পলাশ মজুমদার
জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার কোলাপাড়া গ্রামে। বসবাস ঢাকায়। দিব্যপুরুষ তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস (২০২১)। হরিশংকরের বাড়ি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ (২০২০- বিদ্যাপ্রকাশ)। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ: বাংলা দেশে বাঙালির দেশে (ভ্রমণকাহিনি) (২০১১-শুদ্ধস্বর)। প্রধান সম্পাদক: সম্প্রীতি সাহিত্য পত্রিকা।
পলাশ মজুমদার

উপন্যাসাংশ: “দিব্যপুরুষ” // পলাশ মজুমদার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

পলাশ মজুমদার একজন সমকালীন কথাসাহিত্যিক। ২০২০ সালে প্রকাশিত দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ “হরিশংকরের বাড়ি” সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। “দিব্যপুরুষ” তাঁর প্রথম প্রকাশিতব্য উপন্যাসগ্রন্থ, প্রকাশিত হবে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। উপন্যাসটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। মূলত মুসলমানরা ভারত বিজয়ের পর কীভাবে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটলো সেটিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। ইসলাম প্রচারে ভারতীয় উপমহাদেশে পীর-দরবেশদের প্রভাবও এখানে এসেছে। তাছাড়া বৌদ্ধ পাল বংশের পতন এবং হিন্দু সেনদের আগমনের ইতিবৃত্তও আবদ্ধ হয়েছে ঐতিহাসিক এই উপন্যাসে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কোনো কথাসাহিত্য নেই, একারণে প্রকাশিতব্য উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও এটি আমাদের “উপন্যাস সংক্ষেপ” সংখ্যায় স্থান পেয়েছে। উপন্যাসটির ১ম অধ্যায় দর্পণের পাঠকদের জন্য দেওয়া হলো। এই অংশে উঠে এসেছে একজন নিম্নবর্ণের হিন্দু যুবক সাধুপুরুষের সান্নিধ্যে যবন ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণ করেছে। এক পর্যায়ে সেই যুবকের মা-ও যবন ধর্ম গ্রহণ করে; অথচ যুবকের বাবা পড়ে যান সিদ্ধান্তহীনতার সংকটে।


অধ্যায়: এক 


কয়েক দিন আগে যবন ধর্ম গ্রহণ করেছে হরিদাসের ছেলে নিরঞ্জন দাস। এই ঘটনার পর থেকে যেন শেল বিঁধে আছে হরিদাসের বুকে। আহত বাঘের মতো গজরাচ্ছেন তিনি। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রণা সহ্যের চেয়ে বেশি কঠিন, হরিদাস তা টের পাচ্ছেন ভালোভাবে।

নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টার কমতি নেই হরিদাসের। অথচ নিরঞ্জনের মা কাননবালার মানসিক অবস্থা তার বিপরীত। অস্থির হয়ে পড়েছেন কাননবালা, যা প্রকাশ পাচ্ছে তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণে।

স্বামীর এমন নির্লিপ্ততা কাননবালাকে অবাক করে। তার কাছে হরিদাসকে তখন ঠিক মানুষ বলে মনে হয় না। একেবারে চুপচাপ, যেন বাক্শক্তি নেই। এটা হরিদাসের স্বভাব নয়। তিনি সবসময় কথা বলতে পছন্দ করেন। অথচ এখন কাননবালার কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছেন না। তবু কাননবালা ছেলের পক্ষাবলম্বন করে যাচ্ছেন ক্রমাগত।

হরিদাস এক কঠিন পরীক্ষায় আজ অবতীর্ণ। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র! এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, তিনি জানেন না; জয়-পরাজয় তো অনেক দূরের বিষয়। এমন রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হরিদাস জীবনে কখনো হননি। তিনি কিছু ভাবতে পারছেন না আর, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।

বাক্শূন্য হরিদাসের চারদিকে শুধুই অন্ধকার। কোথাও আশার আলো নেই। তিনি যেন অথৈ সাগরে কেবল হাবুডুবু খাচ্ছেন, পাচ্ছেন না কূলকিনারা। কী করবেন, কার কাছে যাবেন, কার পরামর্শ নেবেন—বুঝে উঠতে পারছেন না কিছুই।

পৃথিবীতে একান্ত আপনজন বলতে হরিদাসের তেমন কেউ নেই। পিতা রামদাস ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন বছর দশেক আগে; মাতা যোগমায়াকে তো হারিয়েছেন সেই ছোটবেলায়। ভাইবোনও কেউ বেঁচে নেই আর। প্রতিবেশীদের মধ্যেও এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে কথা বলতে পারেন প্রাণ খুলে; কিংবা দুঃসময়ে পেতে পারেন সুপরামর্শ।

দশ ক্রোশ দূরের গ্রাম মদনপুরে নবচন্দ্র দাস নামে বাল্যকালের একজন সুহৃদ আছেন, যার সঙ্গে আছে হরিদাসের কিছুটা আত্মীয়তার সংযোগ। তবে এখন তার কাছে তিনি যেতে ইচ্ছুক নন। না যাওয়ার যৌক্তিক কারণও আছে। কাননবালা নবচন্দ্র দাসের কথা বললে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, না, কখনো নয়। সে আর আগের মতো নেই।

ধর্মপ্রাণ পিতার স্নেহছায়ায় থাকার কারণে হরিদাসের বরাবরই ধর্ম ও দেব-দ্বিজে অবিচল ভক্তি; ছেলেকেও তিনি বড় করেছেন নিজের আদর্শে। অথচ সেই ছেলে কিনা চৌদ্দপুরুষের ধর্ম ছেড়ে বিধর্মী হয়েছে। হায় হরি! ধর্মত্যাগের আগে সে গলায় দড়ি দিল না কেন—হরিদাস বারবার এই কথাটিই মনে মনে জপ করে চলেছেন।

যবন ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর নিরঞ্জন ‘নিজাম’ নাম গ্রহণ করে; নামটি দিয়েছেন সাধুপুরুষ স্বয়ং। নিরঞ্জন এখন নবধর্মের একনিষ্ঠ প্রচারক; পুণ্ড্রনগরীর যবন সাধুপুরুষ হায়দারের প্রিয় শিষ্য।

গ্রামে গ্রামে ঘুরে নিরঞ্জন আর তার সতীর্থরা ব্রাহ্মণ ও সামন্তপ্রভুদের দ্বারা নির্যাতিত ভিক্ষু, যোগী ও নমঃশূদ্রদের এমনভাবে যবন ধর্মের মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছে যে মানুষজন রীতিমতো ভিড় জমাচ্ছে যবন কেন্দ্রে। তাদের বিভিন্নমুখী প্রচারে বিনোদপুরসহ করতোয়া-তীরবর্তী জনপদগুলোতে ইতিমধ্যে ঘটে গেছে সামাজিক বিপ্লব।

মানুষ এটুকু বুঝতে পারছে, বাঁচতে হলে আগের জীবন আর চলবে না। এতকাল সামন্ত ও রাজপুরুষদের অত্যাচার রুখে দিতে পারেনি বলে তাদের কেবল স্থানচ্যুত হতে হয়েছে। যাযাবরের মতো। মেলেনি মুক্তি। পায়নি ভূমিপুত্রের স্বীকৃতি। অবিকশিত থেকে গেছে জীবনের সমূূহ সম্ভাবনা। এখন নতুন করে যেভাবে যবনাক্রমণ শুরু হয়েছে, এতে নিশ্চিহ্ন হওয়া ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

আগন্তুক ও স্থানীয় যবনদের উৎসাহ ও পরামর্শে মানুষ যাচ্ছে যবন কেন্দ্রে। অনেকে এই কেন্দ্রকে বলছে পিরের দরগা। কারো কারো মুখে বলতে শোনা যায়, দরবেশের খানকা বা আস্তানা। সাধুপুরুষের শরণাপন্ন হলে সমুদয় বিপদ থেকে মুক্তি মেলে—বিশ্বাসটি দিন দিন যত পোক্ত হচ্ছে, তত ভিড় বাড়ছে কেন্দ্র-প্রাঙ্গণে।

মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে নিরঞ্জন। তবে তা রাতের অন্ধকারে। পিতার অগোচরে। মাকে সে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝায় এবং বোঝাতে সক্ষম হয় যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ধর্মান্তর ছাড়া মুক্তির উপায় নেই। এমনিতে কাননবালা পুত্রস্নেহে অন্ধ, তার ওপর নিরঞ্জনের নবধর্মে আহ্বান তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।

কাননবালা ভাবেন, এবার হয়তো সব দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান হবে, আসবে মুক্তি। অথচ এই মুক্তির পথে বাধা তার স্বামী। হরিদাস কিছুতে বুঝতে চান না, দিন বদলে গেছে, পরিবর্তন হতেই হবে; পুরোনো ধ্যানধারণায় আঁকড়ে থাকলে আর চলবে না।

কাননবালা কখনো স্বামীকে অনুনয় করেন—আচ্ছা, অন্তত প্রাণরক্ষার জন্য হলেও এখন দীক্ষা নাও; পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রায়শ্চিত্ত করে স্বধর্মে ফিরে এলে না হয়!

না, এ অসম্ভব!—হরিদাস চড়া গলায় উত্তর করেন। তিনি আরো বলেন, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ! ধর্ম বিসর্জন দিয়ে যদি প্রাণ রক্ষা করতে হয়, অমন প্রাণ আমার নিষ্প্রয়োজন। ধর্ম ত্যাগের বদলে আমি প্রাণ দিতেও দ্বিধা করব না। এটাই আমার শেষ কথা।

স্বামীর এমন কঠিন কথায় কাননবালা কিছুটা দমে যান; তবে পুরোপুরি থামেন না।

নবধর্মে দীক্ষিত হওয়া নিয়ে কাননবালা ঝগড়াঝাটি করে চলেন স্বামীর সঙ্গে; চলে কথা-কাটাকাটি। প্রতি কথায় দুজনের মধ্যে দেখা দেয় কলহ। হরিদাস স্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, নিরঞ্জনের মুখ তিনি দেখবেন না কোনোকালে। এমনকি ধর্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে তিনি ত্যাগ করবেন সংসার। মানুষের যদি ধর্মই না থাকে, তবে আর থাকে কী? প্রাণের চেয়ে ধর্মের মূল্য কি বেশি নয়! ধর্মহীন মানুষ যে পশুর তুল্য।

হরিদাস ঠিক বুঝতে পারছেন, তাদের এতকালের সংসার কর্পূরের মতো উবে যাওয়ার অপেক্ষায়।

যবন ধর্মের প্রতি স্ত্রীর মাত্রাত্রিরিক্ত আগ্রহ দেখে হরিদাস বিচলিত। রীতিমতো বিব্রত। কাননবালার এই আমূল পরিবর্তনের কোনো অর্থ খুঁজে পান না তিনি। এদিকে নিজের মতো করে স্ত্রীকে বোঝাতে পারছেন না বলেও ভেতরে ভেতরে তিনি দগ্ধ হচ্ছেন। মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দায় হয়ে যায় তখন। আবার কাননবালার কথা শুনে কখনো রক্ত চড়ে যায় হরিদাসের মাথায়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। খুন করতে ইচ্ছা করে।

হরিদাস প্রায় সময়ই কথা বলেন না। তবু চুপ থাকেন না কাননবালা। তার কাছে ওই প্রসঙ্গ ছাড়া আর কোনো কথা নেই। স্বামীকে খুব উৎসাহ নিয়ে বলেন, জানো, ডোম-হড্ডি ও চণ্ডালরা দলে দলে দীক্ষিত হচ্ছে; ধর্মান্তরিতদের মধ্যে আমাদের মতো নমঃশূদ্রদের সংখ্যাই বেশি।

কাননবালা আরো বলেন, যবন কেন্দ্রে দীক্ষাগ্রহণ চলছে সব সময়। একটা উৎসব-উৎসব ভাব চারদিকে। দীক্ষাগ্রহণের প্রক্রিয়াটিও খুব সহজ। স্নান করে শুদ্ধ হয়ে পরিষ্কার কাপড় পরে দীক্ষাগুরুর কাছে সংক্ষিপ্ত একটি মন্ত্র পাঠ মাত্র। মন্ত্রটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের জীবন মিথ্যা হয়ে যায়, শুরু হয় নতুন জীবন; নবধর্মে এসে বিলীন হয় এত দিনের জীবনপ্রণালি, শাস্ত্র-লোকাচার, সংস্কার ও বিশ্বাস। পূর্বপুরুষের ধর্ম একটি মন্ত্র দ্বারা বাষ্পের মতো মুহূর্তে উড়ে যায়। অবিশ্বাস্য, তাই না?

স্ত্রীর কথা শুনে থর থর করে কাঁপতে থাকেন হরিদাস। বেড়ে যায় রক্তচাপ। রাগে রি রি করে ওঠে শরীর, উত্তপ্ত হয় ব্রহ্মতালু। কখনো তর্ক করলেও কখনো আবার চুপ করে থাকেন; কেবল শোনেন নীরবে। আর দাঁতে দাঁত পিষে নিয়ন্ত্রণ করেন ক্রোধ।

তাদের সংসারে ছন্দপতন ঘটেছে; বড় বেসুরো আর তাল-লয়হীন বাজছে সংসার-সংগীত। কেবল কি তাদের সংসার? গোটা জনপদের মানুষের মনে একদণ্ড শান্তি নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবাই তটস্থ। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না চোখে। আগামী দিনের সবকিছু অস্পষ্ট। কুয়াশাচ্ছন্ন। ভাগ্যে কী লেখা আছে কেউ জানে না!

অন্য সময় মনমরা থাকলেও এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে কাননবালার চেহারায় খেলে যায় আনন্দের ঢেউ। তাকে তখন মনে হয় বেশ প্রাণবন্ত আর উচ্ছল। জাগতিক অন্য কোনো বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। হরিদাস বিরক্ত হলেও সব কথার মধ্যেই কাননবালা কোনো না কোনোভাবে টেনে আনেন নবধর্মের প্রসঙ্গ।

হরিদাস লক্ষ করেন, তার স্ত্রী প্রায়ই বলেন—এ নতুন ধর্ম আগে গ্রহণ করলে তাদের মেয়ে লীলাবতীকে মরতে হতো না। তারপরই শুরু করেন অবিশ্রান্ত বিলাপ। সঙ্গে গগনবিদারী চিৎকার। থামেন না সহজে।

লীলার কথা হরিদাস নিজে কি ভুলতে পেরেছেন? মেয়ের স্মৃতি মনে করে তার হৃদয় যে সর্বদা পুড়ছে, তা কি কাননবালা টের পান? লীলার জন্য তার কষ্ট কি কাননবালার চেয়ে কোনো অংশে কম।

হরিদাস হয়তো স্ত্রীর কাছে লীলার বিষয়টি বলতে পারেন না; কিন্তু আদরের মেয়েটির কথা মনে পড়লে বুকটা ফেটে যেতে চায় কষ্টে। তবে এই অভিব্যক্তি তিনি স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করতে চান না, যদি না কাননবালার যন্ত্রণা বাড়ে। সহনশীলতা নারীর চেয়ে পুরুষের বরাবরই বেশি। নিজে সয়েও হরিদাস সান্ত্বনা দেন স্ত্রীকে।

এত অশান্তির মধ্যেও অনুপস্থিত মৃতা মেয়েটি এখন তাদের দুজনের মাঝখানে অদৃশ্য সেতুবন্ধ! লীলার অতৃপ্ত আত্মা মা-বাবার কাছে কাছে যেন ঘুরে বেড়ায়, চোখ বুজে কান পাতলে ঘরের চারপাশে তারা শুনতে পান লীলার নিশ্বাসের শব্দ, পায়ের আওয়াজ!

লীলাবতী কী এমন অপরাধ করেছিল? বৈধব্যের বেশে লীলা যেদিন পিতৃগৃহে ফিরে আসে, সেদিনই সমাজের রোষানলে পড়ে তার পরিবার, যেন চরম কোনো অপরাধ করে স্বামীগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছে সে। তার দোষ, তার সারা শরীরে যৌবন টগবগ করছে—গ্রামের যুবকদের নষ্ট করার জন্য তার বয়সটা, শরীরটা ভীষণ ভয়ংকর।

সমাজের ধারণাই আংশিক ফলেছে। লীলা ভালোবেসেছিল অজান্তে; বাল্যকালের খেলার সঙ্গী প্রতিবেশী সুধাকর দাসের প্রণয়াসক্ত লীলা হয়েছিল অভিসারিণী। যুবক সুধাকর পারেনি তার আহ্বান ফিরিয়ে দিতে; যুগ-যুগান্তরের সম্পর্কে বাঁধা পড়ে সমবয়সি দুই যুবক-যুবতী। মুখে মুখে দ্রুত ছড়িয়ে যায় তাদের প্রণয়-কাহিনি। সমাজ এতটুকু সহ্য করার মতো উদারতা পোষণ করতে পারত, কিন্তু তার বেশি মেনে নেয়ার সামর্থ্য ওই সমাজের ছিল না।

লীলার গর্ভে যে সুধাকরের ঔরসজাত সন্তান ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। যত দিন ব্যাপারটা গোপন ছিল, তত দিন কোনো সমস্যা হয়নি। গর্ভধারণের বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়ার পর সমাজদরদিরা আর বসে থাকতে পারল না; নেমে পড়ল পাপ ও পতন থেকে সমাজকে বাঁচানোর সংগ্রামে। চি চি পড়ে গেল গ্রামজুড়ে। সমাজরক্ষার কথা বলে ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে এলো সবাই। বিচারসভা বসাল।

লীলা কতবার বলেছিল, সে সুধাকরকে ভালোবাসে এবং এ তাদের ভালোবাসার সন্তান। বিধবার ভালোবাসা ও সন্তান নিয়ে কী পরিহাসই না করল উপস্থিত মানুষজন। তাকে কলঙ্কিনী অপবাদ দিয়ে দুই পরিবারকে করল একঘরে। সেদিন গ্রামপতি এবং সমাজের মানুষজন এক পর্যায়ে লীলা ও তার পরিবারকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও ভর্ৎসনা করে, সেসব অন্যরা হজম করলেও লীলা পারেনি। সমাজের নিষ্ঠুর অমানবিক বিচার অভিমানী লীলাবতীকে ঠেলে দেয় আত্মহননের দিকে।

শুধু কি মান-সম্মান আর চক্ষুলজ্জা? না, কাননবালার মাতৃহৃদয় টের পেয়েছিল, সুধাকরের প্রতি লীলার চরম আকর্ষণ ও নির্ভরতা, প্রেমের মাঝে বেঁচে থাকার প্রেরণা, অনাগত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এবং জীবন সম্পর্কে মেয়ের গভীর আত্মোপলব্ধি।

ওই সময়ের কথা মনে করে কাননবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিছুতেই লীলাকে ভুলতে পারেন না তিনি। ছোট্ট লীলা যেন এখনো মায়ের আঁচল ধরে বায়না করে—মা, আমার পুতুলের কখন বিয়ে দেব।

লীলার প্রসঙ্গ ভোলার জন্য স্বামীকে তিনি বলেন, জানো, এদের ধর্ম সম্পূর্ণ অন্য রকম। স্বামী যদি মারা যায়, বিধবা স্ত্রী আবার পতি পরিগ্রহ করতে পারে। এমনকি মতের দ্বন্দ্ব বা কলহে যদি সংসার যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে, সম্পর্ক ছিন্ন করে তারা পুনরায় বিয়ে করতে পারে। আর আমাদের ধর্ম ও শাস্ত্র এই ব্যাপারে কত কঠোর।

হরিদাস যেন শুনছেন না কাননবালার কথা, ভাবছেন অন্য কিছু। স্বামীর এই অন্যমনস্কতা তাকে ক্রুদ্ধ করলেও তা গোপন করেন কাননবালা; মনের কোণে আবার হানা দেয় লীলা। হঠাৎ কাননবালা বলেন, লীলা যদি আজ বেঁচে থাকত, আমি নিরঞ্জনের সঙ্গে তাকে যবন ধর্মে দীক্ষা নিতে বলতাম। একটাই তো জীবন। আমার লীলা জীবনকে চেয়েছিল পরিপূর্ণভাবে। তার বেঁচে থাকার প্রতি ছিল কী গভীর মমতা!

হরিদাস এবার কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে কাননবালা থামিয়ে দিয়ে বলেন, মেয়েটার সংসারের স্বপ্ন ছিল, ছিল স্বামী-সন্তানের আকাঙ্ক্ষা। অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে; জীবনে কী পেয়েছে সে? বুঝে ওঠার আগেই সব হারাতে হলো তাকে। বসন্তদাসের কাছে তো সে কিছুই পেল না; না সন্তান, না সংসার; অসুস্থ জামাইটা অকালে গেল মরে।

সুধাকর তো তাকে সব দিতে চেয়েছিল। পারেনি কেবল এই অমানবিক সমাজের জন্য; সমাজের নিষ্ঠুর বিচারের কারণে লীলাকে শেষ পর্যন্ত বিমুখ হতে হয় জীবনের প্রতি। আমার জীবনটা এমনই অভিশপ্ত যে ছেলেমেয়েকেও নিজের কাছে ধরে রাখতে পারলাম না। এই জীবন নিয়ে আমি কী করব? কী করার আছে? বেঁচে থাকার প্রতি আর সামান্যও আগ্রহ নেই আমার।

কাননবালা থামতে চান না। সুধাকরদের কথাও বলেন তিনি।—সুধাকরের পরিবার বিনোদপুর ছেড়ে চলে গেছে। শুনেছি, তারা সবাই আছে পুণ্ড্রনগরীর যবন কেন্দ্রে। দীক্ষিত হয়েছে নতুন ধর্মে। তার বাবার নাম এখন ইব্রাহিম, মায়ের নাম জোহরা আর বোনের নাম হুমায়রা।

কাননবালা আরো বলেন, এই ধর্মে নাকি ধনী-গরিব, উঁচু-নীচ ভেদাভেদ নেই। প্রভু-ভৃত্য একসঙ্গে আহার করে, এমনকি প্রার্থনাও করে পাশাপাশি বসে। অদ্ভুত এদের প্রার্থনার নিয়ম। কোনো কিছু আমাদের মতো নয়। সবাই সোজা হয়ে পাশাপাশি দাঁড়ানোর পরে পুরোহিত সামনে দাঁড়িয়ে যা যা করেন, পেছনের সারিবদ্ধ লোকজন একই কাজ করেন। প্রার্থনার সময় সামনে থাকে না ভগবানের কোনো বিগ্রহ। নিরাকার অদৃশ্য ভগবানের পদতলে যেকোনো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্থানে প্রতিদিন পাঁচবার প্রণাম করে তারা।

হরিদাস এবার চুপ থাকতে পারেন না। চিৎকার দিয়ে বলেন, কানন, তুমি আবেগে অন্ধ হয়ে গেছ। তোমার সঙ্গে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। তবু তুমি যেহেতু আমার ধর্মপত্নী, তোমাকে কিছু কথা জানানো প্রয়োজন মনে করছি। এই ধর্ম আমার নয়, আমার চৌদ্দপুরুষের। আমি সেই মহান ধর্মের অনুসারী মাত্র।

যুগ যুগ ধরে এই মাটির মানুষ এই ধর্মের নিয়মকানুন গভীর নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সঙ্গে অনুসরণ করে আসছে; আমাদের পূর্বপুরুষরা পালন করেছেন এই ধর্মের সুমহান প্রথা ও রীতিনীতি, সেই পবিত্র রক্ত আমাদের দেহে সঞ্চারিত; আমাদের রক্তকণিকায় মিশে আছে এই ধর্ম। এই ধর্ম এই দেশের মাটির ধর্ম। আমরা এই মাটিরই সন্তান।

হরিদাস আরো বলেন, আমাদের জীবনের সব আয়োজন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এই ধর্মের সঙ্গে যেমন, তেমনি এই মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এই ধর্মের উৎপত্তি ভগবানের এই পবিত্র ভূমিতে; এই ভূখণ্ডের আলো-হাওয়া-জলে পরিপুষ্ট হয়েছে আমাদের সনাতন বিশ্বাস। আর তুমি কিনা বলছ এই ধর্মকে পরিহার করতে। ধর্ম-ত্যাগের পরিণতি কী তুমি জান? জানো, ধর্ম-বদলের মানে? নতুন ধর্ম গ্রহণ করার অর্থই হলো নিজের সত্তাকে, নিজের পূর্বপুরুষকে অস্বীকার করা—এ অসম্ভব ব্যাপার।

তোমার কাছে মিনতি করছি, এমন চিন্তা তুমি মনে স্থান দিয়ো না। ভুলে যাও ধর্মত্যাগী পথভ্রষ্ট নিরঞ্জনের কথা। মনে করো, আমাদের কোনো ছেলে ছিল না। পূর্বপুরুষকে স্মরণ করো—এই পথ ত্যাগ করলে তাদের অভিশাপে নরকে আমাদের স্থান অবধারিত। তারপরও যদি তুমি অবাধ্য হও, তবে আমিও আত্মঘাতী হব। লীলার মতো। আর তা না হলে নির্ঘাত দেশান্তরি হব। আমাকে খুঁজে পাবে না কোথাও।

কাননবালা আর কথা খুঁজে পান না। কী বলবেন তিনি? মেয়ে হারানোর শোক এখনো পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেননি, স্বামী হারানোর ভার তিনি বহন করবেন কীভাবে। ছেলে তো থেকেও নেই; স্বামী-সন্তানহীন কাননবালা তাহলে বাঁচবেন কী নিয়ে।

অকস্মাৎ তীব্র নিঃসঙ্গতাবোধ কাননবালাকে ঘিরে ধরে। অন্তহীন এক নৈরাশ্যবোধে কুঁকড়ে যেতে থাকেন তিনি। কীভাবে হরিদাসের সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক ছিন্ন করবেন কাননবালা? ছিন্ন করা কি সম্ভব। উপায়ান্তর না দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। অশ্রুপাত ছাড়া কাননবালা আর কীই-বা করতে পারেন। তিনি যে অসহায়।

একসময় কান্না শেষ হয়। কাননবালা শূন্যদৃষ্টিতে গাছপালার ভেতর দিয়ে তাকান নদীর ওপারে; খোলা মাঠ ছাড়িয়ে আরো দূরে যেখানে দিগন্ত ভূমির সঙ্গে একাকার।

কিছুক্ষণ পর ঝাপসা হয়ে ওঠে কাননবালার দৃষ্টি। মনে হয় চোখে কিছু দেখতে পারছেন না, কানে ঢুকছে না কোনো শব্দতরঙ্গ। তবে কি তিনি অন্ধ-বধির হয়ে গেছেন? হরিদাস কী যেন তাকে বলেন; বুঝতে পারলেও উত্তর দেয়ার ক্ষমতা যেন তার আর অবশিষ্ট নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশে অবোধের মতো বসে থাকেন কেবল। এভাবে কাটে কিছুটা সময়।

হঠাৎ অশ্রুসিক্ত চোখে কাননবালা স্বামীকে বলেন—ওগো, এ কেমন জীবন হয়ে গেল আমাদের? এই আমরা কোন সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছি? কবে শেষ হবে এই দুঃসময়? দুজন মানুষ জীবনের এতগুলো দিন একসঙ্গে কাটিয়েছি, অথচ আজ আমরা কে কী ভাবছি। কেন ভাবনাগুলো আমরা একত্রে মেলাতে পারছি না? কেন আজ আমাদের মাঝখানে এই কঠিন দেয়াল? আমরা কি আর এই দেয়াল ভাঙতে পারব।

কাননবালার মুখে এমন কথা শুনে হরিদাসের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অসহ্য বেদনায়। বন্ধ হয়ে আসতে চায় শ্বাস-প্রশ্বাস। কাননবালাকে ছাড়া তার কি বেঁচে থাকা সম্ভব। তিনি স্ত্রৈণ নন, তারপরও যে জীবন এত দিন দুজনে পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে কাটিয়েছেন, তা তো মিথ্যা প্রাচীরবেষ্টিত ছিল না। তাদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক, আছে সুখে-দুঃখে পাশে থাকার অঙ্গীকার।

ভালোবাসা কী, তা এ প্রবীণ দম্পতি কোনোদিন জানতে পারেননি; জানা ও বোঝার সুযোগও হয়তো তাদের জীবনে আসেনি; শুধু এক সীমাহীন নির্ভরতার জালে আটকা পড়ে তারা দুজন একসঙ্গে পার করেছেন জীবনের বেশির ভাগ সময়। মনের নাগাল তারা হয়তো কোনোদিন পাননি; সে ভাবনা মনেও আসেনি কখনো। কেবল শারীরিক বন্ধন আর কিছু নাম না-জানা অনুভূতি তাদের এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল এতকাল। এখন সব বন্ধন যেন ছিঁড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তারপর কী।

দুজনের মনে কত প্রশ্ন ঘুরপাক করছে। তারা জানেন, তাদের কাছে নেই এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর। তাই একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করতেও দ্বিধাগ্রস্ত। কেবল মনে হচ্ছে জীবন ধেয়ে চলেছে অন্তসারশূন্যতার দিকে। আত্মনিয়ন্ত্রণের খুব চেষ্টা করেন হরিদাস; কিন্তু পারেন না। এক অপ্রতিরোধ্য আবেগ তাকে স্ত্রীর কাছে টানে চুম্বকের মতো।

হরিদাস স্থান ত্যাগ করেন ধীরে ধীরে; কাছে এসে কাননবালার হাত ধরেন—চলো কানন, আমরা নতুনভাবে আবার শুরু করি। বাঁচলে একসঙ্গে, মরলেও একসঙ্গে।

কাননবালা স্বামীর মুখপানে নীরবে চেয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর বলেন, এখন কি সে সময় আর আছে? আমাদের মধ্যে যে ইতিমধ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। এ ব্যবধান কি আর ঘুচবে কখনো? আর সহ্য করতে পারছি না। আমার এখন মুক্তি প্রয়োজন। আমি মুক্তি চাই।

মুক্তি? কিসের মুক্তি? হরিদাসের কণ্ঠে প্রশ্ন।

কাননবালা মুহূর্তে উত্তর করেন, পাপ থেকে মুক্তি।

কোন পাপের কথা তুমি বলছ? কী পাপ তুমি করেছ?

কাননবালা চারদিকে একবার তাকিয়ে স্বামীর চোখের ওপর ক্ষুব্ধ দৃষ্টি ফেলেন—পাপ আমরা দুজন করেছি, আমার সন্তানেরা করেছে। হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষও করেছিল। নইলে আমরা কিসের ফল ভোগ করছি এখন? আমার লীলাকে প্রাণ দিতে হলো কেন? সুধাকরকে ভালোবেসে সে পাপ করেছিল বলেই তো সমাজ তাকে ঠেলে দিল মৃত্যুর দিকে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাননবালা আরো বলেন, আর আমার নিরঞ্জন? সে কি কম দুঃখে যবন ধর্ম গ্রহণ করেছে। আমি জানি, তার বুকে কী গভীর ক্ষত, কী নিদারুণ যন্ত্রণা। আমার অভিমানী ছেলেকে তুমি কখনো বুঝতে পারোনি। কৃষ্ণাকে ভালোবেসেছিল সে। নমঃশূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণের মেয়েকে ভালোবাসার কারণে কৃষ্ণার বাবা গ্রামপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরঞ্জনকে মেরেই তো ফেলেছিল; সেদিন সে বেঁচেছিল নিছক ভাগ্যগুণে।

আমি তো মনে করেছিলাম আমার ছেলেকে আর কখনো ফিরে পাব না। অর্জুন ও তার বাবা পাশে না দাঁড়ালে সেদিনই আমরা নিশ্চিত সন্তানহীন হতাম। ধরতে গেলে অর্জুন নিরঞ্জনকে পুনর্জীবন দিয়েছে, তাদের ঋণ আমরা শোধ করব কীভাবে।

হরিদাস স্ত্রীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেন—নিরঞ্জনের জন্য অর্জুনের এই ত্যাগস্বীকার ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই অসম্ভব। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর এমন মমতা দেখা যায় না সচরাচর। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে যেভাবে নিরঞ্জনকে সেবাযত্ন দিয়ে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, তাকে ছেলের পুনর্জন্মই বলতে হবে। আর আমার বন্ধু নবচন্দ্র দাসের কথা কি ভুলে গেছ? তার কথা কি তোমার একটুও মনে নেই?

ওনার কথা কি ভোলা সম্ভব? কৃষ্ণার বাবার ভয়ে ও হুমকিতে তখন অর্জুন তাকে নিজের কাছে রাখতে পারেনি। বাধ্য হয়েছিল মদনপুরে তাকে লুকিয়ে রাখতে। কাননবালা বলেন।

ছেলের জন্য কৃতজ্ঞ থাকলেও হরিদাস বন্ধুর প্রতি মনে মনে ক্ষুব্ধ; কিন্তু সে কথা স্ত্রীকে বলেন না তিনি। তার অনুমান, মদনপুরে থাকার সময়ই নিরঞ্জনের মাথায় ঢুকেছিল যবন ধর্মের বীজ। তবে এটা সত্য, পছন্দের ব্যক্তি যেমন সামান্য কারণে চক্ষুশূল হতে পারে, তেমনি অপছন্দের ব্যক্তিও বিপদের সময় পরম আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে; পছন্দ-অপছন্দ কিংবা লাভ-লোকসানের হিসাব তখন হয়ে পড়ে অর্থহীন।

হরিদাস বলেন—কানন, এটা তো আমাদের পরম ভাগ্য, নিরঞ্জন আজও বেঁচে আছে।

তুমি তাহলে বল—তাদের কী অপরাধ ছিল? তারা তো ভালোবেসেছিল মানুষকে। এই ধর্মে তো মানুষকে ভালোবাসাও পাপ। এ সমাজে ভালোবাসার চেয়ে নিয়ম বড়, সংস্কার বড়, জাতগোত্র বড়। বড় হৃদয়হীন আর নিষ্ঠুর সমাজের মানুষগুলো। আমি মানি না, এই সমাজের আইনকানুন। মানি না বর্ণভেদ প্রথা। যে সমাজে মানবতা বলে কিছু নেই, আমি সেই সমাজের একজন হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।

তাই বলে তুমি চৌদ্দপুরুষের ধর্ম বিসর্জন দিতে চাও?

হ্যাঁ, চাই। আমার ধর্ম কী? আমার যদি কোনো ধর্ম থাকে, তা মাতৃত্ব। আমি মা। সন্তানহীন আমার এই কষ্ট মৃত্যুযন্ত্রণার অধিক। আমি আমার সন্তানদের ফেরত চাই। তুমি কি পারবে ওদের আমার বুকে ফিরিয়ে দিতে? জানি, কোনোদিনও পারবে না। যে সমাজের কারণে সন্তান হারিয়ে আমরা আজ একঘরে, সে আমার সমাজ হয় কীভাবে? যে ধর্ম আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে, তাকে আমার ধর্ম বলি কী করে?

কাননবালার এমন অগ্নিমূর্তি হরিদাস আগে কখনো দেখেননি। স্ত্রীর আচরণে তিনি স্তম্ভিত। এই মুহূর্তে কী করতে পারেন তিনি? তার কী করণীয় ….তিনি অনুভব করছেন, সন্তানের শোক কাননবালাকে বদলে দিয়েছে; পরিণত করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষে। হরিদাস আজ অক্ষম; এই পাগলপ্রায় রমণীকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা যে তার জানা নেই।

হরিদাসের বারবার মনে হচ্ছে—এই কাননবালা তার স্ত্রী নন; যার সঙ্গে তিনি এতকাল সংসার করে এসেছেন, এর মাঝে সেই চিরচেনা নারীর বিন্দুমাত্র ছায়াও নেই। এ যেন ভিন্ন কোনো নারী, যাকে হরিদাস চেনেন না। তবে কি তার স্ত্রীর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে? ঘটতে পারে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিকৃতি ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। মানুষের তো সহ্যের সীমা থাকে, সেই সীমা অতিক্রম করলে কে মাথা ঠিক রাখতে পারে।

একের পর এক ধকল তার জীবনকেও কি কম বিপর্যস্ত করেনি? কঠিন হৃদয় হরিদাস নিজেকে কীভাবে সংযত রাখছেন, তা কেবল মঙ্গলময় শিব জানেন, মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব। তার অন্তর যে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে, তা কেবল টের পাচ্ছেন তিনি। এ ব্যথা অপরের কাছে প্রকাশও করা যায় না, আবার সহ্য করাও সহজ নয়।

কিছুক্ষণ পর কাননবালা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসেন। হরিদাস জানেন, তার স্ত্রীর রুদ্রমূর্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে কমনীয়তা। কাননবালার রাগ-অভিমান খুব সাময়িক; বেশিক্ষণ রাগ পুষে রাখতে পারেন না তিনি। স্ত্রীর এই রূপটি হরিদাস দাম্পত্য জীবনের প্রথম থেকে দেখে এসেছেন। সেকথা মনে করে ক্রোধ সংবরণ করেন তিনি।

তারপর হরিদাস স্ত্রীকে বলেন—কানন, অনেক হয়েছে, আর নয়, দয়া করে এবার থামো—চলো, আমরা আগের মতো সুখে-দুঃখে পরস্পরের পাশে থেকে বাকি জীবন কাটিয়ে দিই। আমাদের সময় তো প্রায় ফুরিয়ে এলো। প্রয়োজনে আমরা অন্য কোথাও চলে যাই এবং যে কটা দিন বাঁচি, সেখানে কাটিয়ে দেব। ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ?

এমন প্রশ্নে কাননবালার ঠোঁটে ফুটে ওঠে বিদ্রুপের হাসি। কোনো কথা বলেন না তিনি।

স্ত্রীর মৌনতা খেয়াল করে হরিদাস আর কথা বাড়ান না। চলে যান প্রসঙ্গান্তরে। বলেন—নিরঞ্জন ও সুধাকর যাদের সাহচর্যে আছে, তারা কি সবাই যবন ধর্ম গ্রহণ করেছে?

এই প্রশ্নেরও উত্তর দেন না কাননবালা, এবার যেন তিনি বোবা হয়ে গেছেন। তার নিরুত্তর ভঙ্গি হরিদাসকে বেকায়দায় ফেলে; চরম অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন তিনি। কিছুক্ষণ পর হরিদাস কোমল স্বরে বলেন—কানন, আমাকে ছাড়া তুমি কি বেঁচে থাকতে পারবে? পারবে পতিহীন জীবনযাপন করতে? আমার অনুপস্থিতি কি তোমাকে দীর্ণ করবে না?

হরিদাসের এমন প্রণয়-বাক্য কাননবালাকে মুহূর্তে আছড়ে ফেলে বাস্তবের বেলাভূমিতে। সত্যিই তো, স্বামী ছাড়া তিনি জীবনটাকে যাপন করবেন কীভাবে। অগ্নিসাক্ষ্য কি মিথ্যা হয়ে যাবে? মুছতে পারবেন সিঁথির সিঁদুর? এই জীবনে সাত পাকের বাঁধন ছিন্ন করা কি তার পক্ষে সম্ভব? হরিদাসের সঙ্গে সম্পর্কহীনতার কথা তিনি কখনো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। মৃত্যু ছাড়া তো এই বন্ধন কখনো শেষ হতে পারে না। অথচ এসব কী হতে চলেছে।

মনের আকাশে ভেসে ওঠে পুরোনো দিনের স্মৃৃতিগুলো। শূন্যে ভাসমান তুলোর মতো। অসহায়ত্ববোধ তাকে যেন আঁকড়ে ধরে। অস্ফুুটে বলে ওঠেন কাননবালা—না, সম্ভব নয়।

হরিদাস এবার মনে একটু শক্তি পান; স্ত্রীকে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরেন—তুমি ছাড়া আমার পক্ষেও জীবনটাকে যাপন করা অসম্ভব; আমাদের দুজনের মৃত্যুও যেন একই সময়ে হয়। মনে রেখো, আমাকে যেদিন তুমি ছেড়ে যাবে, সেদিন হবে আমার জীবনের শেষ দিন।

কাননবালা আবার নিশ্চুপ। সময় যেন থমকে আছে। নীরবতা ভাঙে হরিদাসের—যদি আমি যবন ধর্ম গ্রহণ না করি, তবে কি আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব? তারা কি থাকতে দেবে?

স্ত্রীর কোনো উত্তর না পেলেও হরিদাস থামেন না—আমি জানি, যবন ধর্ম আরো বেশি নিষ্ঠুর; সেই ধর্মে বিধর্মীদের কোনো স্থান নেই। ওই ধর্ম প্রচারের সময় বহু বিরোধিতাকারীকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মপ্রচারক ও তাঁর অনুসারীরা সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন অনেকবার; কখনো জিতেছেন, কখনো হেরেছেন। যেখানে জিতেছেন, সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাদের ধর্ম। এমন ধর্মযুদ্ধকে তারা বলে জিহাদ। জিহাদ তাদের ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ।

তবু কাননবালা নিরুত্তর। স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে চলে যান ঘরের ভেতরে।

আর একাকী হরিদাস কুঁকড়ে যেতে থাকেন অজানা শঙ্কায়। বুক ভেঙে যায় তীব্র যন্ত্রণায়।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu