুকে এ-এক আজব ব্যাপার! এমন তো নয় যে, সুইচে চাপ দিলেই আলোর সেতু দৃশ্যমান হয়ে উঠবে! মেহনত করতে হয়; বাঙালি কর্মচারীরা আলোর জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে; ঝড়-বৃষ্টিতেও ছাড় নেই, আলো না হলে সাহেবদের যে চলবে না! আমার পূর্বপুরুষরা মেম দেখেছে, সাহেব দেখেছে, আলো দেখেছে; এক টুকরো আলোর জন্য কত অসহায় প্রাণ যে অন্ধকারে নিভে গেছে!

নিয়তি।

নিয়তির নির্মম পরিহাস!

পরিহাস না হলে, ভিনদেশি রাজার অধীনে প্রজা হতে হবে কেনো! কেনোই-বা পিতল-নির্মিত প্রদীপে নিয়ম করে প্রত্যহ তেল ঢালতে হবে! প্রাণের ভয়ে কর্মচারীরা তেল দেয়, পাটের আঁশ কিংবা কাপড় জড়িয়ে সলতে বানায়, প্রদীপ জ্বালায়, বিরূপ পরিবেশ থেকে সুরক্ষা পেতে বিশেষ কাচের ব্যবস্থা; তারপর উঁচু মই বেয়ে সেগুনকাঠের খুঁটিতে আলোর জলসা!

জলাসায় বটে!

রাত গভীর হলে মাঝে মাঝে নুপূরের শব্দ উত্থিত হয়। কখনো অট্টহাসি কখনো-বা মিহি সুরের কান্না কানে বাজে। ব্যাকরণহীন পা ফেলে কারা যেনো এগিয়ে যায়!

কারা ওরা!

প্রজাদের মধ্যে উত্তেজনা। ভয় হয়। ভয়ার্ত শিশুদের মুখ চেপে ধরে অপেক্ষা করে। শব্দ করলেই বিপদ, উঠকো ঝামেলা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসবে, নতুন কোনো হয়রানির মখোমুখি হতে হবে! তাছাড়া কুকাপ (জ্বীন-পরীদের আবাসস্থল) শহরের বাসিন্দা হলে সর্বনাশ, ঘাড় মটকে রক্ত সেবন করবে!

গেরস্থবাড়ির অন্দরমহলে ভুত বিষয়ক উপাখ্যান–

উরা নাকি রাজকন্যার নাকাল বেশ (রুপ) ধরি মানুষকে ডর দেকায়! পত ভুলি জজ্ঞলে নিয়ি যায়! একলা পায়ি গলা টিপি মারি ফেলে!

দুর্বল চিত্তের মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে। দিশাহীন। রাজকন্যার ইতিহাস আরো পুরাতন, গ্রামের কৌতূহলী মানুষ আদতে যা দেখে তা প্রকৃত রাজকন্যা নয়, রাজকীয় পোশাকে অভিজাত বাইজী!

ইংরেজদের রঙমহলে তখন বাইজীদের আকাশছোঁয়া কদর! বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে কুঠির সাহেবরা লক্ষ্ণৌও, পাটনা থেকে বাইজী নিয়ে আসতো, নেশার ঘোরে মহলের বাইরে পা দিত, পায়ে পায়ে গ্রামের রাস্তায় মাতলামো করতো!

ছিঃ, সভ্যতার পুরাণভূমিতে অসভ্যপনা!

পোশাক-আশাক দেখে লজ্জা পায়, আড়ালে মুখ লুকায়। মনের মধ্যে রিঁ-রিঁ করে ওঠে! বাইজীদের দেখে কেউ কেউ ভয় পায়, ভূত ভেবে দৌড়ে পালায়! হৈমন্তিও একদা পালিয়েছিল; ফাঁকা মাঠের কিনারে যে বটগাছ, তার ছায়া মাড়িয়ে বারান্দার চৌকাঠে আছড়ে পড়েছিল। জ্ঞান ফিরতে ফিরতে প্রায় দুদিন!

আমি অবিশ্বাস করি, ধ্যাৎ মিথ্যে বলছো! আজগুবি!

আমার ভুল ভাঙাতে মেয়েটি জোরাজুরি করে না, কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। হয়তো পরীদের আস্তানায় ফিরে যায়! সেইসব আবহ নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে।

কী হলো হৈমন্তি, চুপচাপ যে!

নাহ, ভাবছি।

বটের ছায়ায়, জোছনা রাতে মেয়েটি যে পরীদের নৃত্য দেখেছে, এতে নাকি একরত্তি মিথ্যে নেই! সত্য-মিথ্যা বুঝি না; বৃটিশরা আমাদের অসংখ্য আজব পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, দুষ্ট জ্বীনদের মতো ঘাড় মটকে রক্ত খেয়েছে!

গ্রামের পাশ ঘেষে নীলকুঠি; আশেপাশে আরো কয়েকটি, কঠিয়ালদের ছোটখাট স্থাপনা। পরিত্যক্ত লাল ভবনের পানে তাকালে মনে ভীতি জন্মায়, সাধারণ চাষীদের চাপা কান্না ইথারে ইথারে ধ্বনিত হয়! ইংরেজরা তাদের নীলচাষে বাধ্য করতো। প্রতিবাদ করলেই বিপদ, নিত্যনতুন শাস্তির বিধান জারি হতো; শিকলে হাত বেঁধে, মাথা ন্যাড়া করে নীলের বীজ বপন করতো। এমন দৃশ্য দেখে সাধ্য কার, অন্য ফসল ফলাবে! অথচ নীলচাষ ছিল চাষীদের জন্য ক্ষতিকর।

১৮৬০ সাল নাগাদ নদীয়া জেলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি নীলকরদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে! বাঙালি তথাপি দমে যায় না, মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়। আন্দোলন-সংগ্রাম করে। ভাবে, সুদিন আসবে একদিন!

সুদিনের কথা ভেবে অতীতের পথ ধরি, বাংলার মসনদে তখন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ! বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণীতে জানা যায়, তাঁর (নবাব মুর্শিদকূলী খাঁ) আমলে টাকায় আট মন চাউল! পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি পরান!

নবাবদের গৌরবগাঁথা কিংবদন্তী হয়ে জনতার মুখে মুখে! সাদা চামড়ার প্রতি অরুচি থাকলেও মনে মনে গুণের কদর করে! তাই তো, কত্ত গুণ তাদের; গুণ না-থাকলে কী আর ভারতীয় উপমহাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে পারতো!

বিজলীবাতি তখনো দূরঅস্ত, কেরোসিনের স্বল্প আলোয় কাক-জোছনার আবহ। উৎসবমুখর পরিবেশ। ওই আলোর মধ্যে প্রতিভাত হয় বৃটিশরাজের প্রভাব-প্রতিপত্তি! শহরের বড় রাস্তার ধারে এখন যেমন নিয়ন-সাইন, বাতিগুলোও তেমন; বহুবছর আগে মুর্শিদাবাদের পথঘাট আলোময় করে তুলেছিল।

চর্তুদিকে আলো আর আলো! অথচ আঁধারের কার্নিশে একজন মানুষ হাবুডুবু খায়। আলো নিভে যাওয়ার ভয়ে শংকিত; মনের মধ্যে শংকার মেঘ উড়াউড়ি করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কত, আর কত অপেক্ষা! অপেক্ষার অবসান না হলে জীবন অর্থহীন, ভবিষ্যত অন্ধকার। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাঁদে।

বুকের গহীনে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা স্তিমিত হলে দাদা মেঘু মন্ডলের (মেহের আলী মন্ডল) কন্ঠ উচ্চকিত হয়– আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!

সৃষ্টিকর্তার নামধ্বনি ইথারে-ইথারে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ মেলে তাকাই আমি। দাদা তখনো চিৎকার করে, ওরে তুরা দেকি যা, কিডা আয়িচে; পদীপ, পদীপ– আব্দুল ওহাব এ সুংসারের পদীপ!

বাস্তবের আঙিনা ছেড়ে লোকটি ভবিষ্যতের পানে ধাবিত হয়, তুরা দেকি নিস, ওই ছেইলি বড় হয়ি আমাগের মুক (মুখ) উজ্জ্বল করবে, সায়েবগের বাতির নাকাল জ্বলবে!

দূর-ভবিষ্যত নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না, দাদার কথায় শেষকথা! ছোট্ট শিশুকে অবলম্বন করে একদল মানুষ কল্পনার ভেলায় দাঁড় বাইতো! দাদীর মুখে অম্লান হাসি। তার ধারণা চুন-সুরকির রাস্তা নয় আমি এসেছি জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেসে ভেসে!

উত্তর-দক্ষিণে বয়ে গেছে প্রমত্তা জলঙ্গী। নদীর তীরে এসে দাঁড়ালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এলোমেলো বাতাস শরীরময় লুটিয়ে পড়ে; জলফুল মাথা দুলিয়ে নাচে।

বাবা-মার মনে ব্যথা; দীর্ঘদিন ব্যথার পাড়ার বয়ে বেড়িয়েছে! ভূমিষ্ট হওয়ার কিছুদিনের মাথায় তাদের প্রথম তিনটি সন্তান মারা গেছে; খাঁচা শূন্য করে অচিন ঠিকানায় পাড়ি জমিয়েছে। লাশ সামনে নিয়ে একজন লুৎফুন্নেছা বিলাপ করে, শোন্য কোলে কেরাম করি বাইচপো আমি, তুলি নেউ খুদা, দুনিয়া তিকি তুমি আমাক তুলি নেউ! মরণ দেউ! এরাম করি বাঁচি থাকার চ্যায়ু মরণ ভালো!

বাংলা ও বাঙালির ভাগ্যাকাশে যেমন দূর্যোগের ঘনঘটা আমাদের পরিবারেও তাই; একেকটা সন্তান মরে আর বিষাদের ছায়া প্রশস্ত হয়, হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় স্বপ্নবাজ কিছু মানুষ। বাবা আমার জীবনমুখী; জীবনের বন্দনা করে– আল্লার নীলা বুজা বড় দায় গো, অধৈয্যু হোয়ু না, তিনার দয়া হলি আমাগের ঘর আলো করি ফের সন্তান আসপে, চলো কুনু দরবেশ-ফকিরিরি কাচে যাই, কান্দাকাটি করি!

দূরের পথ পাড়ি দিয়ে মাকে সঙ্গী করে বাবা মোহাম্মদ ফকিরের (পীর) দরবারে উপস্থিত হয়। চোখের জলে বুক ভাসায়। একটা মাত্র সন্তানের জন্য সে কী কাকুতি-মিনতি! আস্তানার মাটিতে গড়াগড়ি খায়। ফকিরকে স্বাক্ষী মেনে আল্লাহর কাছে আঁচল পাতে– দয়া করো খুদা, এই অধমকে তুমি দয়া করো।

আল্লাহ দয়াময়। বাবা-মার আকুতি এবং পীর-বাবার আবেদন উপেক্ষা করতে পারেন নি! দম দেওয়া এক মাটির পুতুল উপহার দিল; পৃথিবীতে এলাম আমি। স্বজনদের মুখে হাসি ফুটলো। সমাজের জঞ্জাল সরাতে একজন শিশু মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে উচিয়ে ধরলো। লড়াই, লড়াই; আজ মনে হয় জীবন মানেই লড়াই!

জন্মস্মৃতির মুখরতা কার না থাকে– আমারো আছে!

বহুদিন গত হয়েছে, কচি-সবুজ চোখ আজ ঝাঁপসাপ্রায়, একটার পর একটা ভাঙনের কবলে পতিত হয়েছি তথাপি জন্মকথা ভুলিনি! দাদীর মুখে শোনা স্মৃতিগুলো চির অম্লান! ভোররাত; ১৯২৭ সালের ১৭ অক্টবরের ভোররাতে আমার জন্ম। জলঙ্গীর তীরে, মন্ডলবাড়ির আঙিনায় নবজাতকের কান্না শুনে মানুষ চকিত হয়, উৎগ্রীব হয়ে দৌড়ে আসে! প্রকৃতিতে ততক্ষণে আলো-আঁধারির বিভাজন। মসজিদে ধ্বনিত হয় ফজরের আযান… আসশাদুআল্লাহ খাইরুম মিনান-নাউম…!

দাদার কন্ঠেও আযানফুল! আযানের মধুর স্বর আমার মরমে মরমে পৌঁছে দেয়। শুধু কী তাই, একজন শিশুকে বরন করে নিতে প্রতিবেশীরা শাঁখ বাজায়! আশেপাশে অসংখ্য হিন্দুর বসতি। তারা তাদের মতো করে আমাকে গ্রহণ করে, ধান-দূর্বা দিয়ে আর্শিবাদ করে। কপালে কাজলের টিপ! মুখে দুধ-ভাত। দুধ-ভাত খেতে ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে আমার মা তার বাপের বাড়ি উপস্থিত হয়েছিল!

এটাই নিয়ম! সাদ, দুধ-ভাত, পানচিনি, আড়াই-ভাত, আঁতুড় ঘর, ছয়-কুলোর রাত, কামান-অসংখ্য প্রথার মাধ্যমে বাঙালি সমাজ নিয়ন্ত্রিত! কতক প্রথায় ভেদ ছিল না, হিন্দু-মুসলামান একত্রে যাপন করতো!

একজন নবজাতকের আগমন উপলক্ষ্যে কত আয়োজন! মায়ের গর্ভে শিশুরা যখন আড়মোড়া ভাঙে প্রবিবেশী ও স্বজনরা নঁকশীকাথায় ফোঁড়ন দিতে ব্যস্ত। আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যে শিশুকে বরণ করতে নানাবিধ আয়োজন! মায়ের জন্য অসংখ্য বিধিবিধান– অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় ঘরের বাইরে পা দেওয়ার নিয়ম নেই; চুল ছেড়ে প্রদীপের মৃদু আলোর সম্মুখে বসে থাকতে হবে; জল স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় আরো বেশি কড়াকড়ি! আঁতুড়ঘরের দেওয়ালে রক্ষাকবচ হিসেবে টাঙানো থাকে বরই গাছের কাটাযুক্ত শাখা; বাইরে কঠোর নিরাপত্তা! কাঁটার ভয়ে দৈত্যরা মা ও নবজাতকের ধারে-কাছে ভিড়বে না, অনিষ্ট করবে না। ছয়-কুলোর রাতে বিপদের আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়! জন্মের ষষ্ট দিনে আমাদের পূর্বপুরুষরা অসংখ্য শিশুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আজ বুঝতে পারি, শিশুরা মরতো ধনুষ্টঙ্কারে; ধনুষ্টঙ্কারের জীবাণু নিয়ে জন্মানো শিশু জন্মের ষষ্ঠ দিনে মারা যায়! কিন্তু তখনকার ধারণা অন্যরকম– ওই রাতে সৃষ্টিকর্তা নবজাতকের ভাগ্যলিপি রচনা করেন, তার আগেই ভূত-প্রেত আঁচড় করে, প্রাণনাশের চেষ্টা করে!

ভাগ্যলিপি রচনা নিয়ে বিপত্তি– কলম কোথায়! গ্রামে শিক্ষিত মানুষের অভাব। একটা কলমের জন্য অবিভাবকরা শিক্ষিতজনের দুয়ারে কড়া নাড়তো– ওগো, তুমাগের কলমডা ইট্টু দেউ গো, আচিঘরে (আঁতুড় ঘর) কলম না থুলি তো হবেনান!

নিরুপায় হয়ে ভাঙাচোরা কলম শিশুর শিওরে রেখে দিত। কলম সংগ্রহে যারা ব্যর্থ হতো তাদের জন্য ছিল কঞ্চি ও তালপাতা; শুকনো কঞ্চি কলমের মতো ছুঁচালো করে তালপাতার উপর বিধিলিপি রচিত হবে! এই না হলে বিশ্বাসবোধ! লেখাপড়া না হলে সৃষ্টিকর্তার উপর দায় চাপাতো– উর আর দোষ কী বলো, ভাগ্যি লেকাপড়া লেকিনি আল্লা; লেকপে কি করি, আমাগের কলম ছিলু নাকি!

আল্লাহর উপর দায় চাপানোর সুযোগ আমার ছিল না; বাপ-দাদা জোতদার হলেও শিক্ষার প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল! বাবা জয়নুদ্দিন আহমেদ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তহশিলদার! অতএব, কলমের অভাব হয়নি।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu