চাণক্য বাড়ৈ মূলত সমকালীন সময়ের একজন প্রতিভাবান তরুণ কবি। “কাচের মেয়ে” তাঁর প্রথম উপন্যাস। বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের জীবন সংগ্রাম এই উপন্যাসের মূখ্য বিষয়। কাচের মেয়ে উপন্যাসের একটি বিশেষ অংশ দর্পণে উপস্থাপন করা হলো। উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে রচিত। উপন্যাসের এই অংশে নিজগৃহে নারী নির্যাতনের একটা অংশ উঠে এসেছে। তাছাড়া এখানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও তার পরিবারের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন সম্পর্কে এমন গ্রন্থ আর নেই। উপন্যাসগ্রন্থটি আপনারা রকমারি থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।
…নিয়ম অনুযায়ী মরিয়ম আমার মা। আমার চেয়ে তার বয়স কোনোভাবেই পাঁচ বছরের বেশি হবে না। আমি যে বছর হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করেছি, সে বছর সে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। দুইবার পরীক্ষা দিয়েও এসএসসি পাস করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার ফেল করার পর সে আমার মা হয়ে এল আমাদের বাড়িতে। তখন থেকেই মরিয়ম আমার মা। কেননা সে বাবার বিয়ে করা বউ, দ্বিতীয় স্ত্রী। সে হয়তো মনে মনে আশা করেছিল, কিন্তু কোনোদিনও তাকে আমি ‘মা’ বলে ডাকিনি।
আমার মা বেঁচে থাকতে আমাদের সংসারে অশান্তির বীজ রুয়ে দিয়েছিল এই মরিয়ম। সেই বীজ সন্দেহের জল, অবিশ্বাসের হাওয়া আর মানসিক সংঘাতের উত্তাপে অঙ্কুরিত হয়ে একসময় ডালপালা বিস্তার করে গ্রাস করে ফেলেছিল আমাদের মোটামুটি সুখ-স্বচ্ছন্দের ছোট্ট পরিবার। তখন এতকিছু স্পষ্ট করে বুঝতে না পারলেও এখন আমার কাছে দিঘির টলটলে জলের মতো পরিষ্কার। বাবা আর মায়ের মধ্যে প্রায়ই উত্তপ্ত বাক্যব্যয় হতো, টের পেতাম। আর তখন আমার বুকের ভেতরে বয়ে যেত নোনা জলের নদী। এসব নিয়ে পাড়াময় ছিল এক নীরব রটনা। বাড়ির মেয়েমহলেও প্রায় সময়ই কানাঘুষা চলত। আমি কাছে গেলে তারা হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলত। যেন তারা খুব অদরকারি একটা বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-তামাশার কথা বলছিল এতক্ষণ। নিষ্পাপ হাসি দিয়ে তারা একজন আরেকজনের ঘাড়ের ওপর ঢলে পড়ত আর অদ্ভুত করুণাভরা আড়চোখে তাকাত আমার দিকে।
প্রায় প্রতিরাতেই বাবা বাড়ি ফিরতেন অনেক দেরি করে। কী ঝড়, কী বৃষ্টি, কী শীতের রাত– গ্রাম তখন একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যেত। আমাদের গ্রামের মধ্যরাতের সেই নিস্তব্ধতা হয়ে উঠত রূপকথায় শোনা এক রহস্যঘেরা পাহাড়ের মতো অনেক উঁচু। গ্রামের প্রতিটা মানুষ তখন ঘুমিয়ে পড়ত গভীর ঘুমে। ঘুম যত গভীর হতো, মানুষের নিঃশ্বাসের আওয়াজ তত বেশি পাওয়া যেত। জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে তাকানোর সাহস হতো না আমার। আমিও ততক্ষণে পড়া শেষ করে হারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে ডুবে যেতাম গভীর ঘুমে।
মধ্যরাতে আমার ঘুম হালকা হয়ে আসত। কুকুরের একটানা ঘেউঘেউ শব্দ রাতের নিস্তব্ধতায় এমনভাবে গুঁতো মারত যে, তাতে আমার কানের তালা এমনিতেই খুলে যেত। সেই আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মধ্যে আমি বুঝে ফেলতাম, রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে বাবা আমাদের বাড়ির পথে প্রবেশ করেছেন কেবল। আর তাতেই ডেকে উঠেছে পাড়ার কুকুরগুলো। প্রায় প্রতিদিন এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলেও কুকুরগুলো তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারত না। বাবা তার হাতের পাওয়ার কমে আসা তিন ব্যাটারি টর্চ লাইটের আলো জ্বালতে জ্বালতে ঘরের কাছে চলে এলে কুকুরগুলো বাবার গায়ের ঘ্রাণ চিনে ফেলত। থেমে যেত তাদের ডাকাডাকি। এত দিনের শোনা কথাটি রাত গভীর হয়ে এলে আমার কাছে এভাবে প্রমাণ নিয়ে হাজির হতো। চোখ দিয়ে নয়, ঘ্রাণশক্তি দিয়েই তারা মানুষ শনাক্ত করে। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর।
এর একটু পরেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে চেঁচিয়ে উঠত আমাদের বারান্দার ঘুণে ধরা কাঠের দরজা। দৃশ্য: বাবার গৃহে প্রবেশ। সেই শব্দে আমার ঘুম সম্পূর্ণ কেটে গেলে আমি আবার চেতনার জগতে ফিরে আসতাম। এর পরবর্তী সময়টুকু ছিল আমার জন্য ভীষণ কঠিন, বিভীষিকাময়। শুরু হয়ে যেত বাবা আর মায়ে ঝগড়া। আমি আঙুল দিয়ে কান চেপে ধরেও তার শব্দ আটকে রাখতে পারতাম না। বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সেই নোনা নদীটা গলগল করে বের হয়ে আসত চোখের ধারা বেয়ে। তখন আরও একটা চিরপরিচিত কষ্টের পাহাড় এসে চেপে বসত আমার বুকের ওপরে। শব্দ করে কাঁদতে না পারার কষ্ট। আমার চুল ভিজে যেত চোখের পানিতে। চুল চুঁইয়ে সেই পানি ভিজিয়ে দিত বালিশ। আমি বালিশটা উলটিয়ে নিতাম। কোনো কোনো রাতে তিন-চারবার করেও আমি বালিশ উলটিয়ে নিয়েছি, মনে পড়ে।
মনে পড়ে এক রাতের কথা। আমার চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মা হঠাৎ ফণাতোলা সাপের মতো ফুঁসে উঠল। বাবা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, মা দরজা চেপে ধরে ভেতর থেকে আস্তে অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল:
– আজ তুমি ঘরে ঢুকতি পারবা না। বাবা যেন এই নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
– ক্যান কী হইছে আবার?
– এতক্ষণ তুমি চাকলাদার বাড়ি ছিলে না? সত্যি কথা কও!
– হ, ছিলাম চাকলাদার বাড়ি, তাতে কী হইছে?
– কী হইছে, তুমি বোঝো না? যদি না বোঝো, তালি নতুন করে বোঝার দরকার নাই। আজ তোমার ঘরের বাইরি থাকতি হবে। ঘরে ঢুকতি পারবা না তুমি।
– নাছির চাকলাদারের সাথে আমার ব্যাপসা না? আমি চাকলাদার বাড়ি যাবো না তো কেডা যাবে?
– এত রাত পয্যন্ত ব্যাপসা? আর কেউ ব্যাপসা করে না? নাছির চাকলাদার রাত দশটার মধ্যি নাক ডাকতি ডাকতি ঘুমায়। ঘুমের মানুষের সাথে তুমি এত রাত পয্যন্ত ব্যাপসা করো? কিছু বুঝি না আমি? তাই মনে করো?
একটার পর একটা প্রশ্ন এখন হতেই থাকবে, আর বাবাকে বিব্রত হতে হবে। এটা বুঝতে পেরে বাবা চুপ করে গেলেন। তিনি নিরুত্তর থেকে দরজা ঠেলতে লাগলেন। কিন্তু খুলতে সফল হলেন না। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে বাবা আরো রেগে গেলেন। গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করার কারণেই সম্ভবত তার কণ্ঠ আরো উচ্চকিত ও তীব্র হয়ে উঠল। আমি শুনতে পেলাম তার ফিসফিস অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার:
– শীতের ভিতরে কুদরঙ্গি শুরু করিছো? এই মাগী, দরজা খোল। ভালো হবে না কিন্তু। কয়ে দিলাম!
মা বোধ করি এবার খিল দেওয়া দরজাটা আরো চেপে ধরে নিজের অবস্থান পোক্ত করে নিল। তারপর বলল,
– বেশ্যা বাড়ির থেকে আসলি হাত-পাও ভালো করে ধুয়ে তারপর এই ঘরে ঢুকতি হবে। অজু করে আসতি হবে। তার আগে না। আমার এই অ্যাকটাই কথা।
এবার আমি টের পেলাম, বাবা জানালার ফাঁক গলিয়ে হাতের তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট দিয়ে মার মাথায় বাড়ি মারার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর মা কোনোমতে মাথা বাঁচিয়ে দরজা চেপে ধরে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আপ্রাণ। তাতে বাবা আরো ক্ষেপে গিয়ে দ্বিগুণ বিক্রমের সাথে মায়ের মাথায় বাড়ি মারার কসরৎ করে যাচ্ছেন, আর বলছেন,
– বেশ্যা বাড়ি মানে? বেশ্যা বাড়ি মানে কী, অ্যাহ্? ঘরে বড় মাইয়ে আছে, তা মনে থাহে না তোর?
– আমার মনে থাহে। মনে থাহে না তোমার। তোমার যদি মনে থাকত, তালি তুমি রোজ রাত্তিরি ওই মাগীর ধারে যাতি পাইত্তে না।
মায়ের গলা চড়ে যেতে চায়। কিন্তু খুব কষ্টে তা চেপে রাখে। ফোঁপায় কিছুক্ষণ। বাবা বলে ওঠেন,
– এই শালী, মুখ সামলায়ে কথা ক দেহি। খোল, দরজা খোল। খোল কলাম!
– না। আজ যদি আমি মরেও যাই, এই ঘরে তোমারে ঢুকতি দেব না। কোনোমতেই এই ঘর তোমারে নাপাক কত্তি দেব না।
– লাত্থি দিয়ে দরজা ভাইঙ্গে ফেলব কিন্তু। তাড়াতাড়ি খোল। সানিয়া সব শুনতিছে কিন্তু। খোল।
– তা শুনুক। বাপের চরিত্র কেমন, মাইয়ের তা জানার দরকার আছে না? জানুক সব। বাপের কীত্তি দেখুক।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মা। নাক টানে। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক-চোখ মুছে নেয়, তাতে ফোঁপানের শব্দ আরও প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে বাবার মুখে আমার নামের উচ্চারণ শুনে আমি অকস্মাৎ আকর্ণ ঘেমে গেলাম। সেই কথা যেন কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে এক মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল সমস্ত শরীরে। আমি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে দুটি কান হাত দিয়ে যথাসাধ্য চেপে ধরলাম। এই প্রথম আমি অনুভব করলাম, কান্না চেপে রাখার কষ্ট কত ভয়াবহ। মনে হয়, অন্ধকারে দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে হেঁটে গিয়ে মধুমতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে যত জোরে ইচ্ছে হয়, কাঁদি। একমাত্র অন্তর্যামী ছাড়া কেউ আমার কান্না শুনতে পাবেন না। হয়তো, তাহলে একটু হালকা হতে পারব।
যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দরজায় সন্তর্পণে আরো দুয়েকটা লাথি মেরে শেষপর্যন্ত মায়ের কাছে হেরে যান বাবা। বাবাকে সে রাত রান্নাঘরে আর বারান্দাতেই কাটিয়ে দিতে হয়েছিল। মাঝেমাঝেই ধোঁয়ার গন্ধ আসছিল নাকে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, শোয়ার জায়গা না পেয়ে আর অপমানে একটার পর একটা বিড়ি ধরিয়ে টেনে যাচ্ছেন তিনি। আর থেমে থেমে আসছিল পায়চারির শব্দ। এমন দুঃসহ আর ভয়াবহ যন্ত্রণার রাত তখন মাঝেমাঝেই ফিরে আসত আমার জীবনে। আমি চাপা কান্না নিয়ে নির্ঘুম পার করে দিতাম সেইসব ভয়াবহ রাত।