জাকির তালুকদার
জাকির তালুকদার বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত আসন তৈরি করে নিয়েছেন। তিনি ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার এবং ২০১২ সালে জেমকন সাহিত্য পুরষ্কার পান। তার সর্বাধিক আলোচিত দুটি উপন্যাস গ্রন্থের নাম: পিতৃগণ ও মুসলমানমঙ্গল।
জাকির তালুকদার

উপন্যাসাংশ: “পিতৃগণ” // জাকির তালুকদার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

জাকির তালুকদার সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শিল্পী। তাঁর অধিক সমাদৃত  ঐতিহাসিক উপন্যাস পিতৃগণের ২৫তম অধ্যায়টি পাঠকদের জন্য দর্পণে উপস্থাপন করা হলো। সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা এতে উঠে এসেছে অতি চমৎকারভাবে– যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। গ্রন্থটি আপনারা রকমারি থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।


২৫. অন্ধকারের শেষলিপি


নিজেদের অনেক সহযোদ্ধাকে হারিয়েছে তারা আজকের যুদ্ধে। আহতের সংখ্যাও অনেক। তবু আজ কৈবর্তশিবিরে আনন্দের রাত। আজকের যুদ্ধে সুস্পষ্ট বিজয় হয়েছে তাদের। আজ তারা প্রত্যেকেই বুঝে গেছে, রামপাল আর তার সঙ্গী আঠারো মহাসামন্তের অযুত সৈন্য মুখোমুখি যুদ্ধে কোনোদিনও পরাজিত করতে পারবে না কৈবর্তদের। নিজের সাথীদের আহত-নিহত মনে বড় কষ্ঠ পেয়েছে ভীম। প্রত্যেক সাথীর মৃত্যুকে মনে হয়েছে নিজের সত্তারই একটি অংশের মৃত্যু। কিন্তু তাই বলে নিজেদের যোদ্ধার সংখ্যা কমে যাওয়ায় একটুও হতাশ নয় ভীম। বার বার প্রমাণিত হয়েছে, সংখ্যার চাইতে বীরত্ব এবং ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করার অনুভূতি যাদের রয়েছে, যুদ্ধের জয় হয় তাদেরই। তাছাড়া নিহত যোদ্ধাদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য সংবাদ পাঠানো হয়েছে। প্রতিরক্ষা প্রাচীরকে পাহারা দিচ্ছে রাজবংশী যোদ্ধারা। তারা কাল প্রভাতেই এসে যোগ দেবে যুদ্ধে।

নিজের তাঁবুতে প্রদীপ নিভতে দেয়নি পপীপ। সারাদিনের যুদ্ধে সে ক্লান্ত। কিন্তু তাই বলে শ্লোক রচনার কাজটি ফেলে রাখতে সম্মত নয় কিছুতেই। বরং সারাদিনের যুদ্ধক্লান্তি তার তুচ্ছ হয়ে গেছে ভীম এবং তার সাথীদের বীরত্বের পরাকাষ্ঠা নিজের চোখে দেখতে পারার সৌভাগ্যে। তার লেখনির মুখ থেকে শ্লোক ঝরছে অবিরল। লিখতে লিখতেই ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে ওঠে পপীপের। সন্ধ্যাকর নন্দীর কথা মনে হয়। মহাকবি নিশ্চয়ই যুদ্ধক্ষেত্রে আসেননি। এলে দেখতে পেতেন, যাদের তিনি রাক্ষস, অসুর, বয়াংসী বলে তুচ্ছ করে কাব্য লিখেছেন, সেই কৈবর্তরা আজ যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের এক মহাকাব্য রচনা করেছে। মনে মনে কুরমিকে স্মরণ করে সে। তোমার কবি জয় নিয়ে ফিরে যাবে তোমার কাছে।

চারিদিকে নিশুতি। অল্প কয়েকজন প্রহরী ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। পপীপের ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কাল প্রত্যুষেই তো আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে। কিছুটা ঘুমিয়ে না নিলে দেহ পরিপূর্ণ সতেজতা ফিরে পাবে না। আর যুদ্ধক্ষেত্রে সতেজ শরীরের যে কী মূল্য, আজকের যুদ্ধে তা বুঝতে পেরেছে সে।

ফুঁ দিয়ে প্রদীপ নিভিয়ে ফেলে পপীপ। নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দেয় শক্ত বিছানাতে। কুরমির মুখ ভাবতে ভাবতে অপেক্ষা করে ঘুমের।

হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে যায়।

চোখ বন্ধ রেখেও পপীপ টের পায় হঠাৎ করেই বাইরের অন্ধকার রাত আলোয় আলোময় হয়ে গেছে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পপীপ। বুঝতে পারে না কী ঘটেছে। সে কি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল? টেরই পায়নি কখন সূর্য উঠে এসেছে মাথার ওপর? কিন্তু তাহলে তো এতক্ষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু তার সঙ্গীরা তাকে ডাকবে না– এমনটি তো হতেই পারে না। এরপর কানে আসতে থাকে প্রচণ্ড মরণচিৎকার, ক্রুদ্ধ হাঁক-ডাক, ঘোড়ার মুহুর্মুহু হ্রেসারব আর খুরের শব্দ।

চোখ ডলতে ডলতে তাঁবুর বাইরে এসে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তাতে মূহুর্তে মৃত্যুযন্ত্রণার মতো কষ্টে আক্রান্ত হয় পপীপ। যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্ব পাশ জুড়ে ভূমিপুত্রযোদ্ধাদের শিবির স্থাপন করা হয়েছে অর্ধচন্দ্রের আকৃতিতে। ভীমের ইচ্ছা, সকলে যুদ্ধ শুরুর সময় তার বাহিনী অর্ধচন্দ্রাকৃতিব্যূহ রচনা করে শ্ত্রুকে প্রতিরোধ করবে। প্রত্যুষে ব্যূহ রচনায় সুবিধা হবে মনে করে এভাবেই শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির শিবিরের দুই অগ্রবর্তী সূচিমুখের তাঁবুগুলি ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁবুগুলিতে। ঘুমের মধ্যেই আগুনে পুড়ে মরছে ভূমিপুত্রসেনারা। যারা বিহ্বল ঘুমমাখা চোখে বেরিয়ে আসছে তাঁবু থেকে, তাদের মুণ্ড মুহূর্তে ধর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে রামপালের সৈন্যরা।

এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পপীপ। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে ভীমের কথা। ভীমকে এই সংবাদ জানানো প্রয়োজন। ভীমের তাঁবুর দিকে ছুটে যায় সে। দেখতে পায় ভীম তার তাঁবুর বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ক্রোধে জ্বলছে দুই চোখ। আবার নিজের সাথীদের এভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখে ক্ষণে ক্ষণে বেদনায় সজল হয়েও উঠছে সেই দুই চোখের পাতা। সেই অশ্রুজলেও আগুনের আভা। চিৎকার করে যেন নিজেকেই নিজের কথা শোনাচ্ছে ভীম– হায় আমি কী বোকা! আমাকে পিতৃব্য দিব্যোক আর পিতা রুদোক বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, সাপ-হায়েনা আর পালরাজা-আমত্যদের বিশ্বাস করতে নেই। আমি সেই কথা মনে রাখিনি। বীরের ধর্ম পালন কত্র ন্যায়যুদ্ধ করবে রামপাল এমনটাই আশা করেছিলাম। হায় আমি শৃগালের কাছে সততা আশা করেছিলাম।

পপীপ কাছে গিয়ে দেখতে পায় মল্ল আর উগ্র এসে দাঁড়িয়েছে ভীমের পাশে। তারা ইতোমধ্যেই অস্ত্র তুলে নিতে পেরেছে। তারা চিৎকার করে তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুমন্ত সৈন্যদের ডেকে তুলেছে। হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বলেছে। পপীপ সামনে তাকিয়ে দেখতে পায়, ভীমকে লক্ষ করে ছুটে আসছে রামপালের কয়েক সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য। তাদের সামনের সারির লোকদের হাতে জ্বলন্ত মশাল। সেই মশালের আলো আলো পড়েছে তাদের চোখে-মুখে। মনে হচ্ছে মানুষ নয়, হাজার হাজার পিশাচ ছুটে আসছে ভীমের দিকে। কয়েক সহস্র অশ্বারোহীর পেছনে ছুটে আসছে আরও কয়েক সহস্র পদাতিক। তারা আসছে ভীমকে সহচরসহ পৃথিবী থেকে নির্মূল করার উন্মত্ত বাসনা নিয়ে। মল্ল দেখতে পায়, আগুয়ান অশ্বারোহীদের একেবারে মাঝখানে রয়েছে কাহ্নুর দেব। সেই-ই তাহলে এই মধ্যরাত্রির বর্বর-কাপুরুষোচিত আক্রমণের হোতা। মল্ল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যুদ্ধে হার-জিত যাই হোক ঐ বর্বর নরপিশাচকে যমালয়ে না পাঠিয়ে আমি মরব  না।

ভীমের পাশে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছে কয়েকশত ভূমিপুত্রযোদ্ধা। ভীম চিৎকার করে বলে– বল্লম তুলে নাও হাতে সবাই। স্থির নিষ্কম্প হাতে বল্লম ধরে লক্ষ স্থির করো ছুটে আসা ঘোড়াগুলোর সামনেই দুই পায়ের মাঝখানে ঠিক হৃদপিণ্ডের সোজাসুজি।

অযুত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে পারছে ভীমের মাত্র কয়েকশত যোদ্ধা। পপীপ সর্বশক্তিতে হাতে বল্লম ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ছুটে আসা অশ্বারোহীর দিকে। ঘোড়াগুলো ছুটে আসছে। ওরা কেউই প্রতিরোধ আশা করছে না। যেভাবে দুই পার্শ্বব্যূহের ঘুমে অচেতন ভূমিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে, সেই একইভাবে ভীম এবং তার সহচরদেরো হত্যা করা যাবে ভেবে তারা নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসছে। পপীপ একদৃষ্টিতে লক্ষ্য নিবদ্ধ করে তার দিকে ছুটে আসা ঘোড়াটির সামনের দুই পায়ের মাঝখানের বুকের দিকে। কোনো পড়ন্ত ফল যেভাবে চাকুর ডগায় গেঁথে যায়, ঠিক সেইভাবে তার বল্লমের ডগায় এসে বুক পেতে দেয় ঘোড়াটি। পপীপকে কিছুই করতে হয় না। ঘোড়াটি নিজেই যেন নিজের বুকে গেঁথে নেয় বল্লমের ফলা। তারপরেই যেন নরক ভেঙে পড়ে পপীপের চারপাশে।

তার প্রায় গায়ের উপরেই পড়েছে ঘোড়াটি। অশ্বারোহী ছিটকে পড়েছে শক্ত মাটিতে। মট করে একটা শব্দ হয়। বোধহয় ঘাড় ভেঙে গেছে লোকটার। তার দিকে তাকিয়ে আর সময় নষ্ট করে না পপীপ। তরবারি হাতে মুখোমুখি হয় কাছে এসে পড়া পদাতিক সৈন্যটির। লোকটা ছুটে আসছে নিজের অস্ত্র বাগিয়ে। পপীপও সাঁৎ করে এগিয়ে একেবারে কাছে ভীড়ে যায় লোকটার। এত দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন করবে  পপীপ তা ভাবতে পারেনি লোকটা। তার বুকের ডানপাশটিকে একেবারে অরক্ষিত পেয়ে যায় পপীপ। নির্দ্বিধায় হাতের তরবারি আমূল ঢুকিয়ে দেয় লোকটার ডানবুকের মধ্যে। তারপর আর সচেতনভাবে কিছু করার কথা মনে থাকে না পপীপের। খাগের লেখনির কথা ভুলে গিয়ে অস্ত্রহাতে শত্রুনিধনে মত্ত হয়ে পড়ে কবি।

মল্ল তার খরগ চালাচ্ছে এমন তীব্র শক্তির সাথে যে যার সাথেই সংঘর্ষ ঘটেছে সেই খড়গের, সেখান থেকেই ছুটছে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। চারজন-পাঁচজন করে শত্রুসৈন্য একসাথে ঘিরে ফেলেছে তাকে। কিন্তু মল্ল সেন আজ অজেয়। চারজন শত্রুকে মেরে ফেলতে তার যেন চারটি নিমেষেরও প্রয়োজন হচ্ছে না। তার সমস্ত শরীর শত্রুসৈন্যের রক্তে রঞ্জিত। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মহাকাল রক্ত মেখে নেমে এসেছে এই যুদ্ধক্ষেত্রে।

উগ্র সবসময় চেষ্টা করছে ভীমের পাশে থাকতে। চেষ্টা করছে নিজের দেহকে ভীমের বর্মরূপে ব্যবহার করতে। শত্রুর অস্ত্র যাতে ভীমের শরীরকে স্পর্শ করতে না পারে, সেইজন্য একহাতে তরবারি, আরেকহাতে বর্ম নিয়ে ঠেকিয়ে চলেছে শত্রুসৈন্যদের। কিন্তু ভীমের যেন কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দুইহাতে দুই তরবারি চালিয়ে যাচ্ছে। আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি পড়লে যেমন শব্দ হয়, ভীমের তরবারির আঘাতে শত্রুসৈন্যের মুণ্ড মাটিয়ে গড়িয়ে পড়ে সেই রকম শব্দে।

মল্ল হঠাৎ ছুটে আসে পপীপের কাছে। পপীপ তখন যুদ্ধ করছে বিশালদেহী এক আর্যসৈন্যের সাথে। মল্ল চরম অবহেলায় একবার তার হাতের খড়গ উপর-নিচ করে। বিশালদেহী লোকটা যেন দুই টুকরা হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। মল্ল হ্যাঁচকা টানে পপীপকে সরিয়ে নিয়ে আসে একটা তাঁবুর আড়ালে। সেখান থেকে কাহ্নুর দেবকে দেখিয়ে বলে– ঐ দেখ! ঐ যে শত শত দেহরক্ষীর মাঝখানে সবচেয়ে উঁচু ঘোড়ায় চেপে সৈন্যদের পরিচালনা করছে যে লোকটা, সে হচ্ছে কাহ্নুর দেব। বীরের ধর্ম ভুলে আমাদেরকে ঘুমের মধ্যে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ঐ শুয়োর-সন্তানের। কেননা সেই-ই হচ্ছে রামপালের প্রধান সেনাপতি। আমি যাচ্ছি কাহ্নুরকে নরকে পাঠাতে। তুই এখানে না থেকে ভীমের কাছাকাছি চলে যা। আর বেশিক্ষণ যুদ্ধ চলবে না। বুঝতেই পারছিস, বেশিক্ষণ যুদ্ধ চালানোর মতো যোদ্ধা আমাদের বেঁচে নেই। ঘুমের মধ্যেই প্রায় সকলকে হত্যা করেছে নরপশুর দল। তুই ভীমের পাশে থাকিস। অন্তত তুই বেঁচে থাকতে যেন ভীমের গায়ে কোনো অস্ত্র আঘাত না করতে পারে!

কথা শেষ না করেই কাহ্নুর দেবকে লক্ষ করে ছোটে মল্ল। পপীপ ভীমের কাছে যাওয়ার কথা ভুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে এক অলৌকিক যোদ্ধাকে। খড়গ এখন পিঠের সাথে ঝুলিয়ে নিয়েছে মল্ল। তার দুই হাতে দুইটি ছোট আকারের তরবারি। সে এঁকেবেঁকে ছুটছে কাহ্নুর দেবের ঘোড়া লক্ষ করে। প্রথমে এভাবে তার ছুটে যাওয়াকে লক্ষই করেনি শত্রুপক্ষের কেউ। কিন্তু অনেক কাছে চলে যাওয়ার পরে কাহ্নুর দেবকে বেষ্টন করে রাখা দেহরক্ষীদলের চারজনের দৃষ্টি পড়েছে মল্লর উপর। তারাও তীব্র গতিতে ছুটে আসা মল্লর মনোভাব বুঝতে পারেনি। ইতস্তত করছে কী করবে। আবার এত এত সৈন্যের প্রতিরোধ ভেদ করে লোকটা কীভাবে এতদূর এল ভেবে পাচ্ছে না তারা। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবনার অবকাশ যুদ্ধক্ষেত্রে নেই। সেই ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত করতে হলো তাদের জীবন দিয়ে।

তারা মল্লকে থামানোর উদ্যোগ করার আগেই ঝলসে ওঠে মল্লর দুই হাতের তলবারি। মুহূর্তে ধরাশায়ী হয় তারা। আর মল্ল পেয়ে যায় কাহ্নুর দেবের কাছে পৌঁছে যাওয়ার খোলা পথ। কাহ্নুর দেব হাতে একটি তলবারি ধরে রেখেছে বটে, কিন্তু এটিকে তার ব্যবহার করতে হবে এমনটি একবারও ভাবেনি। হঠাৎ মল্ল তার সামনে যমদূতের মতো উপস্থিত হয়ে পড়ায় সে এতই অবাক হয়ে যায় যে তার নিজের হাতে যে অস্ত্র আছে, সেটি তার মনেই থাকে না। মল্ল তার দিকে তাকিয়ে বীভৎস এক হাসি হাসে। তারপর সাঁই করে একহাতের তরবারি চালায় কাহ্নুর দেবের পেট লক্ষ করে। পেট ফুটো হয়ে ঢুকে যায় তরবারি, আর কাহ্নুর দেব ঘোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। তার বুকের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মল্ল বলে– কাপুরুষ! রাতের অন্ধকারে আমার সঙ্গীদের হত্যা করেছিস তুই। ভেবেছিস পার পেয়ে যাবি! যদি আজ এই যুদ্ধক্ষেত্রে তোর পরিবারকে পেতাম তাহলে নরকে পাঠাতাম সবাইকে। আজ তুই একাই যা নরকে!

কথা শেষ হতে না হতেই মল্লর তরবারি পুরোপুরি ঢুকে যায় কাহ্নুর দেবের বুকে। তাকে মৃত্যুযন্ত্রণায় গলাকাটা মুরগির মতো ঝটপাতে দেখে খুশিতে অট্টহাসি হাসতে ইচ্ছে করে মল্লর। সে হাসার জন্য ঠোঁট ফাঁকও করতে যায়। কিন্তু চারপাশ থেকে ইতোমধ্যে তার বুকে পেটে ঢুকে পড়েছে কয়েকটি ধারালো অস্ত্রের ফলা। মূহুর্তে তীক্ষ্ণ-তীব্র একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে মল্লর সমস্ত স্নায়ু বেয়ে। সে উবু হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। তার দেহের ওপর তখনো উপর্যুপরি অস্ত্রাঘাত করা হচ্ছে। কিন্তু সেসবের আঘাতে আর কোনো কষ্টই টের পাচ্ছে না মল্ল। কারণ তার মনে হচ্ছে ঊর্ণাবতী মাটিতে বসে নরম কোমল কোলের উপর তুলে নিয়েছে তার মাথাটি।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অসম যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ভীম এবং ভীমের পক্ষের কোনো যোদ্ধা আর বেঁচে নেই। ভীম, উগ্র আর পপীপের দেহে এত তীর বিঁধেছে যে তাদের মাটিতে পড়ে থাকা দেহকে তিনটি বিশাল সজারু বলে মনে হচ্ছে। বিজয়ী রামপাল যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে এসেছে প্রিয় হাতির বাদল-এর পিঠে চড়ে। মাহুত তাকে নিয়ে এসেছে ভীমের ভূতলশায়ী দেহের কাছে। ভীমের মৃতদেহ নিজ চোখে দেখার আগে পূর্ণ বিজয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারছে না রামপাল।

ভীমের শরবিদ্ধ দেহের পাশে এসে বাদলকে দাঁড় করায় মাহুত। রামপাল নামে না হাতির পিঠ থেকে। একজন সৈন্যকে আদেশ করে ভীমের উবু হয়ে পড়ে থাকা দেহটিকে চিৎ করে দিতে। সৈন্যটি রাজার আদেশ পালন করে। রামপাল আদেশ করে, ভীমের একেবারে মুখের কাছে মশাল নিয়ে যেতে। যাতে সে পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় ভীমের মৃতমুখ। সন্দেহ ভঞ্জন করতে পারে নিজের দুই চক্ষুর।

মশাল আনা হয়। রামপাল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ভীমের মুখের দিকে। হঠাৎ মনে হয়, মশালের তীব্র আলোয় একবার নড়ে উঠেছে ভীমের চোখের পাতা। অবিশ্বাসে দুই চোখ বড় বড় হয়ে যায় রামপাল এবং তার সঙ্গীদের। তারা ভালো করে নিশ্চিত হতে চায়, যা দেখেছে তা তাদের চোখের ভুল। তাই তারা আরও কাছে এগিয়ে যায়। কিন্তু না! তাদের চোখ ভুল দেখেনি। কারণ এবার আস্তে আস্তে পুরোপুরি খুলে যায় ভীমের দুই চোখের পাতা। রামপাল আশ্চর্য হয়ে বলে– তুই এখনো মরিসনি! এখনো বেঁচে আছিস!

ভীমের মুখে ফুটে ওঠে এক টুকরো আশ্চর্য হাসি। তারপরেই সেই মুখে ফুটে ওঠে তীব্র ঘৃণা। খুব কষ্টে ঠোঁট নাড়াতে পারে ভীম। রামপালের দিকে তাকিয়ে বলে– তুই বলেছিলি না যে তুই অর্জুনের বংশধর।

বিহ্বল রামপালের মুখ থেকে নিজের অজান্তেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে– হ্যাঁ বলেছিলাম।

ঠিকই বলেছিলি। তুই আসলেই অর্জুনের বংশধর।

একথার পিঠে কী বলবে বুঝে পায় না রামপাল। ভীম আবার বলে– আর্জুন আসলে কে জানিস?

পাণ্ডুর পুত্র।

না। অনেক কষ্ট হলেও মাথা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে অস্বীকৃতি জানায় ভীম– অর্জুন আসলে পাণ্ডুর বীর্যে জন্ম নেয়নি। তার মা কুন্তি নিজের মুখেই স্বীকার করেছে, অর্জুনের জন্ম হয়েছিল ইন্দ্রের বীর্যে। অর্জুন আসলে জারজ সন্তান।

একথার কী উত্তর দেবে রামপাল! সে কাঁপতে থাকে ক্রোধে। ভীম সেই রকম কষ্ট করেই বলতে থাকে– জারজ অর্জুনের বংশধর তুই। তোদের জন্মের ঠিক নেই। তাই তোদের মুখের কথারও ঠিক নেই। তুই আসলেই অর্জুনের বংশধর। এই কথাটা জানানোর জন্যই এখনো বেঁচে রয়েছি আমি।

ক্রোধে কাঁপছে রামপাল– না। তুই এখনো বেঁচে আছিস আমার হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে নরকে যাবি বলে!

মাহুতকে ইঙ্গিত করতেই সে পরিচালনা করে বাদলকে। হাতিকে বহুবার এই কাজে ব্যবহার করেছে রামপাল। পায়ের নিচে কোনো মানবশরীরকে থেঁতলে যেতে দেখলে রামপালের মতো তার হাতিও আনন্দিত হয়। মাহুতের ইঙ্গিতমাত্র বাদলের বিশাল পায়ের নিচে থেঁতলে যায় ভীমের শরীর।

ক্রোধে তখনো কাঁপছে রামপালের সমস্ত শরীর। মন এমন তিক্ততায় পরিপূর্ণ, যে তিক্ততা এর আগে কোনোদিন অনুভব করেনি সে। মনে হচ্ছে যুদ্ধে সে জয়ী হতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে তাকে হারিয়ে দিয়েছে ভীম। সেই অতিরিক্ত ক্রোধ আরও বিষ উগড়ে দেয় তার মুখ থেকে। সে নির্দেশ দেয়– ভীম বা কোনো কৈবর্তযোদ্ধার মৃতদেহ সৎকার করা যাবে না! ওগুলো এখানেই পড়ে থাকবে শৃগাল-কুকুর-শকুনের খাদ্য হবার জন্য।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu